জলাভূমির আসন সুনামগঞ্জ-১ ও ২। কথা ও কাজে তাই জলের জোঁশ। নির্বাচনি প্রচার শেষ দিন গত বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জ-২ আসনের দিরাই পৌর শহরে সকাল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল হচ্ছিল। নৌকার পক্ষে মিছিলে নতুন স্লোগান-‘বাইয়া দে/ নৌকা...’। সন্ধ্যার পর নৌকার পক্ষে মিছিলকারীদের একটি পক্ষের মধ্যে দেখা গেল আরেক জোঁশ। দিরাই সীমানা পেরিয়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনের ভীমখালি বাজারে গিয়ে একই সুরে কেবল কথা বদল করে মিছিল করছে। স্লোগান ‘ডুবাই দে/ নৌকা...’!
এক নৌকা নিয়ে একই সুরে দুই জোঁশের মিছিল করার কী কারণ? জনমনে এমন চাঞ্চল্য থেকে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, এবার দলীয় প্রার্থী উন্মুক্ত থাকায় প্রার্থীর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে রীতিমতো অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা আর এক নৌকার সুরে ঐক্যবদ্ধ নন। সুনামগঞ্জ-২ আসনে ‘বাইয়া দে’ বলে মিছিল করলে ওই একই মিছিলের মুখগুলো সুনামগঞ্জ-১ আসনে গিয়ে বলছে, ‘ডুবাই দে’!
এ অবস্থায় সুনামগঞ্জের এ দুটো আসনে ভোটের রাজনীতিতে গোষ্ঠী-গোত্র-ধর্মই প্রাধান্য পাচ্ছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ সুযোগে সেই পুরোনো হিসাব ক্রমশ ডালপালা বিস্তার করছে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জ-১ আসনের জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নৌকার প্রার্থীকে হারানো ‘ঈমানি দায়িত্ব’ বলে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়েছেন। এদের অনুসারীরা সীমানা পেরিয়ে সুনামগঞ্জ-২ আসনে গিয়ে একাত্ম হচ্ছেন নৌকার প্রার্থীর পক্ষে। এ যেন এক মুখে, এক সুরে দুই জোঁশ ‘বাইয়া দে, ডুবাই দে’!
ভোটের রাজনীতিতে জলাভূমি বা হাওরাঞ্চলের আসন হিসেবে পরিচিতি সুনামগঞ্জ-১ ও ২ নির্বাচনি এলাকা। দুটো এলাকা পাশাপাশি। সুনামগঞ্জ-১ আসনভুক্ত চারটি উপজেলা। জামালগঞ্জ-ধরমপাশা-তাহিরপুর-মধ্যনগর। সুনামগঞ্জ-২ আসন গঠিত হয়েছে দিরাই ও শাল্লা উপজেলা নিয়ে। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলখ্যাত রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ার পেছনে রয়েছেন প্রয়াত দুই রাজনীতিবিদ। একজন গণমানুষের রাজনীতিবিদ বরুণ রায়, অন্যজন পার্লামেন্টারিয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
১৯৮৬ সালে সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বাম রাজনীতিবিদ বরুণ রায় প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই সময় তার রিক্রুটে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সুনামগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত হয়ে নৌকার প্রার্থী হয়েছিলেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে বরুণ রায় অবসর নেওয়ায় আর প্রার্থী হননি। তবে দুটো আসনের একটি সুনামগঞ্জ-১ আসনটি তখন হাতছাড়া হয় নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়ে দল বদল করায়। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেন বিএনপিতে যোগ দেন। এ আসনে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে ২০০১ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সুরঞ্জিত ২০০১ সালের নির্বাচনে দুটো আসনে নির্বাচন করায় রাজনীতির বাইরে ধর্ম-গোত্র চরিত্র ডালপালা বিস্তার করে। সেই নির্বাচনে সুরঞ্জিত সুনামগঞ্জ-১ আসনে হেরেছিলেন যে কারণে, ঠিক একই কারণে তার নির্বাচনি এলাকাখ্যাত সুনামগঞ্জ-২ আসনে চলছে নানা অপপ্রচার।
সাতবার নির্বাচন করায় প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনি এলাকা সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনটি ভোটের রাজনীতিতে ‘সুরঞ্জিতের আসন’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেলে তার স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্তা ওই বছরের ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের দ্বিতীয়বার মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে এবার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (আল-আমিন চৌধুরী)। তিনি শাল্লা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ছোট ভাই। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জয়া সেনগুপ্তা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তার প্রতীক কাঁচি। ভোটাররা বলছেন, জয়া সেনগুপ্তার অনুসারীরা সরাসরি বিভাজন তৈরি করছেন। এতে করে প্রতিবেশী নির্বাচনি এলাকা সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে লোকজন দিরাই-শাল্লায় এসে প্রভাব বিস্তার করছেন।
সুনামগঞ্জ-১ আসনে সমানতালে তিন প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন নতুন মুখের প্রার্থী, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত সরকার। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দলের তিনবারের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (কেটলি)। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সেলিম আহমদ লড়ছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে। ভোটের মাঠে তিনজনেই শক্তিশালী।
স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে জানা গেছে, বিভাজন রেখা বা এক নৌকার স্লোগানে দুই রকম জোঁশের সূত্রপাত হয়েছে সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে। গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ধর্মপাশার গোলকপুরের প্রচার সভায় জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নবী হোসেন সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেন। এ বক্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে পুরো নির্বাচনি এলাকায়। ভিডিওতে দেখা গেছে, ভোটারদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ আর ১৩ শতাংশ ভোটার উল্লেখ করে ‘ঈমানি দায়িত্ব’ পালন করার কথা বলছেন। একই অনুষ্ঠানে জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী ‘গরু’ ও ‘নিরামিষ’ তত্ত্ব তুলে ধরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ইঙ্গিত করেন।
দুই নেতার এমন বক্তব্য চলাকালে বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন রতন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ‘এগুলো কথার কথা। প্রসঙ্গে এসেছে। সিরিয়াস কোনো বিষয় নয়’ বলে এড়িয়ে যান। তবে বিষয়টি ‘সিরিয়াস’ বলে মনে করছেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা মুকুট। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘এসব ব্যাপার মোটেও ছাড় দেওয়ার কোনো বিষয় নয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে শোকজ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অনুসন্ধান কমিটিও বিষয়টি দেখছে। ভোটের পরে সাংগঠনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’