আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে গত বছরের জানুয়ারিতে। কিস্তিভিত্তিক এই ঋণ পাওয়ার জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানো, কর অব্যাহতি কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণ, টাকার বিনিময় হার নমনীয়সহ অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। তবে অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। সরকার তাদের (আইএফএফ) এই শর্ত মেনে নিয়েছে এবং বছরে চার দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কীভাবে এই দাম সমন্বয় করা হবে, তার একটি পরিকল্পনাও দিয়েছে আইএমএফের কাছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে বছরে ভর্তুকি ৮৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফ চায়, দাম সমন্বয় করে (বৃদ্ধি করে) বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ কমাতে। অর্থাৎ এই খাতে কোনো ভর্তুকি চায় না ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা এই সংস্থাটি। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে দাম বাড়িয়ে তা নিয়ে আসা হবে উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি পর্যায়ে।
এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৭ টাকার কিছু বেশি। তবে আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাপর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন প্রায় ৯ টাকা।
অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। তাই এটি বছরে কয়েকবার বাড়ানো হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এত চাপ ভোক্তা নিতে পারবে না। বিদ্যুৎ খাতে মূল্য বৃদ্ধি করে পুরো ভর্তুকি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি বৈঠকে উঠে আসে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূল্য বৃদ্ধি না করে বিদ্যুৎ খাতে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি আছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারের জন্য গলার কাঁটা। এ পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে ভর্তুকি কমানো যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের ভর্তুকির পরিমাণ বেশি। তবে ঠিক কোন ক্ষেত্রে এটি কমাতে হবে, সেটি দেখার বিষয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির মাত্রা বেশি। এই খাতের বড় সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ। তবে কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো উচিত হবে না।’ বিদ্যুতের দাম বাড়লে জনগণের ওপর চাপ বাড়বে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘চাপ তো বাড়বেই। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। তার ওপর বিদ্যুতের চাপ বাড়লে জনগণের ওপর চাপ আরও ঘনীভূত হবে। আমাদের রাজস্ব আদায় কম। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ে। কাজেই সব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
অবশ্য বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। তাই দাম সমন্বয়ের নামে ভর্তুকি কমানোর মানে হলো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। তবে খরচ কমিয়েও সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে পারে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয় রোধ করে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে সরকারের মনোযোগ নেই।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির একটি পদ্ধতি আছে। ভোক্তা, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা, সরকারসহ সব পক্ষের উপস্থিতিতে যৌক্তিক কারণ পর্যালোচনা করে দাম বাড়ানোর জন্য গণশুনানি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। বিইআরসি গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। এখন সংস্থাটি নিজেরাই সে ধরনের পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে সরাসরি সরকারকে চাপ দিয়ে দাম বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে। এটি তাদের একধরনের আচরণগত অসংগতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক) উচিত সরকারকে বলা, আগে গণশুনানি হোক। সেখানে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে যুক্তিতর্ক তুলে ধরতে পারবেন। গণশুনানি ছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পদ্ধতি সঠিক নয়।’
এক প্রশ্নে অধ্যাপক আকাশ আরও বলেন, ‘আইএমএফের কথা শুনলে জনগণের ওপর চাপ বাড়বে, এটি খুবই স্বাভাবিক। এখন কথা হচ্ছে, সরকার তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। কাজেই তাদের কথা তো শুনতেই হবে। এটি তো সরকারের নীতির দুর্বলতা। সরকার কেন এ ধরনের শর্তে ঋণ নিচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে জনগণ আরও দিশেহারা হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, বিকল্প হিসেবে বিইআরসিকে পুনর্গঠন করা দরকার। সেখানে আলোচনা করে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাজস্ব বৃদ্ধি আমরাও সমর্থন করি। কিন্তু কথা হচ্ছে কোন উৎস থেকে রাজস্ব বাড়ানো হবে, তা ঠিক করতে হবে। আমরা চাই ধনিক শ্রেণির কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত।’
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বাংলাদেশ পেয়েছে। তৃতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ডলার পাওয়ার কথা জুন মাসে। আইএমএফের বর্তমান দলটি ২৪ এপ্রিল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করছে, যা শেষ হবে ৮ মে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, তেল-গ্যাসে এখন ভর্তুকি নেই। আইএমএফের প্রতিনিধিদল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গেও আলাদা বৈঠক করেছে। পেট্রোবাংলা ও বিপিসি প্রায় একইভাবে আইএমএফকে জানিয়েছে, গ্যাস ও জ্বালানি তেলে নতুন করে ভর্তুকির চাপ নেই। তেলের দাম নিয়ে স্বয়ংক্রিয় যে পদ্ধতি (আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশে বাড়বে, কমলে কমবে) চালু করার কথা আইএমএফ বলেছিল, তা হয়েছে। প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেলে আর কখনো ভর্তুকি দিতে হবে না।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। এর অংশ হিসেবে সর্বশেষ গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম সরকার একবার বাড়ায়।
এর আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরায় ১৪ দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে আমাদের বড় দুর্বলতা আছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করতে পারলে ভর্তুকির ওপর এত বেশি চাপ আসত না। আইএমএফের সব পরামর্শ মেনে চলার দরকার পড়ত না।’ তিনি বলেন, ‘দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে এই চাপ আরও বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে হবে। তবে সেটি সহনীয়ভাবে।
কর আদায় বাড়াতে চায় আইএমএফ: মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশে কর আদায় বিশ্বে সবচেয়ে কম। এর অন্যতম কারণ হলো কর অব্যাহতির পরিমাণ বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত ৯ শতাংশের নিচে। আইএমএফ এই অনুপাত কমপক্ষে ১২ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। এ জন্য কর অব্যাহতি তুলে নিতে বলেছে সরকারকে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৩০টি শিল্প খাত কর অবকাশ সুবিধা পায়। এই সুবিধা চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি ও সার্ভিস সেক্টরে ২১টি খাত একই সুবিধা পাচ্ছে। সম্প্রতি এনবিআরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব খাত থেকে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
উল্লেখ্য, কর অবকাশ মানে হচ্ছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মুনাফার বিপরীতে কোনো কর দিতে হয় না। মেয়াদ শেষ হলে প্রযোজ্য হারে কর দিতে হয়।