তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসার ১০টি জোনেই চলছে কমবেশি পানির সমস্যা। তবে এসব এলাকায় সংকটের সবচেয়ে বড় নির্মম শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। গরিব এসব মানুষ আশেপাশের বড় বড় যেসব ভবনে সাবমার্সিবল পাম্প আছে, সেসব ভবন থেকে পানি ‘ভিক্ষা’ করে দিন গুজরান করছেন।
গতকাল মঙ্গলবার ভাসানটেক এলাকার আব্দুল কুদ্দুস খবরের কাগজের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘থাকি টিনশেড বাসায়। ওয়াসার লাইনের পানিই ভরসা। সেই পানি নিয়ে ৬ মাস ধরে সমস্যা চলছে। ৫-৬দিন পর পর যদিও বা পানি আসে, তা থাকে ময়লা। সেই পানি দিয়ে কাপড়চোপড়ও ধোয়া যায় না। খাওয়া তো দূরের কথা। আর কি দুর্গন্ধ!’
এক প্রশ্নের জবাবে কুদ্দুস বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি কিনে আনি। তবে সব সময় কিনে ব্যবহার করার সামর্থ্য তো নেই। তাই এলাকার বড় যে ভবনগুলোতে সাবমার্সিবল পাম্প আছে, তাদের কাছ থেকে পানি ভিক্ষা করে আমরা চলি। আমরা বিল দিই। আমাদের পানি দিবেন, আমরা চলব। এটাই তো নিয়ম। আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, প্রত্যেকটি বাড়িতে দুই চারটা করে ডায়রিয়া রোগী। অথচ মাসে মাসে বিল ঠিকই দিয়ে যাচ্ছি। অভিযোগ করতে গেলে ওয়াসার লোকজন বলেন, কোথাও পাইপ কেটে গেছে। আপনারা দেখেন।’
ভাসানটেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশ। প্রতিটি বোতলে ময়লা পানি, গাঢ় কালো। এই পানিই মূলত তারা বাধ্য হয়ে ব্যবহার করছেন। গোসল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজ চালানো হচ্ছে। এর ফলে তারা নানারকম রোগে ভুগছেন।
বোতল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভুক্তভোগী ফাতেমা বলেন, ‘লাইনের পানি খেয়ে আমি ও আমার বাসার সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ডায়রিয়া হয়ে গেছে। আমার বাচ্চাকে সাত দিন হাসপাতালে রাখতে হয়েছে। এভাবে কয়দিন চলবে আমাদের?’
মতিন নামের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিন-চার দিন পরে হঠাৎ একটু পানি আসে। পানি পুরো ময়লা। এমন ময়লা যে টয়লেটেও ব্যবহার করার মতো না। ময়লাযুক্ত, কাদা, আলকাতরার মতো পানি।’
এ সময় বোতলে রাখা ওয়াসার ময়লা পানি এ প্রতিবেদককে দেখান তিনি। একই অবস্থা চলছে রাজধানীর মহাখালীর মধ্যপাড়া, হাজারীবাড়ি আর মুন্সীপাড়ায়। প্রতিদিন বিকেল হলেই ড্রাম, কলস আর বালতি নিয়ে তৃণমূলের মানুষ পানির জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন টিউবওয়েলের কাছে।
এখানকার বাসিন্দাদেরও দাবি, বারবার ওয়াসার কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। অনেকে আবার মাইলখানেক পথ পাড়ি দিয়ে পাম্পের কাছে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন।
পানি নিতে আসা এক নারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা তো বেশি দামে পানি কিনে খেতে পারি না। তাই এক মাইল দূর থেকে এখানে পানি নিতে এসেছি।’
শুধু ভাসানটেক বা মহাখালীই নয়, রাজধানীর পানিসংকটের বড় শিকার মূলত ঢাকার প্রায় সব এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। রাজধানীর ত্রিমোহনী, নন্দীপাড়াসহ অনেক এলাকায় দেখা গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি পেতে ‘যুদ্ধ’ করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন এমনভাবে চললেও প্রতিকারের কোনো পদক্ষেপ নেই ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে! এসব এলাকার বাসিন্দারা ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত পানি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘পানি অনেক মূল্যবান। বড় বড় ভবনে যারা থাকেন, তারা সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে পানি তোলেন। তারা এই পানি ফুল গাছে দেন। গাড়ি ধোয়ার কাজে এই পানি ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, বস্তিবাসী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কষ্টেসৃষ্টে এক বালতি পানি পেলে সারা দিন ব্যবহার করেন। বড় বড় গাছ আমরা কেটে ফেলেছি। তারপর ছাদবাগানে আগ্রহী করছি। ছাদবাগান বড় গাছের বিকল্প কি না, সেটা কিন্তু ভাবছি না।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, ‘হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট টিনের ঘরের বিকল্প একটা গবেষণা করেছে। কিন্তু বাস্তবে সেটার কোনো প্রয়োগ আমরা দেখতে পেলাম না। এখন অতিরিক্ত গরম পড়েছে বলে এ কথা বলছি। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণের সামনের দিনগুলোতে এই সমস্যা আরও বেশি বেশি মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। সে ক্ষেত্রে পরিকল্পনা আগেই করা দরকার।’
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ওয়াসার দায়িত্ব। অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি। যেসব এলাকায় স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে, সেসব এলাকায় গাড়ি দিয়ে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।’
গাড়ি দিয়ে সরবরাহ করা পানিতেও ময়লা
সংকট চলছে এমন অনেক এলাকায় গাড়ি দিয়ে পানি সরবরাহ করছে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু এই পানিও ময়লা, ব্যবহারের অনুপযোগী বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ঢাকা ওয়াসার জরুরি পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিহির কুমার দত্ত। গত কয়েক দিন ধরে পানিসংকটের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সরবরাহ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ-২ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তীব্র পানিসংকটে ভুগছেন এলাকাবাসী। ওয়াসার গাড়িতে সরবরাহ করা পানি দিয়ে কোনো রকমে গোসল করা গেলেও পানির মধ্যে অতিরিক্ত ময়লা থাকার কারণে চুলকানি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। এই পানি ফুটিয়েও খাওয়ার উপযোগী করা যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে সমর্থ লোকজন দোকান থেকে বোতলের পানি কিনে খাচ্ছেন।
এলাকাবাসী জানান, নিকুঞ্জ এলাকায় গত বৃহস্পতিবার মূলত পানিসংকটের শুরু। পানির চাহিদা বেশি থাকায় অতিরিক্ত চাপে ওই এলাকায় ওয়াসার পাইপ ফেটে গিয়ে এই দুর্ভোগের সূত্রপাত হয়। চাহিদা অনেক বেশি থাকায় পানির গাড়ি আনতেও আগের রাত থেকে সিরিয়াল দিতে হচ্ছে।
নিকুঞ্জ-২ এলাকায় একটি বাড়ির ৭ তলার বাসিন্দা লুবনা মাহমুদ জানান, ‘এই এলাকায় দুর্বিষহ পানিসংকট চলছে। ওয়াসার গাড়িতে যে পানি আনা হয়, তা মোটর দিয়ে তোলার সময় যখন ট্যাঙ্কে জমা হতে থাকে, তখন পানি নিচের দিকের ফ্ল্যাটগুলোর লাইনে আগে পৌঁছায়। পানিসংকটে সবাই চায় সাধ্যমতো যতটুকু পানি ধরে রাখা যায়, তা ধরে রাখতে। এই কারণে ওপরের তলায় পানি আসার আগেই শেষ হয়ে যায়।’
গতকাল সকাল থেকে খিলক্ষেত বাজারসংলগ্ন অধিকাংশ বাসায় পানি ছিল না। ফলে জরুরি কাজ সম্পন্ন করতে হিমশিম খেতে হয় অনেককে। অনেককে পানির অভাবে রান্না পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয়েছে। দুপুরের দিকে কয়েক মিনিটের জন্য পানি এলেও পরক্ষণেই চলে যায়। সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পানি আসেনি। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে।