বাঙালির পড়াশোনা শুরু হয় বর্ণপরিচয় বইটি দিয়ে। কেউ পড়েছেন রামসুন্দর বসাক প্রণীত ‘আদি বাল্যশিক্ষা’, কেউ পড়েছেন সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি’। ১৮৪৯ থেকে ১৯৪৮, এই ১০০ বছরে প্রকাশিত আটটি বাল্যশিক্ষা বা বর্ণপরিচয় বইয়ের সংকলন করেছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। সেসব কীভাবে ছাপা হতো তার ধারণা দিতে আয়োজন করা হয়েছে প্রদর্শনী ‘প্রাইমার টু প্রেস’।
শুক্রবার (৩ মে) বিকেলে রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী।
আদিকালে হরফ সাজিয়ে কীভাবে বাংলা বর্ণ ছাপা হতো, সেটা দেখানোর জন্য প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে একটি লেটার প্রেস যন্ত্র। একজন মুদ্রাকর দর্শনার্থীদের সরাসরি ছাপার প্রক্রিয়া দেখাচ্ছেন। গ্যালারির দেয়াল জুড়ে সাজানো হয়েছে বর্ণপরিচয়ের ১০০ বছরের মধ্যে প্রকাশিত বইগুলোর নানা বর্ণ, শব্দ ও বাক্যের ছবি। শিল্পীর সংগৃহীত পুরাতন বই, বিভিন্ন সময়ের হরফের নমুনাও সেখানে দেখা যাবে।
নাতিদীর্ঘ একটি পর্দায় এসব নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও রয়েছে প্রদর্শনীতে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন, প্রখ্যাত নকশাকার চন্দ্র শেখর সাহা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার পরিচালক ফ্রঁসোয়া ঘ্রোজঁ এবং কণ্ঠশিল্পী রাহুল আনন্দ।
অতিথিরা ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। বইটি প্রকাশ করেছে কবি প্রকাশনী।
ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে, এর লেটারিং, সম্পাদনা এবং মুদ্রণ কৌশলের বিবর্তন উন্মোচন করেছেন সব্যসাচী হাজরা।
সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ‘সব্যসাচী হাজরার কাছে আমাদের নতুন প্রজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবে, কারণ তিনি এ রকম একটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। বহু বছর পরে বর্ণমালা নিয়ে এ রকম গবেষণা হচ্ছে, এটা আশার সঞ্চার করে।’
সব্যসাচী হাজরা বলেন, ‘‘বাংলা বর্ণমালা সেই আদিকাল থেকে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের রূপে এসেছে। এক সময় আমাদের হরফ কীভাবে তৈরি হতো এবং তা কীভাবে ছাপা হতো, তার একটা ধারণা মিলবে এই প্রদর্শনী থেকে। আমাদের বর্ণমালা নিয়ে বিভিন্ন সময় ‘বর্ণমালা পরিচয়’-এর বই বেরিয়েছে। সেগুলো একসঙ্গে করে সংকলটি প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রদর্শনী ও বই আমাদের বর্ণমালার সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেবে।’’
প্রদর্শনীর কথা আগাম প্রচার করা হয়েছিল। তাই সেটি উপভোগ করার জন্য এসেছিলেন বহু মানুষ।
ব্যাংকার স্বামী ও দুই সন্তান তিরান ও রাঈফকে নিয়ে প্রদর্শনীতে এসেছিলেন রুনালিসা শাহরিয়ার। তিনি জানান এই শিল্পীর সব কাজের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলা বর্ণের বিবর্তন সম্পর্কে সন্তানদের ধারণা দিতে এ রকম প্রদর্শনী অনন্য। আমি চাই ওরা প্রদর্শনী দেখুক, মায়ের ভাষার বর্ণের সঙ্গে ওদের সম্পর্কটা আরও নিবিড় হোক।’
কথা হয় কবি প্রকাশনীর প্রকাশক সজল আহমেদের সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘অনেক পরিশ্রম ও খাটাখাটনি করে আমরা এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি। বইটি যাতে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছায় সে জন্য মুদ্রণব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে রাখা হচ্ছে। অনেকটা শিল্প ও সামাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কাজটা করেছি আমরা।’
সব্যসাচী হাজরা একজন শিল্পী ও লেখক। পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগে। প্রচ্ছদ, ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন এবং ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি ডিজাইন থেকে শুরু করে প্রকাশনা শিল্পে লেআউট, ইলাস্ট্রেশন, টাইপফেস অবধি তার কর্মপরিধি বিস্তর। বিভিন্ন সময়ে বহু বই, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, নকশা, অলংকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। মুদ্রণ এবং প্রকাশনার তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি।
এর আগে তিনি লিখেছেন ‘ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি’, ‘রং তুলিতে ছোপছাপ’ এবং ‘চিত্রলিপি’ বইগুলো। ‘বাংলা নামের দেশের গল্প’ বইটি সম্পাদনা করেছেন তিনি।
নতুন বইটিতে সংকলিত হয়েছে মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত ‘শিশুশিক্ষা’, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাক প্রণীত ‘বাল্যশিক্ষা’, সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শ লিপি’, যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রণীত ‘হাসিখুসি’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ‘চিত্রাক্ষর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ও নন্দলাল বসু অলংকৃত ‘সহজ পাঠ’ এবং বিপলচন্দ্র ঘোষ প্রণীত সত্যজিৎ রায় অলংকৃত ‘হাতেখড়ি’ বইগুলো।
সব্যসাচী হাজরার প্রদর্শনী চলবে ১৮ মে পর্যন্ত। রবিবার বাদে সোম থেকে শনিবার প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রদর্শনী ঘুরে আসা যাবে। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত।
অমিয়/