বৈরী আবহাওয়া : উভয় সংকটে দেশের কৃষি । খবরের কাগজ
ঢাকা ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, রোববার, ১৯ মে ২০২৪

বৈরী আবহাওয়া : উভয় সংকটে দেশের কৃষি

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫৭ পিএম
বৈরী আবহাওয়া : উভয় সংকটে দেশের কৃষি
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। মানুষ হাঁসফাঁস করছেন গরমে। সবাই অপেক্ষায় আছেন মেঘ-বৃষ্টির। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির আশায় বিশেষ নামাজ-প্রার্থনা করা হচ্ছে। ঠিক এমন সময় সরকারের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির বললেন, ‘দোয়া করেন যেন এই মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি না হয়।’ শুধুই কী মহাপরিচালক! দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরাও আতঙ্কে আছেন না জানি কখন শুরু হয়ে যায় ঝড়-বৃষ্টি। যদি এমনটি হয়েই যায়, তবে তাদের সর্বনাশ হবে!

কৃষকদের এই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস। সোমবারই (৩০ এপ্রিল) ওই অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহজুড়ে থাকবে টানা বৃষ্টি। এমনকি কালবৈশাখীর আশঙ্কাও রয়েছে।

এমন তাপপ্রবাহের মধ্যেও কেন বৃষ্টি চাচ্ছেন না- এই প্রশ্নের মুখে ড. মো. শাহজাহান কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই তাপপ্রবাহ এবং রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া মানুষের জন্য কষ্টকর হলেও কৃষির জন্য, বিশেষ করে বোরো ফসলের জন্য খুবই উপকারী। পোকামাকড়ের উৎপাত নেই বললেই চলে। ধানও বেশ ফ্রেশ। হারভেস্টিং চমৎকার। সিস্টেম লস কম হয়। এক কথায় উৎপাদন বেশ ভালো হবে। এমন সময় ঝড়-বৃষ্টি হলে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে। এটি কৃষকরাও চান না, যারা চাষাবাদে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত, তারাও কেউই চাইবেন না। আমরা তো ফসলের ক্ষতি বা কৃষকের ক্ষতি কোনোটিই চাইব না।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসনিন জাহান খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমত এত উচ্চ তাপমাত্রা যেমন মানুষের জন্য ভালো না, তেমনি কৃষি ফসলের জন্যও ভালো না। সবকিছুরই একটি সহনশীলতার মাত্রা আছে। একেক ফসলের জন্য তাপমাত্রারও ভিন্নতা প্রয়োজন আছে। এক কথায়, বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশের বাস্তবতায় আমাদের এখানে একই মৌসুমে রোদও দরকার, বৃষ্টিও দরকার। আবার দুটিই ভালো, দুটিই খারাপ। আমাদের দেশে ধান উৎপাদনে আগে কেবল বোরোতে সেচের দরকার হতো। আমনে তেমন সেচ দরকার হতো না। এখন কিন্তু আমনেও সেচের দরকার হয়। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের মুখে আমাদের দেশে শুকনো মৌসুম বেশি থাকছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।’

কৃষি অর্থনীতির ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অন্যদিকে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ধান কাটার সময় ঝড়-বৃষ্টি হলে কৃষকের আরও ক্ষতি হয়। ধান নষ্ট হয়, ধান শুকাতে সমস্যা হয়। ভালোভাবে ধান শুকায় না। ফলে মানের সংকট দেখা দেয়। দাম কমে যায়। সেদিক বিবেচনায় এবার এখন পর্যন্ত ধান সংগ্রহ বেশ ভালো। বৃষ্টি-কাদা নেই। ধান শুকানোর মান ভালো হচ্ছে। তবু অনেক জায়গা থেকে শুনতে পাচ্ছি কৃষকদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। এটি হয় মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। নয়তো যেখানে চালের দাম বেশি, সেখানে কৃষকরা কেন ধানে উপযুক্ত দাম পাবেন না? এটি দেখা দরকার। কৃষকরা যেহেতু ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না, তাই তারা দামের দিক থেকে নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট (সিএসএডব্লিউএম) প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার খবরের কাগজকে বলেন, এলাকাভিত্তিক ফসল উৎপাদনের ভিন্নতা রয়েছে। ফলে আবহাওয়ার প্রভাবেও ভিন্নতা থাকবে। যেমন নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চলে বোরোর চাষ। আবার এপ্রিলেই ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ দেশের এক প্রান্তে হয়তো নভেম্বর-ডিসেম্বরে চাষ শুরু হয় আবার আরেক প্রান্তে চাষ শুরু হয় ফেব্রুয়ারি-মার্চে। এখন যেমন হাওরে ও দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গায় ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে আবার উত্তরের এলাকায় ধানে সবেমাত্র ফুল ধরেছে। উত্তরে তাই এখন পানি দরকার, বৃষ্টি দরকার। আবার হাওর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি হলে বিপদ হবে।

খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বলেন, কৃষি ফসলেরও বৈচিত্র্য আছে। যেমন ধানের জন্য এখন বৃষ্টি ক্ষতি বয়ে আনতে পারে, অন্যদিকে সবজির জন্য বৃষ্টিটা জরুরি। এসব দিক বিবেচনায় কোন এলাকায় কী ফসল হচ্ছে, সেই অনুসারে চাষিরা কোথাও বৃষ্টির আশা করছেন আবার কোথাও বৃষ্টি নিয়ে আতঙ্কে আছেন। পুরো প্রক্রিয়াটা অনেকটা স্বাভাবিকই মনে হয়। যদিও কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশব্যাপী বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৪০৩ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বোরোর হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের ধান এই জমিতে চাষাবাদ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে বলে ওই সূত্র জানায়। গড় হিসাবে হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৪২ মেট্রিক টন। সে হিসাবে এবার বোরোর মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন চালের। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের ধান থেকে ৭১ লাখ ৯১ হাজার ৩ টন চাল, উফশী জাতের ধান থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৫ টন চাল ও স্থানীয় জাতের ২৯ হাজার ৮৬৬ টন চাল পাওয়া যাবে।

এদিকে সম্ভাব্য ভারী বৃষ্টিপাতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষায় হাওরাঞ্চলে ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলে বোরো ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ পরামর্শ দিয়েছে ওই অধিদপ্তর।

এতে বলা হয়, আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৩ মে থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব হাওরাঞ্চলের (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা) অনেক জায়গায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এমন অবস্থায় হাওরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দণ্ডায়মান ফসল রক্ষার জন্য পরামর্শ দেওয়া হলো।

পরামর্শগুলোর মধ্যে রয়েছে বোরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হয়ে গেলে দ্রুত সংগ্রহ করা, দ্রুত পরিপক্ব সবজি সংগ্রহ করা, নিষ্কাশন নালা পরিষ্কার রাখা, জমির আইল উঁচু করা, সেচ, সার ও বালাইনাশক দেওয়া থেকে বিরত থাকা, বৃষ্টিপাতের পর বালাইনাশক প্রয়োগ করা, কলা ও অন্যান্য উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল এবং সবজির জন্য খুঁটির ব্যবস্থা করা।

মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের বরকাপন, বানেশ্রী, রায়পুর, রসুলপুর, জুমাপুর, কাদিপুর, অন্তেহরি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তীব্র তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করেই মাঠে ধান কাটছেন কৃষকরা। তবু বজ্রসহ বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি চান না কৃষকরা।

কাদিপুর গ্রামের বোরো চাষি নিবারণ নমশূদ্র বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় এখনো পর্যন্ত ভালো ফলনের আশা আছে। এমন অবস্থায় বজ্রসহ বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি হলে আমাদের খুবই ক্ষতি হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় বোরো ধান আবাদ হয়েছে ৬১ হাজার ৯৫ হেক্টর। ব্রি ধান-৮৮, ৮৯ ও ৯২ জাতের ধান বেশি চাষ হয়েছে। সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত কাউয়াদীঘি হাওর। এখানকার নিচু অংশে ৬০ শতাংশ ও ওপরের অংশে ২০ শতাংশ বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। পুরোদমে ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হতে আরও ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আদাদিপুর গ্রামের কৃষক মনোয়ার হোসেন জানান, জমির ধান পেকে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। এ মুহূর্তে বৃষ্টি এলে কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ধানের জমি ডুবে যাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা দেবে।
অন্যদিকে নবাবগঞ্জ ফল চাষি সমবায় সমিতির সভাপতি জিল্লুর রহমান জানান, টানা তাপপ্রবাহের কারণে আম-লিচুর জমিতে প্রচুর পানি প্রয়োজন। বৃষ্টি না হওয়ায় আম-লিচু ঝরে পড়ছে। অতিরিক্ত খরচ করে বাগানে সেচ দিতে হচ্ছে।

খুলনার উপকূলীয় দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় এ বছর প্রায় ১২ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। তরমুজের ২০-২৫ শতাংশ এখনো মাঠে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এসব তরমুজ পরিপক্ব হলে বিক্রি করা যাবে। এ কারণে তরমুজ চাষিরা অন্তত আরও ১০ দিন বৃষ্টি চান না। বটিয়াঘাটার সুকদাড়া গ্রামের তরমুজ চাষি তিমির বিশ্বাস জানান, গত দুই-তিন বছর পর এবার তরমুজের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই তাদের খেতের তরমুজ বিক্রি করেছেন। তবে বিভিন্ন স্থানে ২০-২৫ শতাংশ তরমুজ এখনো মাঠে রয়ে গেছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ অসহনীয় হলেও এসব চাষি আরও ১০ দিন বৃষ্টি চান না। বৃষ্টি হলে শেষ সময়ে খেতের সব তরমুজ নষ্ট হয়ে যাবে। তখন ক্ষতি হবে চাষিদের।

এবার খুলনা জেলায় ৬৪ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। এখনো ৫৫ শতাংশ ধান মাঠে রয়েছে। পরিপক্ব না হওয়ায় এই ধান কাটতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। এর মধ্যে বৃষ্টি হলে ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষক।

দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ে দীর্ঘদিন থেকে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে ব্যাহত হচ্ছে ফসলের চাষাবাদ। সেচের ব্যবস্থা করেও তেমন ফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষকরা। এ জেলায় প্রতিবছর এ সময়ে বিপুল পরিমাণে বোরো ধান, মরিচ, ভুট্টা, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়। এই ফসল করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন এখানকার সাধারণ কৃষকরা। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে এবার মাথায় হাত পড়ছে তাদের।

তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের নাওয়াপাড়া এলাকার চাষি হবিবর রহমান বলেন, ‘আমি কৃষি করে চলি। এক বিঘার মতো মরিচ চাষ করেছি। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় গাছ থেকে মরিচ ঝরে পড়ে যাচ্ছে। সেচ দিলেও আবার শুকিয়ে যাচ্ছে খেত। এই সময়ে যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে আমাদের মরিচ খেত ভালো থাকবে এবং কিছুটা হলেও আমরা ফলন পাব।’

তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নের পাঠানপাড়া এলাকার চাষি সফিউল ইসলাম সৈকত। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির অভাবে আমার বোরো খেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মোটরের মাধ্যমে সেচ দিলেও পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এ সময় প্রচুর পরিমাণে পানি প্রয়োজন। কিন্তু পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধানখেত। অনাবৃষ্টির কারণে আমাদের সব ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।’

দৌলতপাড়া এলাকার ভুট্টা চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর ভুট্টাখেত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির অভাবে ভুট্টার দানা তেমন বড় হচ্ছে না। এই মুহূর্তে বৃষ্টি হলে আমরা অনেক উপকৃত হতাম। কারণ সেচ যেভাবে দিতে হচ্ছে, এতে আমাদের অনেক খরচ হচ্ছে।’

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর এলাকার ধান চাষি মিজানুর রহমান বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ দিন আগে বৃষ্টি হলে চাষিরা খুবই উপকৃত হতেন। কারণ তখন ধানে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিং এবং পাম্পে সিরিয়াল না পাওয়ার কারণে ভালোভাবে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে ধানের গাছ অনেক মরে গেছে। সেচে অনেক খরচেরও বিষয় আছে। ওই সময় বৃষ্টির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমানে ধান কাটা ও শুকানোর কাজ চলছে। তাই এখন বৃষ্টিপাত হলে কৃষকদের ভোগান্তি বাড়বে। ধান কাটা ও শুকানোর ক্ষেত্রে খরচও বেড়ে যাবে।’

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোছা. উম্মে ছালমা বলেন, টানা তীব্র খরার কবলে পড়েছে এই অঞ্চলের কৃষি। আমের গুটি ঝরে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। একই কারণে ফসলি জমিতে থাকা ধান, ভুট্টা ও পাটের খেত পুড়ে গেছে। বর্তমানে ধান কেটে ঘরে ওঠানোর কাজ চলছে। বৃষ্টি না হওয়ায় ধান চাষিদের উপকার হচ্ছে। কিন্তু আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করা যাচ্ছে না। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আম চাষিদের গাছের গোড়ায় বেশি বেশি সেচ দিতে হবে। পাশাপাশি গাছে পানি স্প্রে করতে হবে।

আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ তাপস চন্দ্র আচার্য বলেন, গত সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সারা দিন তীব্র তাপমাত্রা অনুভূত হলেও রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় ২৮ ডিগ্রিতে। তখন বাতাসের আর্দ্রতাও কমে যাওয়ায় রাতে ঘন কুয়াশাসহ শীত অনুভূত হচ্ছে।

লবণের বাম্পার উৎপাদন: এ বছর এখন পর্যন্ত একটানা কড়া রোদের সুবাদে দেশে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। লবণশিল্পের পৃষ্ঠপোষক সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দেওয়া তথ্য অনুসারে চলতি লবণ মৌসুমে (২৮ এপ্রিল পর্যন্ত) ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে, যা বিগত বছরের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এখনো লবণ উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে।

এর আগে গত বছর (২০২২-২৩ অর্থবছর) ৬২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছিল। সে সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ টন।

এই প্রতিবেদনের তথ্য সহায়তা দিয়েছেন খবরের কাগজের রাজশাহী ব্যুরো ও ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত : ভারসাম্য রক্ষাই বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত : ভারসাম্য রক্ষাই বড় চ্যালেঞ্জ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চায় ভারত। চীনও তাই চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায়, চীনের বেল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে নয় (জিডিআই), তার ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) ও কোয়াডে যোগ দিক বাংলাদেশ। বেইজিংয়ের চাওয়া, ঢাকা তার সঙ্গে থাকুক। এ ছাড়া কিছু ইস্যুতে আবার ২-১-এ বিভক্ত এই তিন পরাশক্তি। এ অবস্থায় এই বৃহৎ তিন শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাই এখন বাংলাদেশের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।

ভারত ও প্রশান্তমহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট। আবার যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে সরাসরি উপস্থিতি চীন ও ভারত চায় না। এই একটি ইস্যু ছাড়া ভারত-চীনের মধ্যে আর কোনো ঐকমত্য নেই। যদিও এই অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র লড়াইয়ে ভারতের স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র ইস্যুতে আবার দেশ দুটির মতবিরোধ রয়েছে।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাকে, সেটি এক রকম রাখঢাক ছাড়াই সম্প্রতি খোলাসা করেছেন ওয়াশিংটনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ঢাকা সফরকালে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড লু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অলোচনায় মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান প্রসঙ্গ থাকে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গও থাকে। 

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারত মহাসাগরে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু তফাৎ থাকা সম্ভব। কারণ ভারত মহাসাগরে ভারত চাইবে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের অ্যালাইন হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক সেটা না-ও চাইতে পারে। আর কোয়াড তো পুরোপুরিই একটি চীনবিরোধী জোট।’ 

তিস্তা প্রকল্প নিয়ে নয়াদিল্লি-বেইজিং দ্বৈরথ

ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় বাংলাদেশ চাইছে উত্তরাঞ্চলের বিশাল অংশের মরূকরণ ঠেকাতে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো বর্ষার পানি ধরে রেখে সারা বছর সেচকাজ করা। যেহেতু ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তির সুরাহা হচ্ছিল না, তাই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে এগিয়ে আসে চীন। 

চীন ইতোমধ্যে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। বেইজিংয়ের অভিযোগ, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর থেকেই ঢাকা তার মনোভাব বদলাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তখন ক্ষোভও প্রকাশ করেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি একরকম হুমকি দিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন এই বলে যে, ভূরাজনীতির দোহাই দিয়ে বা তৃতীয় কোনো দেশের চাপে যদি বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্প থেকে সরে আসে তা হলে তা ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

তারপর থেকেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে এক ধরনের নীরবতাই দেখাচ্ছিল ঢাকা। চীন আশা করে আছে, তারা চুক্তিটি বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সম্প্রতি চীনের জন্য একটি হতাশাজনক ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ঢাকায় এসে তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাব দেন। এর পরপরই ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথম প্রতিবেদনটি ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের ঠিক আগে, অন্যটি সফরের পরে। 

প্রথম প্রতিবেদনের শিরোনাম-‘কার কোর্টে যাবে বল? তিস্তা ঘিরে বাংলাদেশের প্রজেক্ট প্রাপ্তির দৌড়ে ভারত-চীন, টক্কর জোরদার।’ এরপর ঢাকা-দিল্লি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পত্রিকাটি ‘তিস্তা প্রজেক্টে আগ্রহী ভারত, লোলুপ দৃষ্টি চীনের! তারই মাঝে দিল্লি-ঢাকা বৈঠক, কী উঠে এল?’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে চীনের প্রস্তাবের কী হবে এমন প্রশ্ন করা হলে কৌশলী জবাব দিয়ে বলেন, ‘বৈঠকে ভারতের প্রস্তাব নিয়ে কথা হয়েছে। অন্য কোনো বিষয় নয়।’ 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। কিন্তু এখানে চীনের সঙ্গে ভারত বা অন্য যেকেউ তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। আসল বিষয় হলো তিস্তা প্রকল্পটি হওয়া দরকার।’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন ও ভারতের মুখোমুখি অবস্থান বেশ আগে থেকেই। চীন আশা করেছিল নির্বাচনের পরে তিস্তার প্রকল্পের কাজ শুরু করবে। সেটা এখনো হয়নি।’

চীনের বিআরআই-জিডিআইয়ের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড-আইপিএস

চীন বিশ্বব্যাপী দুটি উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে-বিআরআই ও জিডিআই। চীন তার বাণিজ্য সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বিআরআই উদ্যোগ শুরু করেছে। ওই উদ্যোগের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করছে দেশটি। আর জিডিআই হলো চীনের আরেকটি উদ্যোগ যেটি করোনার পরে নেওয়া হয়। জিডিআইতে চীন অন্য দেশগুলোর উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা ও তা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সহযোগিতার সুযোগকে স্বীকৃতি দেয়। 

শতাধিক দেশ ও সংস্থা এরই মধ্যে চীনের জিডিআই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। চীন চায় বাংলাদেশও জিডিআইতে যোগ দিক। এ জন্য গত বছরের মাঝামাঝিতে চীনের ভাইস মিনিস্টার সান ওয়াইডং ঢাকায় আসেন এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে প্রস্তাবও দেন। বৈঠক শেষে ড. মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনারা এ-সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র দিয়ে গেছেন। আমরা বলেছি এগুলো আগে আমরা পড়ি। তারপর তোমাদের সঙ্গে কথা বলব।’

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ আইপিএসে যোগ দিক। আইপিএস হলো যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তাবিষয়ক কৌশল। আরেকটি হলো কোয়াড। কোয়াড অর্থ চতুর্ভুজ এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান এই জোটের সদস্য। কোয়াডকে এশিয়ার ন্যাটো বলা হয় এবং এতে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। 

এমন অবস্থায় চীন রীতিমতো হুমকি দিয়ে ঢাকাকে বলেছিল, কোয়াডে যোগ দিলে ভালো হবে না। তখন ঢাকাও কোয়াডে যোগ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বেইজংকে ‘প্রকাশ্যে এভাবে কথা না বলে জেনে নিতে পারত’ বলে এক ধরনের ভর্ৎসনাও করে। 

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশ কখনোই বলেনি যে তারা কোয়াডে যোগদান করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল আমরা যেন যোগদান করি। সেখানে চীন তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিল যে, যদি বাংলাদেশ কোয়াডে যোগদান করে তাহলে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে তাদের এভাবে বলা উচিত হয়েছে কি না সেটা একটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বক্তব্যের ব্যাপারে তো দ্বিমত করার সুযোগ নেই।’

বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বরাবরই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ভারতকে দিয়ে তার নীতি বাস্তবায়ন করে। এই অঞ্চলকে তারা ভারতের চোখে দেখে। তবে এবার মনে হয় পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই অঞ্চলে সম্পৃক্ত হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। 

সম্প্রতি দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে এসে বলেন, ভারতের চোখ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেখে না। এর আগে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক ও আইপিএস অফিসার মাক্সওয়েল মার্টিনও একই কথা বলেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইতে পারে যে প্যাসিফিকের মতোই ভারত মহাসাগর যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কাজেই তারাও এখানে তাদের খুব শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে চাইতে পারে, যেটা ভারত সম্ভবত পছন্দ করবে না। এই হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত তো আছেই, তার সঙ্গে আরও মিত্র খুঁজছে এখানে এবং সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা। কারণ ভারত মহাসাগরের এই অংশে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো বড় দেশ নেই।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই স্বীকার করবে না যে তারা ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখে। আর ভারতও কখনো স্বীকার করবে না যে সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে। এগুলো অন্তরালের সমঝোতা। তবে এই সমঝোতার বাইরে গিয়ে আমরা দেখলাম বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।’

দাম বাড়বে শতাধিক পণ্যের

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০১:৫০ পিএম
দাম বাড়বে শতাধিক পণ্যের
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

প্রস্তাবিত বাজেটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে শতাধিক পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি কমানো ও প্রত্যাহার এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘোষণার পরই এসব পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

দাতা সংস্থার চাপে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতিবারের চেয়ে আগামী অর্থবছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ভ্যাট আদায় করতে হবে এনবিআরকে।

বাড়তি ভ্যাট আদায় করতে গিয়ে এনবিআরকে অনেক পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়াতে হচ্ছে। ভ্যাটের হার বাড়ানোর জন্য নতুনভাবে ভ্যাট আরোপ করতে হচ্ছে, ভ্যাট অব্যাহতি বা প্রত্যাহার ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হচ্ছে। কোন কোন পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি ও প্রত্যাহার এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে তার চূড়ান্ত তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এরই মধ্যে এ তালিকায় সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে এমন অনেক পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় সাবান, শ্যাম্পু, অনেক গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) থাকার কথাও সূত্র জানিয়েছে। 

ওষুধের অনেক কাঁচামালও রাখা হয়েছে এ তালিকায়। এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদন করলে তার খরচ বাড়বে। ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও ওই সব ওষুধ আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হবে। অন্যদিকে শিল্পে ব্যবহৃত অনেক রাসায়নিকও আছে এখানে। মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়ানো হচ্ছে। লিফট, মোবাইল ফোনসেট ও বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি, আমদানি করা মোটরসাইকেল, আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেট, বিদেশি বিস্কুট, চকলেট, আমদানি করা জুয়েলারি ও প্রসাধনীরও দাম বাড়ানো হচ্ছে। 

বাজেট প্রস্তাব ঘোষণার পরই এসব পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বেড়ে যাবে। আর এতে পণ্য কিনতে হলে বেশি দাম দিতে হবে। 

প্রযুক্তি খাতে ভ্যাট অব্যাহতি কমানো ও প্রত্যাহারে কাজ করছে এনবিআর। এর মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে ভ্যাট অব্যাহতি কমাতে হিসাব চলছে। আর এতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের খরচ বাড়বে। দেশি মোবাইল হ্যান্ডসেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড ও এ জাতীয় পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

বাড়তি ভ্যাট আদায় করতে হলে এনবিআরকে অবশ্যই বিভিন্ন খাতে ভ্যাটের হার বাড়াতে হবে এমন মত জানিয়ে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট যোগ করে পণ্যের দাম হিসেবে আদায় করা হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ না জেনেই তা পণ্যের দাম হিসেবে পরিশোধ করে থাকে। ভ্যাট রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে নিরাপদ হাতিয়ার। রাজস্ব আদায়ে চাপ থাকলেই এনবিআর সহজ পথ হিসেবে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে আদায় করে।’

অর্থনীতির এ বিশ্লেষক বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়াতে হলে পণ্য মূল্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়াতে হবে। ভ্যাটের হার বাড়াতে হলে নতুনভাবে ভ্যাট আরোপ করতে হবে। আবার ভ্যাট অব্যাহতি কমালে, প্রত্যাহার করলে এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপ করলেও ভ্যাটের হার বাড়বে। যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়ানো হবে তার দাম বেড়ে যাবে। তাই আগামী অর্থবছরে ভ্যাট আদায় বাড়াতে গিয়ে এনবিআর পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।’

একই মত জানিয়ে সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরি একটি সাবান উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি ১০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হলো, তবে ৫০ টাকার সাবানের দাম ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকা হবে। এই সাবানটি ধনী-দরিদ্র সবাইকে একই দাম দিয়ে কিনতে হবে। ধনী ব্যক্তির জন্য বাড়তি দাম দিতে কষ্ট না হলেও একজন দরিদ্র ব্যক্তির জন্য তা যথেষ্ট ভোগান্তির। তাই ভ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো হবে। এমনিতেই এখন জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়ানো হলে তাদের ওপর খরচের চাপ আরও বাড়বে।’

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনিবআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইএমএফের পরামর্শ মানতে গিয়ে শতাধিক পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি, প্রত্যাহার ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হচ্ছে। ভ্যাটের আদায় বাড়ানোর জন্য এনবিআরও তা মেনে নিয়েছে। এতে এসব পণ্য উৎপাদন এবং আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত দাম বেড়ে যাবে। অন্যদিকে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এতেও দাম বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দাম বাড়া ঠেকাতে অন্য কোনো সুবিধা দিয়ে উৎপাদন ও আমদানি খরচ কমানো যায় কি না, তা নিয়ে হিসাব করা হচ্ছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী করা যায়।’

আইএমএফ থেকে এনবিআরকে জানানো হয়েছে, প্রতি অর্থবছরে শুধু আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় সরকার গড়ে ৪৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভ্যাট অব্যাহতিতেও এ অর্থের সমান আদায় কম হয়। অব্যাহতি তুলে নেওয়া হলে এ অর্থ নিশ্চিত আদায় হবে। 

আইএমএফের কাছে জমা দেওয়া ভ্যাট অব্যাহতি বা প্রত্যাহার-সম্পর্কিত এনবিআরের তৈরি প্রতিবেদন থেকে পণ্য বাছাই করে আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্তিতে এনবিআর কাজ করছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে, এমন খাতগুলোতে ভ্যাট আরোপ করা নেই। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পে, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে একই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পলি ব্যাগের পরিবর্তে জিও ব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, রিসাইক্লিংয়ের লক্ষ্যে ওয়েস্ট পেপার/কটন/পুরোনো ব্যাটারি/স্ক্র্যাপ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক, সেলে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। পাইকারি/খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট এবং ভ্যাটের আওতাবহির্ভূত। পরিবহন সেবায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পণ্য পরিবহন ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভ্যাটের আওতামুক্ত। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইনের প্রথম তফসিল অনুযায়ী ৪৮৯ এইচএস কোডভুক্ত প্রাথমিক পণ্য, জীবনধারণের জন্য মৌলিক পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া একই তফসিল অনুযায়ী প্রায় ৫০টি সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রায় ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত।’

ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তনে ভয়

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তনে ভয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ডেঙ্গু ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগে পড়েছেন দেশের বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে এক বছরের তুলনায় আরেক বছর ডেঙ্গুর পাদুর্ভাবের সময়সীমা বেড়ে যাওয়াকে খুবই চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে তাদের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকার চেয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়ার ঘটনা। এমন উদ্বেগ থেকেই ডেঙ্গুর সবগুলো সেরোটাইপ, জেনোটাইপ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে কোনো কোনো গবেষণাগারে। সিকোয়েন্সিংয়ে জোর দিয়েছেন কেউ কেউ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গেছেন এবারও তারা আক্রান্ত হলে বিপদ বাড়বে। ফলে গতবারে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের এবার অধিকতর সতর্ক থাকা জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের ১, ২, ৩ ও ৪ (চারটি) সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে। গত বছর আক্রান্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি ছিল সেরোটাইপ-২-এর। এর বাইরে গত বছর দুটি সেরোটাইপের একটি সম্মিলিত অংশও ছিল। 

বিশেষ করে জুন-জুলাইয়ে এই যৌথ সেরোটাইপের রোগী বেশি ছিল। এ ক্ষেত্রে রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন পাশের দেশ ভারতে ইতোমধ্যেই ডেন ৫ সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ডেন ৫ শনাক্ত হলে পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যসূত্র অনুসারে, গত বছর দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মারা গেছেন। যাদের মধ্যে ডেন ২ শনাক্ত হয় ৭০ দশমিক ২ শতাংশ, ডেন ৩ ছিল ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ডেন ১ ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ডেন ২+ডেন ৩ যৌথ ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং ডেন ৪ ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) তথ্য অনুসারে দেশে ১৯৬৪ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ডেঙ্গু দেখা দেয়। ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুর কমবেশি প্রাদুর্ভাব লেগে থাকে। এর মধ্যে ২০০২, ২০১২ ও ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডেন ৩ সেরোটাইপের প্রাধান্য ছিল। তবে সেরোটাইপ ১-৪ পর্যন্ত সব কটিই শনাক্ত হয়। অন্য বছরগুলোতে ডেন ৩ ও ডেন ৪ শনাক্ত হয়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ডেন ১ থাকলেও প্রাধান্য ছিল ডেন ২-এর। এরপর ২০১৮-১৯ সালে চারটি সেরোটাইপই শনাক্ত হয়।

ডেঙ্গু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত বছরের অভিজ্ঞতা অনুসারে এবার জরুরিভাবেই নতুন সেরোটাইপ আছে কি না সেটি দেখা দরকার। গত বছরই ধারণা করা হয়েছিল। এবার এখনই পরীক্ষা বাড়ানো দরকার। যত পরীক্ষা হবে, তত সহজে সেরোটাইপ শনাক্ত সহজ হবে। আশপাশের দেশে থাকলে সেটি আমাদের জন্য আরও শঙ্কার ব্যাপার। সেদিকে নজর রেখেই আমাদের বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করেছেন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত বছর ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং মারা গেছেন ১ হাজার ৬৭৮ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৫৮১ জন এবং মারা গেছেন ৩৩ জন। গতকাল পাঠানো তথ্য অনুসারে শেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ জন এবং মারা গেছেন একজন। এবার আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১১ জন এবং এর পরই ঢাকা দক্ষিণে ৫০৩ জন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বরিশাল অঞ্চলে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, প্রথমত গত বছর যারা যে সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা এবার আক্রান্ত হলে বুঝতে হবে অন্য কোনো সেরোটাইপে তাদের আক্রান্ত করেছে। ফলে তাদের জটিলতা ও ঝুঁকি বেশি থাকবে। তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

ওই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত চারটি সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে বলেই আমরা জানি। তবে ডেন ৫ সেরোটাইপও পাশের দেশে শনাক্ত হওয়ার কথা শুনেছি। এই সেরোটাইপ আমাদের দেশে ঢুকলে বা থাকলে কিন্তু বিপদ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, এবার ভয় হচ্ছে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর বেশি বিস্তার নিয়ে। যদি ঢাকার বাইরে বেশি ছড়ায়, তবে সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। এ ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে ঢাকায় আর ঢাকার বাইরে একই সেরোটাইপের ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা আছে কি না। কোন এলাকায় কোন সেরোটাইপ বেশি সেটি জানতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার কাজ সহজ হবে। সার্বক্ষণিক সেরোটাইপ পর্যালোচনা করা দরকার বলেও তিনি জানান।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘এবার এখন পর্যন্ত সেরোটাইপ বিশ্লেষণ হয়নি। ফলে এবার এখন পর্যন্ত যারা আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে কোন সেরোটাইপের কত শতাংশ ছিল, সেটিও বলতে পারছি না। সামনে এগুলো দেখা হবে।’

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) উপনির্বাহী পরিচালক ড. সেঁজুতি সাহা খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত বছর দেশে ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি হয়েছিল তাতে এবারও সবাইকে সতর্ক থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা আরও জরুরি। সেদিকে নজর রেখেই আমাদের প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই আমরা ডেঙ্গুর সেরোটাইপ সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ শুরু করেছি। কারণ অনেক সময়েই এক সেরোটাইপের মধ্যে জেনোটাইপগুলোর নতুনত্ব আসতে পারে। যেমনটি আমরা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখেছি। অনেক সাব-ভ্যারিয়েন্ট হঠাৎ করেই বড় ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।’ 

ওই অনুজীব বিজ্ঞানী বলেন, ‘ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বড় একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যায় পিক সিজনের সময়কালের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এক বছর থেকে আরেক বছরে পিক সিজন দীর্ঘ হচ্ছে। আগে বছরে খুব অল্প কয়েক দিন বা এক-দুই মাস ডেঙ্গু থাকত। এখন আমরা বছরজুড়ে প্রতিদিনই রোগী পাচ্ছি। এই পরিবর্তন তো এমনি এমনি হচ্ছে না। অন্যদিকে ডেঙ্গুর ভেক্টর বা বাহক এডিস মশার মধ্যেও এই ভাইরাসের সহনশীলতা শক্তি তৈরি হয়েছে। আগে কেবল পরিষ্কার পানিতে ও ঘরেই ডেঙ্গু এডিসের প্রজনন হতো। এখন নোংরা পানিতে নালা-নর্দমায়ও এডিস মশার লাভা পাওয়া যায়। এটি ভালো লক্ষণ না। তাই আমরা আমাদের ল্যাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের সিকোয়েন্সিং চলমান রাখব। প্রথম ধাপের কাজের ফলাফল হয়তো খুব দ্রুত সময়েই পেয়ে যাব।’

দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচন ভোটার বাড়ানোর কৌশল

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
ভোটার বাড়ানোর কৌশল
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দ্বিতীয় ধাপে ভোটের বাকি আর মাত্র দুই দিন। এই ধাপে সবচেয়ে বেশি, ১৫৭ উপজেলায় একযোগে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২১ মে ভোটের দিন কেন্দ্রের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ৮ মের উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার কম হওয়ায় এই ধাপের নির্বাচনে ভোটের দিন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি ভোটের হার বাড়ানোকে ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
 
গত তিনটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদে ভোটের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ৬১ শতাংশ। তারপর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকের উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। তবে এবার ভোটের হার সবচেয়ে কম, ৩৬.১৮ শতাংশ।

সংকট উত্তরণে কমিশন বৈঠকে নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন উপলক্ষে ইসির বিভাগীয় মতবিনিময় সভায় স্থানীয়দের ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করছেন, প্রার্থীদেরও তাগিদ দিচ্ছেন নির্বাচন কমিশনাররা। গত বৃহস্পতিবার যশোরে উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান। 

তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে প্রার্থীদের আলাদাভাবে প্রচার চালাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা ভোটাদের বাধা দেবে, তাদের প্রতিহত করবে প্রশাসন। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দিলে আইনি ক্ষমতা প্রয়োগে প্রশাসনকেও আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।’ 

নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের (ইসির) দায়িত্ব হলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে দেওয়া। সেটা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভোটারের কাছে যাওয়া, তাকে ভোট দিতে আগ্রহী করা বা তার ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা দরকার প্রার্থীদের। আর আমাদের তরফ থেকে মাঠপ্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে ভোটের পরিবেশ নিয়ে বার্তা দেওয়া, ভিডিওচিত্র প্রদর্শনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রার্থীদের জনপ্রিয়তাও কিন্তু ভোটের হারে প্রভাব ফেলে। সে জন্য ভোটারদের আস্থায় নিতে প্রার্থীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সুষ্ঠু ভোটের আবহ তৈরি করা হয়েছে। ভোটবিরোধী প্রাচারের ব্যাপারেও সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আশা করছি, এই ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।’

কেন্দ্রে ভোটার আনতে প্রার্থীদের পরিকল্পনা

ভোটাররা কেন আপনাকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন, তাদের আগ্রহী করতে কোনো পরিকল্পনা কী নিয়েছেন- এ প্রশ্নে জবাবে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. লোকমান হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের পাশে ছিলাম, আগামীতেও থাকব। ভোটের দিন কেন্দ্রে আসতে তাদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য আমার কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছি, ভোটারদেরও উদ্বুদ্ধ করছি।’ 

কথা হয় নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী আসলাম উদ্দিন ও লালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী শামীম আহমেদ সাগরের সঙ্গে। তারা জানান, জনসংযোগের সময় প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করছেন। যাদের বাড়ি ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে, তাদের তালিকা করে কেন্দ্রে নিয়ে আসা ও বাড়ি পৌঁছাতে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রের আওতায় শতাধিক কর্মী নিয়োগ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। বিশেষ করে নারী ও নতুন ভোটারদের আগ্রহী করার চেষ্টা চলছে। 

কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন যশোরের চৌগাছায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তানিছুর রহমান, ঝিকরগাছা উপজেলার প্রার্থী মনিরুল ইসলাম ও সেলিম রেজা। তারা জানান, কর্মীদের নিয়ে তারা বারবার ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি লক্ষ্য রাখতে এবং প্রয়োজনে ওই দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতেও পরিকল্পনা সাজিয়েছেন অনেক প্রার্থী।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কী হঠাৎ করে হয়েছে? না তা হয়নি। শুধু স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন না, বহুদিন ধরেই সংসদ নির্বাচনসহ বিগত অনেক নির্বাচনেই ভোটের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট চলছে। এটা হলো দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির প্রতি তাদের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। ভোটের মূল্যায়ন যেহেতু হচ্ছে না, তাই মানুষ ভোট দেওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আগ্রহ কেনই বা হবে, ভোট হচ্ছে একদলীয় প্রার্থীদের মধ্যে। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় না। যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, কেন অংশ নিচ্ছে না- সেই অচলাবস্থার কোনো সমাধান তো হচ্ছে না। চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।’ 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক রায়ের স্বীকৃতি আদায়ে যে দেশ (বাংলাদেশ) স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশের মানুষ এখন ভোট দিতে চায় না। কেন এই পরিস্থিতি, তা সত্যি উদ্বেগের বিষয়। রাজনীতিবিদরা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতার অপব্যহার করে ব্যক্তিগত অগাধ সম্পদ অর্জন ও পেশিশক্তির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। ক্ষমতার রাজনীতির দুষ্ট সংস্কৃতি ডালপালা ছড়িয়ে নির্বাচন এখন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে সব দল না আসায় ভোটকে ঘিরে নেই উৎসবমুখর পরিবেশ। যেকোনো উপায়ে জয়ী হওয়াই সবার লক্ষ্য। পরাজিত হলে জনগণের ভোটের রায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা কারও নেই। এসব কারণে ভোটের প্রতি ভোটারদের আস্থাহীনতা চরম আকার ধারণ করছে। 

পরিস্থিতির উত্তরণে নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি ও জনগণের ভোটের রায় মেনে নেওয়ার মানসিক সংস্কৃতিতে ফিরে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান অনুঘটক হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার অসুস্থ মানসিকতা থেকে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা করতে হবে।

বিনা ভোটে জয়ী ২১ প্রার্থী 

একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় দ্বিতীয় ধাপে এরই মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন ২১ প্রার্থী। চেয়ারম্যান পদে- কুমিল্লা আদর্শ সদরে আমিনুল ইসলাম, জামালপুরের ইসলামপুরে মো. আ. ছালাম, ফরিদপুরের নগরকান্দায় মো. ওয়াহিদুজ্জামান, চট্টগ্রামের রাউজানে এ কে এম এহছানুল হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আবুল কাশেম চিশতী, সাভারে মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও মৌলভীবাজার সদরে উপজেলার কামাল হোসেন।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে- রাজশাহীর বাগমারায় শহীদুল ইসলাম, রাঙামাটির রাজস্থলীতে হারাধন কর্মকার, কুমিল্লা আদর্শ সদরে আহাম্মেদ নিয়াজ, চট্টগ্রামের রাউজানে নুর মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে রফিকুল ইসলাম, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সুমন ও রূপগঞ্জে মিজানুর রহমান। 

এ ছাড়া মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে- রাঙামাটির রাজস্থলীতে গৌতমী খিয়াং, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সাঈদা সুলতানা, কুমিল্লা আদর্শ সদরে হোসনে আরা বেগম, চট্টগ্রামের রাউজানে রুবিনা ইয়াছমিন রুজি, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় হোসনে আরা বেগম, নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে শাহিদা মোশারফ ও রূপগঞ্জে ফেরদৌসী আক্তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৬৩ জেলার ১৫৭ উপজেলায় প্রথমে মনোনয়নপত্র জমা দেন ২ হাজার ৫৫ জন প্রার্থী। তাদের মধ্য থেকে ১৭৭ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ১ হাজার ৮২৮ জন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬০৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৯৪ জন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫২৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। এ ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের প্রচার শেষ হবে আগামীকাল রবিবার মধ্যরাতে।

এরপর তৃতীয় ধাপে ২৯ মে ১১২ উপজেলায় (২১টিতে ইভিএম) এবং সবশেষ চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলায় (২টিতে ইভিএম) ভোটের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। দেশের ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে এ পর্যায়ে ৪৭৬টি উপজেলায় চার ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন। আর ১৯টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের এখনো সময় হয়নি। পরে চার ধাপে যেসব উপজেলার ভোট নানা কারণে স্থগিত হবে সেসব উপজেলায় নির্বাচন করা হবে বলে জানিয়েছে ইসি।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন খবরের কাগজের নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর এবং টাঙ্গাইল ও হবিগঞ্জের জেলা প্রতিনিধি)

বাজারে আসছে টিএমএসএস এলপিজি

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:২৭ এএম
বাজারে আসছে টিএমএসএস এলপিজি
বাগেরহাটের মোংলা নৌ-বন্দর এলাকায় শেলাবুনিয়া গ্রামে নির্মিত টিএমএসএস এলপিজি প্লান্ট। শুক্রবার তোলা। ছবি : খবরের কাগজ

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বার্ক) থেকে ছাড়পত্র পেলেই বাজারে আসবে টিএমএসএস (ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ) এলপিজি (লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস)। তবে স্থায়ী ছাড়পত্র নিতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। এর জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

বাগেরহাটের মোংলা নৌ-বন্দর এলাকার শেলাবুনিয়া গ্রামে ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫ একর জমির ওপর ৯০০ কোটি টাকায় টিএমএসএস এলপিজি প্লান্টের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্প এলাকায় সিলিন্ডার তৈরির জন্য নেওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। 

প্লান্ট ম্যানেজার মো. ইমরান মল্লিক বলেন, ‘চায়নিজ জিংমে হন্টু স্পেশার এয়ারক্রাফট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান কোসেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এলপিজি প্লান্টে সব ধরনের যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ১২, ৩৫ ও ৪৫ কিলোগ্রাম (কেজি) এলপিজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিলিন্ডার রিফিলিং করা হয়েছে। ২০১৮ সালে এ প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে করোনাসহ বিভিন্ন কারণে নির্মাণকাজ শেষ হতে প্রায় দুই বছর সময় বেশি লেগেছে। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সিলিন্ডার কিনে বাজারজাত করা হবে টিএমএসএস এলপিজি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে টিএমএসএস এলপিজি প্লান্টেই তৈরি হবে সিলিন্ডার।’  

তিনি আরও জানান, এ কোম্পানিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। প্রতিষ্ঠানের ডলফিন জেটিতে একসঙ্গে ৯ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি খালাসের সক্ষমতা থাকলেও চ্যানেলে গভীরতা কম থাকায় এখন জাহাজ থেকে এলপিজি খালাস করা সম্ভব হবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেট্রিক টন। ২৪ ঘণ্টা উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন এ প্লান্টে আট ঘণ্টায় ১২ কেজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ৯ হাজার ৬০০টি সিলিন্ডার রিফিলিং করা সম্ভব হবে। তবে ৩৫ কেজি এলপিজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিলিন্ডার রিফিলিং করা সম্ভব ৯৬০টি আর ৪৫ কেজি সিলিন্ডার রিফিল করা সম্ভব ৭২০টি। 

ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে জাহাজে এলপিজি আমদানি করা হবে। তিনটি স্টোরেজ ট্যাংকে ছয় হাজার মেট্রিক টন এলপিজি রাখার ব্যবস্থা থাকলেও আরও দুই হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়েছে। প্লান্টে জাহাজ থেকে এলপিজি নামানোর যেমন সুযোগ আছে, তেমনি লাইটার জাহাজে এলপিজি লোড করারও সুযোগ রয়েছে। বছরে উৎপাদনের গড় ক্ষমতা ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৮১ মেট্রিক টনের বেশি।

বিক্রয় বিভাগের প্রধান মো. শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, বগুড়ার এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের এলপিজি খাতে ৩১তম প্লান্ট। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি গোপালগঞ্জসহ দেশের ১১টি জেলায় প্রাথমিকভাবে গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিক্রির জন্য ডিলার ও এজেন্ট নিয়োগ করা হবে। প্রথম দিন চার লাখ সিলিন্ডার দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বাজারে এলেও প্রতিদিনই চাহিদা অনুযায়ী ধীরে ধীরে সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

গৃহস্থালি কাজের জন্য সাধারণত যে ধরনের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, তার দাম কেমন হবে- এ প্রশ্নের জবাবে মো. শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, ‘সরকারনির্ধারিত দরের চেয়ে কোনোভাবেই বেশি দামে খুচরা বাজারে কেনাবেচা হবে না। এখন দেশের বাজারে এলপিজির মাসে গড় চাহিদা দেড় লাখ মেট্রিক টনের বেশি। নতুন প্রতিষ্ঠান হলেও চাহিদা আনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় ধীরে ধীরে এজেন্ট ও ডিলারদের সংখ্যা বাড়ানো হবে।’ 

বিসিএল গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) মো. মেজবাউল বারী শুভ্র বলেন, ‘টিএমএসএস এলপিজি প্লান্টের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্প এলাকার ভেতরেই তৈরি করা হবে ১২ কেজি, ৩৫ কেজি ও ৪৫ কেজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিলিন্ডার। আট ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ১২ কেজির সিলিন্ডার তৈরি হবে। একই সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হবে ৩৫ কেজি ও ৪৫ কেজির সিলিন্ডার। সিলিন্ডার তৈরির কারখানা নির্মাণে আরও অন্তত ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কারখানাটির নির্মাণকাজ শেষ হলে সিলিন্ডার খাতে ব্যয় অনেকাংশে কমবে। 

মো. মেজবাউল বারী শুভ্র দাবি করেন, ডিলার ও এজেন্টদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাক্রমে ১ কোটি সিলিন্ডার বাজারে দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। জেলা ও উপজেলার সদরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পরিবেশবান্ধব এ জ্বালানি সাধারণ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছে টিএমএসএস এলপিজি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক মাপের নিশ্চয়তা রয়েছে শতভাগ।

তিনি আরও জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে রোড ট্যাংকার ও বক টেইলের মাধ্যমেও টিএমএসএস এলপিজি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। প্রথম দিন বিভিন্ন স্থানে পণ্য নিতে প্রস্তুত করা হয়েছে ১০টি রোড ট্যাংকার ও বক টেইলার। বড় বড় শিল্পকারখানা ও ফিলিং স্টেশনে এলপিজি পৌঁছানোর জন্য রোড ট্যাংকার ও বক টেইলার তৈরি করবে টিএমএমএস এলপিজি কর্তৃপক্ষ। টিএমএসএস এলপিজি বাজারে আসার আগেই শুধু খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে এজেন্ট ও ডিলারশিপ পাওয়ার জন্য প্রায় ৭০টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে।