সমুদ্রপাড়ে পানির বিপদ! । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

সমুদ্রপাড়ে পানির বিপদ!

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
সমুদ্রপাড়ে পানির বিপদ!
কক্সবাজারে একদিকে বহুমুখী চাপে বেড়েছে সুপেয় পানির চাহিদা অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ায় সমুদ্রসৈকতের নগরীতে সুপেয় পানির সংকট কড়া নাড়ছে দরজায়। ছবি: খবরের কাগজ

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের নগরী কক্সবাজার। পর্যটন ঘিরে পৌর শহরে বিস্তৃত হচ্ছে নগরায়ণ। বাড়ছে জনসংখ্যা। বহুমুখী চাপে বেড়েছে সুপেয় পানির চাহিদাও। এদিকে এক দশক ধরে এ জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিম্নমুখী। এতে সমুদ্রসৈকতের নগরীতে সুপেয় পানির সংকট কড়া নাড়ছে দরজায়। শুধু পৌর শহর নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কক্সবাজার শহর ও উপজেলাগুলোতে প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ১০-১৫ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। আগে ভূগর্ভস্থের ১২০-১৫০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, এখন তা ৩০০ ফুট গভীরে পাওয়া যাচ্ছে। নলকূপ দিয়ে উঠছে লবণ পানি। এই ধারাবাহিকতা থাকলে আগামীতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহ গণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার জেলার ৯৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষের পানির উৎস গভীর-অগভীর নলকূপ। এর বাইরে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ সরবরাহ করা, শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ বোতলজাত এবং শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ পুকুর, খাল, নদী ও লেকের পানি পান করেন।

যে কারণে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কম হওয়া; তাপমাত্রা অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি; পুকুর, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করে হোটেল-মোটেল, আবাসিক ভবন ও রাস্তাঘাট তৈরির কারণে জলাশয় কমে যাওয়া; শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন এবং ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বৃক্ষ নিধনের কারণে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত কমছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পানির স্তর নিচে গেলে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও বাড়ে। পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায়, এতে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়।’

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে কক্সবাজার জেলায় ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসরকারি সংস্থা ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘কক্সবাজার অঞ্চলে বৃক্ষনিধন ও পাহাড় কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণকালে কৃষিজমি, নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।’

শরীফ জামিলের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক পরিবেশ সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার না করলে আগামীতে এই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ঘটবে।

সরেজমিনে পৌর শহর
কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে উত্তর নুনিয়ারছড়া। এলাকাটির উত্তরে মহেশখালী চ্যানেল। পূর্বে বাঁকখালী নদী। অবস্থান একেবারে নদীর লাগোয়া। কিন্তু চারপাশে পানি থাকলেও এখানকার বাসিন্দাদের খাওয়ার পানির দুঃখ যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দুই কিলোমিটার দূরের মসজিদের নলকূপ থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন তারা।

গৃহিণী জমিলা বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে পানির সমস্যা নিয়ে কষ্টে আছি। নলকূপ দিয়ে যে পানি ওঠে, তাও লবণাক্ত। আছে আর্সেনিক। কোনো উপায় নেই। পানির কারণে শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছি।’
আবদুর রহমানের (৭৪) ভাষ্য, বছর দশেক আগে ওই এলাকায় মিঠাপানি পাওয়া যেত। তবে সম্প্রতি ৭০০ ফুট গভীরে গিয়েও পানি পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘এখন যেটা পাচ্ছি এটা প্রথম স্তরের পানি। এটার গভীরতা ১০-১৫ ফুট, এই পানি দূষিত।’

তাদের সঙ্গে আলাপকালে এগিয়ে আসেন গৃহিণী আনজুমান আরা, শাহিদা বেগম, রুনা লায়লা, রাশেদা বেগম। এর মধ্যে আনজুমান বলেন, ‘এখানকার ৩০টি পরিবার দুই কিলোমিটার দূরের মসজিদের গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করে।’

রাশেদা বেগমের ভাষ্য, ‘লবণাক্ত পানির কারণে গোসল, রান্নাবান্না, কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের চর্মরোগ। ১০-১২ বছর ধরে এই অবস্থা চলছে।’ শুধু পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড নয়। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকার চিত্র একই। কোথাও কোথাও কিনে খেতে হচ্ছে পানি।

বন্ধ পৌরসভার তিন কূপ
কক্সবাজার পৌরবাসীর জন্য দৈনিক কী পরিমাণ সুপেয় পানির প্রয়োজন, সেই পরিসংখ্যান কোনো দপ্তর কিংবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কাছে নেই। তবে এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের প্রায় তিন হাজার গভীর নলকূপ ও ৩০ হাজার অগভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক তিন কোটি লিটার পানি তোলা হয়। এই পানি দুই লাখ বাসিন্দা এবং এক লাখ পর্যটকের চাহিদা মেটায়।

কক্সবাজার পৌরসভার তথ্যমতে, পৌরসভার অধীন ১০টি কূপ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৭০-৮০ হাজার গ্যালন পানি উত্তোলন করা হতো। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে পানি উত্তোলন নেমেছে ৩৫-৪০ হাজার গ্যালনে। উত্তোলন করা পানিগুলো ১ হাজার ৪০টি পরিবারকে সরবরাহ করা হয়।

পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১০টি কূপের মধ্যে তিন-চারটি কূপের পানি ভালো পাওয়া গেলেও বাকিগুলোতে ভূগর্ভে পানি না থাকায় বন্ধ রয়েছে। সাত-আট বছর ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে চলমান এই সমস্যার কারণে শহরের বাসিন্দা ও হোটেল-মোটেলে পানির চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

জানতে চাইলে পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘এডিবির অর্থায়নে নির্মিত সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি শিগগির চালু হবে। এটি চালু হলে প্রতি ঘণ্টায় ১০ লাখ লিটার করে দৈনিক ৮ ঘণ্টায় ৮০ লাখ লিটার সুপেয় পানি পাওয়া যাবে। এতে সুপেয় পানির সংকট কেটে যাবে।’

কুতুবদিয়া-মহেশখালী উপকূলে লবণাক্ততা
কুতুবদিয়ার মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ধুঁকছে। অকেজো হয়ে পড়েছে অগভীর নলকূপ। উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী ইউপিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ১০-২০টি পরিবার মিলিয়ে একটি নলকূপ থাকলেও কোনো কোনো এলাকায় নলকূপ নেই। অন্যদিকে মহেশখালী পৌরসভা, কুতুবজোম, মাতারবাড়ী, ধলঘাটায় পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

কুতুবদিয়ার স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কুতুবদিয়ার আহ্বায়ক এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘সুপেয় পানির স্তর পেতে দ্বীপে কিছু এলাকায় ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট নিচে, কোথাও আবার ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরে নলকূপের পাইপ বসাতে হচ্ছে। বিশেষ করে বৃহৎ পাইলটকাটা খাল ভরাট ও দখল করায় এবং নাব্য না থাকায় তিন-চার বছর ধরে লবণচাষিরা পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে লবণ চাষ করছেন।’

শহীদুল বলেন, ‘গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে ধান ও লবণ চাষের কারণে সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে।’
ধরার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘উজানে বাংলাদেশের বাইরে ও ভেতরে নদীগুলো যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পানিপ্রবাহে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। গত চার দশকে উপকূলে লবণাক্ততার পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ হয়েছে।’

সমাধানে করণীয়
সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কয়েকটি পদক্ষেপের কথাও বলেছেন চবির অধ্যাপক ড. মো. শফীকুল ইসলাম। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেশি পরিমাণে বৃক্ষরোপণ, পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং অপরিকল্পিতভাবে খাল-বিল ভরাট করে নগরায়ণ না করা।

ড. মো. শফীকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত বেশি পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করলে জলবায়ুর ওপর পজিটিভ ইমপ্যাক্ট আসবে। বৃষ্টিপাত বেশি হবে, তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খাল-বিল ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। এতে খাল-বিল ও ফাঁকা জায়গায় সারফেস ওয়াটার বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যাবে। এটা একদিকে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করবে, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ওপরে ওঠাতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, পাহাড় কাটা বন্ধ রাখলে পরিবেশের ওপর পজিটিভ ইমপ্যাক্ট বজায় থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘এ সমস্যাগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। তাহলে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। এটা শুধু কক্সবাজার নয়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর জন্যও প্রযোজ্য।’

বেড়িবাঁধ ও মাছের ঘেরে হুমকির মুখে বাগেরহাটের প্রকৃতি ও পরিবেশ

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১২ পিএম
বেড়িবাঁধ ও মাছের ঘেরে হুমকির মুখে বাগেরহাটের প্রকৃতি ও পরিবেশ
অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ ও মাছের ঘেরের বাঁধের কারণে হুমকির মুখে বাগেরহাট জেলার প্রকৃতি ও পরিবেশ। ছবি: সংগৃহীত

অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ ও মাছের ঘেরের বাঁধের কারণে হুমকির মুখে বাগেরহাট জেলার প্রকৃতি ও পরিবেশ। বেড়িবাঁধ ঠিক রাখার জন্য যে পরিমাণ স্লুইস গেট ও ইনলেট-আউটলেট থাকার কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। এতে নদীর নাব্য হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি বেড়িবাঁধের কারণে জমিতে লবণ জমে উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলার নামে নির্মিত পোল্ডার-বেড়িবাঁধ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন পরিবেশ আন্দোলনকারীরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নূর আলম শেখ খবরের কাগজকে বলেন, ভেড়িবাঁধ দিয়ে ১২ মাস লবণপানি আটকে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে লবণাক্ততাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হচ্ছে। এতে বসতবাড়ি, বাস্তুভিটা, পুকুর, জলাশয়ে লবণাক্ততার বিস্তৃতি ঘটেছে। রেকর্ডসংখ্যক সরকারি খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যা প্রবাহমান থাকার কথা। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে জীবন্ত খালগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে। লবণাক্ততাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া ও বিস্তৃতি ঘটানোর ফলে চাষাবাদ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড পোল্ডার বা স্লুইস গেট বানিয়ে যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করছে তা প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী। উপকূলীয় এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়ে এসব বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়নি। যার ফলে স্বাভাবিক জোয়ার ভাটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রবাহমান খালগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে। লোকায়ত জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে দুর্যোগ মোকাবিলার নামে নির্মিত পোল্ডার/বেড়িবাঁধ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রকৃতি-পরিবেশবিরোধী এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি জানাই।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহ হারুন খবরের কাগজকে বলেন, বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক জায়গা ঘিরে ফেলা হচ্ছে। যে জায়গায় আগে জোয়ার-ভাটা চলত, স্বাভাবিক একটা জীবনযাত্রা ছিল। যখন চারদিক বেড়িবাঁধ দিয়ে আটকে দেওয়া হয় তখন সাময়িকভাবে প্রকৃতিগত যে ব্যবস্থাপনা তা বাধাগ্রস্ত হয়ে নতুন ধরনের একটা অভিযোজন তৈরি হয়। সে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়িবাঁধ ক্ষতির কারণ হয়। বেড়িবাঁধ দিয়ে স্বাভাবিক প্রকৃতি থেকে ওই জায়গাটিকে আলাদা করে ফেলা হয়। ফলে সেখানে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়। আর একটা ক্ষতির কারণ হচ্ছে, জোয়ারের পানির সঙ্গে পলি এসে ভূমি গঠন হয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পলি পড়ে জমির উর্বরতা বাড়ে। বেড়িবাঁধ দেওয়ার ফলে এই উর্বরতা কমে যায়। অন্যদিকে এই পলিটা ওই জায়গায় আসতে না পেরে খালে বা নদীতে জমা হয়ে নদীর নাব্য হ্রাস পায়। বেড়িবাঁধের কারণে পানির সঙ্গে মাছসহ যেসব জলজপ্রাণী জলাভূমিতে আসত, সেগুলোও আসতে পারে না।

বেড়িবাঁধ ঠিক রাখার জন্য যে পরিমাণ স্লুইস গেট এবং যে পরিমাণ ইনলেট-আউটলেট থাকার কথা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো করা হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে যে বেড়িবাঁধগুলো নতুন মেরামত ও তৈরি হচ্ছে, সেগুলো পরিবেশ প্রক্রিয়া যাচাই করে তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

বেড়িবাঁধের কারণে খাল ও নদী ভরাট হওয়ায় জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। পানি ফুলে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। এতে অনেক সময় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একপর্যায়ে চাপ আরও বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জেল-জরিমানায়ও থামছে না পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০২:০৮ পিএম
জেল-জরিমানায়ও থামছে না পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার
আইন, জেল, জরিমানাতেও থামছে না পলিথিন, প্লাস্টিকের ব্যবহার। ছবি: সংগৃহীত

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও দোকানে দোকানে, মানুষের হাতে হাতে, ঘরে ঘরে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। অন্যদিকে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনাসামগ্রী ও বাসাবাড়ির বিভিন্ন সামগ্রী দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ব্যাপ্তিও বাড়ছে। এসব পণ্য শুধু দেশেই ব্যবহার হচ্ছে না, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির পরিধি বাড়াতে বিভিন্ন মেলারও আয়োজন করা হচ্ছে। 

বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক পণ্যের বিরূপ প্রভাব নিয়ন্ত্রণে প্লাস্টিক পণ্যের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পচনশীল দ্রব্যের ব্যবহার প্রচলনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১’ প্রণয়ন করে। সেই লক্ষ্যে সিঙ্গেল ইউজ বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২১ জুন উপকূলীয় অঞ্চলের ১২ জেলার ৪০টি উপজেলাকে কোস্টাল এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব এলাকায় ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

আইন করে দুই যুগ আগে পলিথিনের তৈরি শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও বন্ধ হয়নি যত্রতত্র পলিব্যাগের ব্যবহার। বিভিন্ন সময়ে পলিব্যাগের ব্যবহার বন্ধে অভিযান চললেও কমেনি উৎপাদন ও সরবরাহ। নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে পরিচালিত অভিযানে গত ৫ বছরে ৬ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ১৭০ জনকে, জব্দ করা হয়েছে ২ হাজার টনের বেশি মালামাল। এ ছাড়া ১৬টি নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। 

এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৫১৬টি পরিচালিত অভিযানে ৪ হাজার ২০৭টি মামলায় ৬ কোটি ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ২০১০ সালের জুলাই থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের আওতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে উচ্ছেদ ও মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হচ্ছে। 

দেশে ২০০২ সালে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা অন্য যেকোনো সামগ্রী, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেসব উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, পরিবহন ইত্যাদি নিষিদ্ধ।’

গত ৬ ফেব্রুয়ারি চলতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন চলাকালে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে এসব তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। পরিবেশমন্ত্রী আরও জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর নিজস্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।

এদিকে তুলনামূলক কম দামের হওয়ায় প্লাস্টিকসামগ্রী দিনে দিনে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। একসময়ে কল্পনা মনে হলেও এখন প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য বহনও তুলনামূলক সহজ। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের বিভিন্ন খেলার সামগ্রীও স্থান করে নিয়েছে বাচ্চাদের কাছে। গৃহসামগ্রী হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে প্লাস্টিকের পণ্য। এভাবে প্রতিনিয়ত সব ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. শামিম আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, গৃহসামগ্রী থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল, শিশুদের খেলনার সামগ্রী এমন কোনো খাত নেই যে প্লাস্টিক ব্যবহার হয় না। স্থানীয় বাজারে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। দিনে দিনে এটা সব ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হচ্ছে। কাঁচামালের আমদানির সঙ্গে রিসাইক্লিং করেই এসব পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হয় না। যেগুলো ক্ষতিকর তা হচ্ছে পলিথিনের শপিং ব্যাগ। সরকার তা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পুরান ঢাকার ইসলামবাগে বিভিন্ন ঘরবাড়িতে এসব পণ্য উৎপাদন করে তা বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তারা আমাদের সদস্য না। তাই তাদের ধরা যায় না। 

বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ) জানায়, বর্তমানে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে প্লাস্টিক পণ্যের অবস্থান ১২তম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে প্লাস্টিক রপ্তানি বেড়েছে ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ১২৬টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। 

এ ব্যাপারে বিপিজিএমইএর সভাপতি মো. শামিম আহমেদ বলেন, চাহিদা মিটিয়ে গত অর্থবছরে প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এক দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে। গৃহস্থালি পণ্য, ক্রোকারিজ, প্যাকেজিং উপকরণ, খেলনা, ফার্মাসিউটিক্যালস, আসবাব, মেলামাইন, তৈরি পোশাক উপকরণ, পিপি ওভেন ব্যাগ রয়েছে। দেশের প্লাস্টিক খাত এখনো প্রায় ২০ লাখ টন মূল্যের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এটি এ খাত বিকাশের অন্যতম প্রধান বাধা। তাই এ খাতের বিকাশে সরকারের নীতি সহায়তা দরকার।

লোনা পানিতে ‘সোনা’, নষ্ট হচ্ছে মাটির ভৌত গঠন

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪৮ পিএম
লোনা পানিতে ‘সোনা’, নষ্ট হচ্ছে মাটির ভৌত গঠন
চিংড়ি চাষে নষ্ট হচ্ছে সাতক্ষীরার মাটির ভৌত গঠন। ছবি: সংগৃহীত

লোনা পানিতে সোনা ফলাতে (চিংড়ি ঘের) গিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার মাটির ভৌত গঠন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাটির উর্বরতার পাশাপাশি উৎপাদন ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বছরের পর বছর লোনা পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষের ফলে মাটির এই ক্ষতিকর পরিবর্তনে পরিবেশ ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। 

গত চার দশকে জেলার ৬০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি কমেছে। ফলবান বৃক্ষে ফল ধরছে না। উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। উপকূলীয় পরিবেশ হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। এতে জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। ফসল উৎপাদনও দিন দিন কমছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।

কৃষিবিদরা বলছেন, তিন ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের করছেন চাষিরা। ফলে যেসব জমিতে একসময় প্রচুর ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল ফলত, সেখানে এখন লোনা পানির চিংড়ি ঘের। এসব চিংড়ি ঘের ফসলি জমি গ্রাস করছে। ফলে কমতে শুরু করেছে কৃষিজমি। অন্যদিকে, অবৈধভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ছিদ্র করে লবণ পানি প্রবেশ করাচ্ছেন চিংড়ি ঘের মালিকরা। এতে নদ-নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। আর এসব অপকর্ম প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘটছে। কিন্তু এটা বন্ধ করার ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই বলেও অভিযোগ করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশির দশকে সাতক্ষীরায় প্রচুর ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল ফলত। অথচ গত চার দশকে জেলার ৬০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি লোনা পানির চিংড়ি ঘেরের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা, শ্যামনগর, কালিগঞ্জসহ আশাশুনি, সদর ও তালা উপজেলায় লবণ পানি আটকে রেখে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। এসব উপজেলায় আমন ধান চাষের জন্য অধিকাংশ ঘের মালিক যথাসময়ে পানি নিষ্কাশন করতে দেয় না। এতে মাটিতে লবণাক্ততা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন অণুজীব, জলাবদ্ধ অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে মাটির গঠন হওয়ার জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন তার ঘাটতি দেখা যায়। এ ছাড়া লবণাক্ত মৌলের প্রভাবে মাটির তৈরি হওয়া গঠনও ভেঙে যায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০১ সালে জেলায় চাষযোগ্য কৃষিজমি ছিল ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ হেক্টর; ২০১০-১১ সালে সেটি দাঁড়ায় ১ লাখ ৭০ হাজার ৪১৯ হেক্টরে। ২০২২-২৩ সালে কৃষিজমির পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ২৪৫ হেক্টরে। অর্থাৎ দুই দশকে জেলায় প্রায় সাড়ে আট হাজার হেক্টর কৃষিজমি কমেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের সাতক্ষীরা জেলাসহ আরও কয়েকটি জেলার কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি আনতে স্লুইসগেট ছিদ্র করে বাঁধ দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে এসব এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা।

শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর এলাকার নুর নবী, মুন্সীগঞ্জের বেলাল হোসেনসহ আরও অনেকে জানান, চিংড়ি চাষের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে লবণাক্ত পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়ে পুকুর ও ধানের জমিতে নেওয়া হয়। ফলে তিন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। পানির প্রবাহ না থাকায় মাছসহ জলজপ্রাণী এবং ম্যানগ্রোভ বনের বৃক্ষ অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। দ্বিতীয়ত, লবণাক্ত পানি লোকালয়ের মিঠা পানির পুকুরে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সাধারণ মানুষের জন্য সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। তৃতীয়ত, লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে নেওয়ার ফলে জমি তার উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। যেটা ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা।

সাতক্ষীরার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চেয়ারম্যান জি এম মাকসুদুল আলম জানান, তার ইউনিয়নের চারদিকে শুধুই লবণ পানির চিংড়ি ঘের। দিন দিন তা বাড়ছে। এতে ফসলি জমিও আশঙ্কাজনক হারে কমছে। যে জমিতে একসময় ধান উৎপাদন হতো এখন তাতে লবণ পানির চিংড়ি হয়। ফলে তার ইউনিয়নের কৃষি শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন বলে দাবি করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণ। জৈব পদার্থ কম থাকলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। ফলে হ্রাস পাচ্ছে উৎপাদন। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এলাকার মাটিতে জলজ উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। জৈব পদার্থের ঘাটতির ফলেও ধানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি এমনিতেই লবণাক্ত। তার ওপর লবণ পানি বছরের পর বছর আটকে রাখার ফলে মাটির ভৌত গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। লবণ পানি আটকে রাখা জমিতে দীর্ঘদিন কাঙ্ক্ষিত ফলন হবে না। তবে লবণাক্ত সহনশীল জাতের রোপা আমন ধানের চাষ করতে পারলে একই জমিতে বাগদা ও ধান উৎপাদন সম্ভব হবে। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে ব্রিধান-৪৭ ও বিনা ধান-৮ ও ৯ জাতের লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধান চাষ করতে হবে। এতে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের বন্ধ করতে না পারলে ফসলি জমি নষ্ট হতে থাকবে। জেলার অনেক এলাকায় জমিতে অতিরিক্ত লবণ পানি উত্তোলনের কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো-১) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, চিংড়ি চাষিরা আইন মানছেন না। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ছিদ্র করে ঘেরে পানি তুলছেন। অথচ নদীর বাঁধের ৫০ গজের মধ্যে কোনো চিংড়ি ঘের করার কথা নয়। কিন্তু এ আইন তো মানছেনই না, উপরন্তু নদীর ক্ষতি করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে নদীর তলদেশে থাকা পাইপ অপসারণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ আশেক ইলাহী বলেন, লোনা পানির চিংড়ি ঘের ক্রমান্বয়ে সাতক্ষীরার ফসলি জমি গ্রাস করছে। যেসব জমিতে বছরে তিনটি ফসল ফলত, সেখানে এখন লবণ পানি। তিনি জানান, ১৯৮০ সালের পর থেকে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলার অন্তত ৬০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি চিংড়ি ঘেরে চলে গেছে। এসব চিংড়ি ঘেরের কারণে সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষি শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। অনেকে কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে জেলার বাইরে চলে যাচ্ছেন।

সাতক্ষীরার পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সাকিবুর রহমান বাবলা জানান, নদী শাসন ব্যবস্থাকে অমান্য করে চিংড়ি ঘের মালিকরা ফসলি জমিতে লবণ পানি তুলছেন। এতে জমির শক্তি নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় অহরহ জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে পরিকল্পিত উপায়ে লবণ পানির ঘের করা এবং পানি উত্তোলনের নিয়মনীতি করার জন্য। কেননা, অতিমাত্রার লবণ পানি পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ। দ্রুত এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ফসলি জমিসহ এলাকার গাছপালার ক্ষতি হবে।

রূপ বদলাচ্ছে সুন্দরবন

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩৮ পিএম
রূপ বদলাচ্ছে সুন্দরবন
লবণাক্ততার প্রভাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে সুন্দরী গাছের আধিক্য কমেছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে লবণসহিষ্ণু গরান ও কাঁকড়াজাতীয় গাছ। ছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে যাওয়ায় নোনা পানি প্রবেশ করছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা পলি জমছে নদী-খাল ও বনভূমিতে। লবণাক্ততার প্রভাবে এরই মধ্যে বনের বিভিন্ন অংশে সুন্দরী গাছের আধিক্য কমেছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে লবণসহিষ্ণু গরান ও কাঁকড়াজাতীয় গাছ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রূপ বদলাচ্ছে সুন্দরবন। কয়েক বছরে বনের কাছাকাছি নদী-সমুদ্রে জেগে ওঠা বনভূমিতে জন্ম নেওয়া ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ দ্রুত বেড়ে উঠেছে। তবে মূল বনভূমিতে গাছের সংখ্যা তুলনামূলক বাড়েনি। 

বন কর্মকর্তারা বলছেন, সিডর-আইলার মতো দুর্যোগে বনের যে ক্ষতি হয়েছিল, তা প্রাকৃতিকভাবেই পুষিয়ে নেওয়া গেছে। গাছের আগামরা রোগও আগের তুলনায় কমেছে। বর্তমানে সুন্দরবনে উদ্ভিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই হচ্ছে সুন্দরী, গেওয়া ও গরানগাছ। তবে এসব উদ্ভিদের মধ্যে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা পাঁচ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে লাহুর, বনবকুল, মহাজনি লাতা ও দুই প্রজাতির অর্কিড। 

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে যাওয়ার কিছু তথ্য প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯০৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বনের আয়তন হয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে। 

এদিকে সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের পরিমাণ নির্ণয়ে জরিপ শুরু করেছে বন বিভাগ। বনের ৪ হাজার ১৪২ দশমিক বর্গকিলোমিটারের স্থলভাগে কত প্রজাতির ও কী পরিমাণ গাছপালা রয়েছে তা জানতে এই জরিপ চালানো হচ্ছে। বন বিভাগের তথ্য মতে, ১৯০৩ সালের গবেষণায় সুন্দরবনে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, কাঁকড়া, কেওড়া, ধুন্দল, বাইন, খলসি, আমুর, সিংড়াসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড ছিল। ১৯৮৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে অরণ্য ও গুল্ম প্রজাতির সংখ্যা কমে তা দাঁড়ায় ৬৬ প্রজাতিতে। ১৯৯৭ সালের জরিপে সুন্দরবনে মাত্র ৪৮ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। এরপর ২০১৪-১৫ সালের সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে গাছের প্রজাতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪টিতে। এর মধ্যে ৫৪ প্রজাতির গাছ, ২৮ প্রজাতির লতাপাতা, ১৩ প্রজাতির গাছড়া, ২২ প্রজাতির গুল্ম, ১৩ প্রজাতির ফার্ন, ১২ প্রজাতির অর্কিড, তিন প্রজাতির পরজীবী উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির পাম, ২৮ প্রজাতির ঘাস ও ৯ প্রজাতির ছত্রাক উদ্ভিদ রয়েছে। 

দুর্যোগ কাটিয়ে উঠেছে সুন্দরবন: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয় সুন্দরবনে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাক্ষী হয়ে থাকা আইলা, সিডর, আম্পান, ইয়াশ ক্ষতবিক্ষত করেছে বনকে। 

সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পূরণ হয়নি বলে দাবি করেছেন সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী একদল গবেষক। গবেষক দলের প্রধান ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান। তারা জানান, প্রলয়ংকরী এ ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বড় গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। সিডরের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সেখানে এখনো রয়েছে সিডরের ক্ষত। কটকাতে রয়েছে ভাঙ্গা গাছের শত শত গুঁড়ি। কোনো কোনো গাছকে মুচড়িয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বহু গাছ শিকড়সমেত উপড়ে পড়েছিল। পুরোনো গুঁড়িগুলো সাগরের লবণ পানিতে পচে গেছে।

তবে বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ করে সিডর-আইলার পর সরকারের পরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে বনের উল্লেখযোগ্য অংশে সম্পদ বেড়েছে।

সুন্দরবন বন সংরক্ষক খুলনা অঞ্চল মিহির কুমার দে জানান, দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছে সুন্দরবন। সিডরের তাণ্ডবে বনের অভ্যন্তরে যে অংশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল সেখানে নতুন নতুন গাছ জন্মেছে। তবে নোনাপানির কারণে এখন গরান ও কাঁকড়ার মতো লবণসহিষ্ণু প্রজাতির গাছ বেশি জন্মাচ্ছে। তিনি বলেন, বনের পশ্চিম অংশে গাছের আগামরা রোগের প্রবণতা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে বনের নির্দিষ্ট অংশের বাইরে এই রোগ দেখা যায়নি। তবে কটকা কচিখালিতে তৃণভূমিতে গাছ কিছুটা কমেছে। 

বন্ধ হয়নি গাছ কাটা: সুন্দরবন থেকে প্রতিবছরই কাঠ পাচার হয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে কিছু ব্যবসায়ী, অসাধু বন কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে নির্দ্বিধায় সুন্দরবনে অবৈধভাবে গাছ কাটা হয়ে থাকে। জোয়ারের পানিতে বন ডুবে গেলে নৌকায় বেঁধে কাটা গাছ বের করে আনা হয় বন থেকে। ফলে প্রতিবছর একটু একটু করে কমে যাচ্ছে সুন্দরবনের গাছের পরিমাণ। 

জানা যায়, সুন্দরবন এলাকার মূল্যবান কাঠ পাচারের বিষয়ে শক্তিশালী দুষ্ট চক্র বরাবরই সক্রিয়। সুন্দরবন এলাকার সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কৈখালী, রমজাননগর, মুন্সীগঞ্জ, হরিনগর, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা এবং খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর, ২নং কয়রা মঠবাড়িয়া, বেদকাশি এসব এলাকার কিছু অসাধু মানুষ সুন্দরবনের গাছ কর্তন করে থাকে। 

নির্বিচার বন ধ্বংসের ফলে বাঘ ও হরিণসহ অন্য প্রাণীদের নিরাপদে থাকার জায়গার পরিমাণও কমছে, ফলে অনেক সময় এরা নদী সাঁতরে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। 

তবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় অভয়ারণ্য এলাকা ১ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর থেকে ৩ লাখ ১৭ হাজার হেক্টরে উন্নীত করা হয়েছে। বন্যপ্রাণীর প্রজননকালে বনে সব ধরনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির জন্য পুকুর খনন ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য উঁচু কিল্লা তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’ ও ‘সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে বন বিভাগ।

পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় অভিযোজন কর্মসূচি: ৬ লক্ষ্য

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় অভিযোজন কর্মসূচি: ৬ লক্ষ্য
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় অভিযোজন কর্মসূচি গ্রহণে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। চলমান উন্নয়ন কর্মসূচিকে পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে একীভূতকরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশবান্ধব প্রতিবেশ গড়ে তুলতে বিভিন্ন নীতি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা ও অভিযোজন কর্মসূচি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এর প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে এই কর্মপরিকল্পনায় ৬টি থিমেটিক এরিয়ায় ৪৪টি কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার জন্য এবং অ্যাকশন প্ল্যানের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছিল ২০১০ সালে। এর আওতায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। 

২০২২-২৩ অর্থবছরে (ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত) এ স্কিমের আওতায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থায়নের বিপরীতে মোট ১০টি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া হয। এর মধ্যে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, গ্রিন বিল্ডিং, গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি, ভার্মি কম্পোস্ট, সোলার হোম সিস্টেম, বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট, নেট মনিটরিং রুফটপ সোলার সিস্টেম স্থাপন, জ্বালানি দক্ষ সামগ্রী প্রতিস্থাপন, পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন প্রকল্প স্থাপন ও উন্নয়ন এবং কারখানার কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ উল্লেখযোগ্য। 

পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জসমূহকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬, জাতীয় পরিবেশনীতি ২০১৮, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া, ওজোন স্তর রক্ষা এবং পরিবেশকে সার্বিকভাবে দূষণমুক্ত রাখার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা তথ্যসূত্র অনুসারে, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (ন্যাপ) আওতায় ২০২৩-২০৫০ প্রণয়ন করা হয়। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০২৩-২০৫০-এর ভিশন হচ্ছে- বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে সহায়ক শক্তিশালী সমাজ গড়ে তোলার পাশাপাশি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সক্ষম কার্যকর অভিযোজন নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি জলবায়ু-সহিষ্ণু জাতি গঠন। এ ভিশন বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় ৬টি অভিযোজন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে:

১. জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে সুরক্ষা নিশ্চিত করা; 
২. খাদ্য, পুষ্টি এবং জীবনযাত্রার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষির উন্নয়ন;
৩. নগরের প্রতিবেশ উন্নয়ন এবং সার্বিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে জলবায়ু-সহিষ্ণু নগর গড়ে তোলা।
৪. বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে প্রকৃতিনির্ভর সমাধানসমূহ উৎসাহিত করা।
৫. পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জলবায়ু অভিযোজন সন্নিবেশ করার মাধ্যমে সুশাসন জোরদার করা।
৬. জলবায়ু অভিযোজনে সহায়ক রূপান্তরক্ষম সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিশ্চিত করা।

জলবায়ু সংকটাপূর্ণ এলাকায় ২৩টি অভিযোজন কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বাস্তবায়নের জন্যে প্রাথমিকভাবে মোট ১১৩টি অভিযোজন পদক্ষেপ চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশে অভিযোজনমূলক এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে মূল দলিল হিসেবে কাজ করবে ন্যাপ।