দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পার হলেও এ দেশের বেশির ভাগ শ্রমিকের নায্য মজুরি নিশ্চিত হয়নি। বেশির ভাগ খাতের শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি কাঠামোই নেই। শুধু তাই নয়, বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে নেই প্রয়োজনমতো অবকাশ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ। তাদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকার পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। আবার অনেক খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও বিভিন্ন অজুহাতে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না।
অর্থনীতিতে শ্রমিকের অবদান বাড়াতে বিশেষজ্ঞরা শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
১৮৮৬ সালে ১ মে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা করাসহ বিভিন্ন অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন অনেক শ্রমিক। অনেক দেশেই শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি পূরণ হয়েছে, কর্মপরিবেশেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে। সরকারি শিল্পকারখানা, তৈরি পোশাকশিল্পসহ কয়েকটি খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হলেও বিরাট অংশ এর বাইরে আছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচের স্তরের চেয়েও কম।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েই চলেছে। দেশের অর্থনীতির সুষম বিকাশের জন্য অবিলম্বে জীবনযাপনের খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সময়ের দাবি। যেসব দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে, সেসব দেশে শ্রমিকদের জীবনমানও উন্নত। তাই কম মজুরি দিয়ে বা শ্রমিকদের বঞ্চিত রেখে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন যে অসম্ভব, এই সরল সত্য সরকার ও মালিকপক্ষকে বুঝতে হবে। যেকোনো দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন অপরিহার্য।’
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশা খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে সরকারের একটি বিশেষ বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ডের নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৪২টি খাতে মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করার বিধান থাকলেও কোনো কোনো খাতে এর চেয়ে বেশি সময় পর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো খাতে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো পর্যালোচনা হয়নি। সাধারণত শ্রমিকদের জীবনযাপনের ব্যয়, জীবনযাপনের মান, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা এবং দ্রব্যের মূল্য, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কাজের ধরন অর্থাৎ সেই কাজে ঝুঁকি কতটা আছে এবং মালিকপক্ষের কতটা সামর্থ্য আছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার কথা। অথচ বেশির ভাগ খাতেই বাজারে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে সেগুলো পরবর্তীতে আর সমন্বয় করা হয়নি।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরিব মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের চড়া দাম এই নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলেছে। এ দেশের বেশির ভাগ শ্রমিক যা বেতন পান তা দিয়ে তিন বেলা পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সম্ভব নয়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, সারা দেশে শুধু সরকার নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ২৮ লাখ ৪৬৫। এখানে কাজ করছেন মোট ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯১ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ২৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৭২ পুরুষ এবং ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৯ জন নারী শ্রমিক। শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতে ৬ কোটি ৩৫ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন কৃষি খাতে। অথচ এ খাতে সরকার নির্ধারিত মজুরি নেই। বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে সেখানে মজুরি নির্ধারিত হয়, যা সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়।
২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের পর সরকারের হস্তক্ষেপে দৈনিক মজুরি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, যা এখনো কম। শুধু চা-শ্রমিকরাই নন, এ রকম নিম্ন মজুরি পাচ্ছেন বাংলাদেশের আরও অনেক খাতের শ্রমিক।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির মধ্যে পার্থক্য অনেক। কোনো কোনো খাতের মজুরি মাত্র ৩ হাজার টাকা, আবার কোনো কোনো খাতের মজুরি ১৬ হাজার টাকার বেশি। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতাদের চাপ, সরকারি নজরদারি ও শক্তিশালী শ্রম সংগঠন থাকায় তৈরি পোশাক খাতে নিম্ন মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে তা এখনো সুস্থ জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আবার অনেক খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও সেটি পুরোপুরি কার্যকর করা হয় না।’
তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রাবার শিল্প, পাটকল, বিড়ি, ম্যাচশিল্প, জুট প্রেস, সিনেমা হল, হোসিয়ারি, কোল্ড স্টোরেজ, পেট্রলপাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি. অয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, লবণশিল্পসহ ৪২টি খাতের মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয়েছিল কয়েক বহু বছর আগে। যেমন কোল্ডস্টোরেজ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাচশিল্পের ২০১৩ সালে আর বিড়িশিল্পের ২০১৬ সালে। আবার পেট্রলপাম্পের শ্রমিকদের মজুরি বহু বছর আগে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তী সময়ে আর সমন্বয় করা হয়নি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যতটা প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে এ দেশের বেশির ভাগ শ্রমিক তার চেয়ে অর্ধেকও মজুরি পান না। ‘লিভিং ওয়েজ’ বা মোটামুটি মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য যে আয় দরকার, তা এলাকাভেদে ২০ হাজার থেকে ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রকৃত আয় ও ন্যূনতম চাহিদা পূরণের মধ্যে পার্থক্য গড়ে ৫০ ভাগের বেশি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা কষ্টকর জীবনযাপন করছেন।