তাপমাত্রা বাড়ায় দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ঢাকার বাতাস। এই গরম বাতাসে ক্ষুদ্র বিষাক্ত কণা (পিএম ২.৫) এর পরিমাণও বাড়ছে। চলতি এপ্রিল মাসের কোনো কোনো দিন সেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহনীয় মাত্রার ২০ গুণ বেশিতে গিয়ে ঠেকছে। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এই ক্ষুদ্র কণা সহজেই প্রবেশ করে নানা রোগের সৃষ্টি করছে। তাই বায়ুদূষণের চিহ্নিত উৎসগুলো বন্ধ করার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ঢাকার বায়ুর মান প্রতিবছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় খারাপ হচ্ছে। নির্মাণবিধি না মেনে কাজ করা, সেবাদানকারী সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বর্জ্য পোড়ানো, ইটের ভাটা, যানবাহন থেকে দূষণ- এসবের প্রতিটির উৎস ধরে ধরে বন্ধ করার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (আইকিউএয়ার) অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। শহর হিসেবে রাজধানী ঢাকা ছিল দূষণে দ্বিতীয়। আর ঢাকায় বায়ুদূষণের মূল কারণ বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। গত বছরে (২০২৩) যার গড় ছিল প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। মাস হিসাবে জানুয়ারিতে ছিল সর্বোচ্চ ১৭৫ দশমিক ৫। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১০৭ মাইক্রোগ্রাম, মার্চে ৮২.৫ মাইক্রোগ্রাম, এপ্রিলে ৬১.৬ মাইক্রোগ্রাম, মে মাসে ৪৯.২ মাইক্রোগ্রাম, জুন মাসে ৪২.৭ মাইক্রোগ্রাম, জুলাইয়ে ২৩.৬ মাইক্রোগ্রাম, আগস্টে ৪৪.৮ মাইক্রোগ্রাম, সেপ্টেম্বরে ৩৯ মাইক্রোগ্রাম, অক্টোবরে ৭৪.৯ মাইক্রোগ্রাম, নভেম্বরে ১০১.৬ এবং ডিসেম্বরে ছিল ১৬০.৩ মাইক্রোগ্রাম।
ঢাকায় চলতি বছরের ৮ এপ্রিল থেকে এই ক্ষুদ্র কণার পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। ওই দিন পরিমাণ ছিল ৭০.৮ মাইক্রোগ্রাম। তবে ১০ এপ্রিল ছিল সর্বোচ্চ ১১৩.৫ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এর নিরাপদ মাত্রা হচ্ছে ৫ মাইক্রোগ্রাম। আইকিউএয়ার এর আশঙ্কা, ২০২৪ সালে বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আর্থিক ক্ষতি হতে পারে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
ঢাকায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) বেগম শাহনাজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান হচ্ছে যেটার খসড়া রেডি হয়েছে। এটা শিগগিরই চূড়ান্ত হবে। সেই অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাস্টটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট) প্রজেক্ট’ শুরু হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে বায়ুদূষণ কমে আসবে।
তবে প্রকল্পের পাশাপাশি সমন্বয়ও জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় বলা হয়েছে কোন দূষণ কারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেখানে ২৮ কর্তৃপক্ষের কথা বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় করা জরুরি। যারা বায়ুদূষণে জড়িত এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।
তাপমাত্রা সহনীয় রাখতে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড প্রজেক্ট’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এটিকে সহনীয় রাখতে গবেষণা করা হচ্ছে জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন) মির্জা শওকত আলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘কার্বন নিঃসরণ বেশি করলে তাপমাত্রা বেশি বেড়ে যায়। বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তার মাত্র .৪৮ ভাগ করে বাংলাদেশ। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ার পেছনে আমরা দায়ী না হলেও বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। ফলে তাপমাত্রাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশন (এনডিসি) বা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানে যে ডকুমেন্ট প্রদান করেছি সেখানে আমরা কীভাবে কি করব তা উল্লেখ করেছি। বিশ্বের সবাই যদি একসঙ্গে কাজ না করে তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে না। স্পেসিফিক সেক্টর টার্গেট করেছি। আমাদের একটা প্রকল্প আছে আরবান হিট আইল্যান্ড প্রজেক্ট। গ্রামের চেয়ে শহরে তাপ বেশি। এটা নিয়ে স্টাডি হচ্ছে। শেষে কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে তাপ সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পারব তা বের করব। ২০২৫ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।