মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ তীব্র হওয়ার পর গত প্রায় মাস ছয়েক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনাই নেই। এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ব্যস্ত ঢাকা-নেপিদো। সর্বশেষ আরও ২৮৮ বিজিপি-সেনাসদস্যকে সমুদ্রপথে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।
মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ তীব্র হওয়ার পর অন্তত ৩৩০ জন বিজিপি ও সেনাসদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। দুই দেশের মধ্যে অনেক আলোচনার পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই ৩৩০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। তারপর নিয়মিত বিদ্রোহীদের ধাওয়া খেয়ে মায়ানমার থেকে পালিয়ে এ দেশে আশ্রয় নিচ্ছেন দেশটির বিজিপি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ১৫ ফেব্রুয়ারির পর প্রায় নিয়মিত অল্প সংখ্যায় আবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন বিজিপি-সেনারা। আবারও দীর্ঘ আলোচনার পর সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল নতুন করে ২৮৮ জনকে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ। বিনিময়ে মায়ানমারের কারাগারে থাকা ১৭৩ বাংলাদেশিও ফিরেছেন।
বিজিপি-সেনা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মায়ানমার ও বাংলাদেশের নাগরিকদের ফেরতের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একাধিক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে দুই দেশের নাগরিকদের প্রত্যাবাসন করা হয়। বাংলাদেশে অবস্থিত মায়ানমারের দূতাবাস ও ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবসহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এই কার্যক্রম চলে।
মায়ানমারও সে দেশের কারাগারে সাজা খাটা বাংলাদেশিদের সাধারণ ক্ষমা করেছে। প্রথমে দেশটি কারাভোগ শেষ করেছেন অথবা সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন এমন ১৪৪ জন যাচাইকৃত বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ তৎপরতায় মায়ানমারে কারাভোগ শেষ করা, কারাভোগরত এবং বিচারাধীন সবার নাগরিকত্ব যাচাই শেষে ফেরত পাঠাতে দেশটির কর্তৃপক্ষ রাজি হয়। ফলে তারা আরও ২৯ বাংলাদেশি নাগরিককে মুক্তি দেয়। ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাসের যোগাযোগ এবং আরাকানের সিট্যুয়েতে বাংলাদেশ কনসুলেটের প্রতিনিধি মায়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে সমন্বয় করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সেনা প্রত্যাবাসন নিয়ে ব্যাপক ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের। তাই এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। উপরন্তু আগে থেকে ঠিক হওয়া কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনও আটকে আছে এই অবস্থার কারণে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘সেখানে তো যুদ্ধ। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়া হবে অমানবিক। যুদ্ধের মধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনা করাই অমানবিক একটা ব্যাপার। যে কারণে তারা দেশ ছেড়ে এ দেশে এসেছে এখন সেখানে তার চেয়েও খারাপ অবস্থা।’
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ঢাকা
তবে মায়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা ‘থেমে গেলেও’ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে ঢাকা। জানুয়ারিতে ভারত সফরে গিয়ে ভারতের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসান নিয়ে আলোচনা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর থাইল্যান্ড সফরকালেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেশটির সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তা চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ ছাড়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মায়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলো হলো জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মায়ানমারের পরিস্থিতি কখনোই ভালো ছিল না। পরিস্থিতি কখনো ভারৈা হয়, কখনো খারাপ হয়। সুতরাং এখনকার পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হবে না। প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’
পুনরায় রোহিঙ্গা ও সেনা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা ঢাকার
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, আগামী মে মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মায়ানমার অংশে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে মায়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা বাড়তে পারে। এ ছাড়া মায়ানমারের বিজিপি সদস্যদের অনুপ্রবেশের ঘটনাও বাড়তে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের ওই প্রতিবেদনে কয়েকটি ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে মায়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা/মগ) অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অরক্ষিত স্থল ও জল সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের রেশনের অবৈধ পাচার রোধ করা ইত্যাদি।