মানবসেবা, প্রকৃতিপ্রেম কিংবা সমাজ সংস্কারের পথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, রচনাবলি তারুণ্যকে শাশ্বত-সুন্দর সত্যের পথ দেখিয়েছে। সামাজিক প্রেক্ষাপটে দিগভ্রান্ত বহু তরুণ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথে। বিশ্বকবির সুর-বাণীতে মন্ত্রমুগ্ধ সেই তরুণরা নিজেদের সমর্পণ করেছেন মানবকল্যাণের পথে। আজ বুধবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকীর প্রেক্ষাপটে এসে তরুণ প্রজন্ম বলছে, সব কূপমণ্ডূকতা মুছে ফেলে সমাজ সংস্কারের পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতায় তারা খুঁজে চলেছেন মানবমুক্তির পথ। তবে আধুনিকতার বলয়ে পপ, ফোক বা পাশ্চাত্যের সংগীতের জোয়ারে গা-ভাসানো তরুণ প্রজন্ম দিনে দিনে রবীন্দ্র সংগীতকে ধারণ ও চর্চা করা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যেখান থেকে এই প্রজন্মকে রবীন্দ্র চেতনতায় ফেরানোর কাজ করে যাচ্ছেন শিল্পী-সংগঠকরা।
জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী অনামিকা রায় বলেন, ‘যাপিত জীবনের প্রতিটি পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার কাছে একেকটি চরিত্র হয়ে যেন এসেছেন। রবীন্দ্রনাথকে কখনো প্রভাবশালী রাজপুত্র, কখনো ধ্যানমগ্ন যোগী, কখনো সর্বহারা এক বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে দেখেছি। কবিগুরুর প্রেম, প্রকৃতি ও পূজা পর্যায়ের গানগুলো প্রাত্যহিক জীবনে আনে নতুন ভাবনার খোরাক।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা প্রকৃতি সাহা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে গেছে। জীবনের আনন্দ-বেদনা, উৎসব কোন পর্বে নেই রবীন্দ্রনাথ! যাপিত জীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই তিনিই তো সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।’
তরুণ নৃত্যশিল্পী ও চিকিৎসক স্মিতা দে ঘোষ বেশ কয়েক বছর ধরে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ‘চণ্ডালিকা’য় নাম ভূমিকায় পারফর্ম করছেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে মুখ্য চরিত্রে তুলে ধরেছেন নিম্ন বর্ণের এক নারীর জীবন। আমি সাধারণ শহুরে জীবনে অভ্যস্ত। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য বরাবরই কঠিন। চণ্ডালিকা চরিত্রকে ধারণ করা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। আর চিকিৎসা পেশায় আমাকে দিন-রাত সজাগ থাকতে হয়; কখনো অবসাদ এসে ঘিরে ধরে আমাকেও। আমি তখন নিজেকে প্রফুল্ল রাখতে ভরসা খুঁজি রবীন্দ্র সংগীতে।’
তরুণ প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীদের সবাই যে রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসেন এমনটি নয়। পপ, ফোক বা পাশ্চাত্যের সংগীতে মজে থাকা তরুণদের কজনের সঙ্গে কথা বলে খবরের কাগজ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী মাহরুবা রহমান বলেন, রবীন্দ্রসংগীতের প্রতিটি শব্দ তার ভীষণ পছন্দের। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা বলেন, মানসিক অবসাদ কাটাতে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শোনেন। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাদিয়া আহমেদ বলেন, ‘আমি হার্ড রক, মেটালিক ভালোবাসী। রবীন্দ্রসংগীত খুব ধীর লয়ের গান। আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না।’
তরুণ প্রজন্মের রবীন্দ্র ভাবনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান মনিরা পারভীন বেশ আশাবাদী। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘১৬৩ বছর কেটে গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, ছোটগল্প বা প্রবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। সংস্কৃতিমনা মানুষ এখনো তার ওপর নির্ভরশীল। সেই জায়গাটি থেকে যারা এখন রবীন্দ্রনাথের গান বা নৃত্যনাট্য নিয়ে চর্চা করছেন, তারা রবীন্দ্রনাথের বার্তা আত্মোপলব্ধি করেই কিন্তু চর্চা করছেন। ‘শ্যামা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘নটীর পূজা’ বা ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য নিয়ে যে তরুণরা কাজ করছেন; তারা রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন, রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে ধারণ করেই তারা রবীন্দ্রচর্চা করছেন।’
তবে উল্টো চিত্রও আছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকে রবীন্দ্র সংগীত শিখতে এলেও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সর্বনাশ ডেকে আনছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সভাপতি সাজেদ আকবর। তিনি বলেন, ‘অভিভাবকরা বুঝতে চাইছেন না, কোনো শর্ট কোর্স করে, দু-চারটি গান শিখে রাতারাতি শিল্পী হওয়া যায় না। আর অনেক তরুণ রবীন্দ্রসংগীত শিখেও তা সঠিকভাবে চর্চা করেন না। তাই তারা হারিয়ে যাচ্ছেন।’
ঢাকার নাট্যমঞ্চে একসময় রবীন্দ্রনাথের নাটক বেশ সাড়া ফেললেও তরুণ নাট্যকারদের মধ্যে এখন রবীন্দ্র নাটক নিয়ে নিরীক্ষা বেশ কম। ঢাকার নাটকের দলগুলো ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’, ‘বিসর্জন’, ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘রাজা ও অন্যান্য’-এর মতো নাটকগুলো মঞ্চে এনে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তবে তরুণ নাট্যকাররা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিরীক্ষায় বেশ পিছিয়ে রয়েছেন।
এ বিষয়ে ‘মঞ্চসারথি’ আতাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই মনে করেন, তিনি একজন ঋষি কবি। কিন্তু তার সমাজ সচেতনতা বা রাজনীতিবিষয়ক ভাবনার কথা কি তরুণরা ভাবছেন? জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে রবীন্দ্রনাথ যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন ‘মুক্তধারা’ নাটকে, সে দিকগুলোর কথা নিয়ে তরুণরা খুব বেশি জানেন বলে মনে হয় না।’
ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথকে পরিত্যাজ্য করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটি পারা যায়নি বাঙালির প্রবল প্রতিবাদে। এখন দেখা যাচ্ছে, সমাজে পবিত্র ধর্মের নামে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রয়াস চলছে। সেখানে আমরা প্রচেষ্টা করছি রবীন্দ্রনাথের সুর বাণী নিয়ে সর্বজনের কাছে যেতে। তবে কেবল সঠিক সুরে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে দর্শকদের মোহিত করলাম, তাতে কিন্তু চলবে না। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী তো আগে অন্তরে ধারণ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাংলাদেশে এসেই সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দরিদ্র জনের সঙ্গে তার সংযোগ এই বঙ্গেই। সে কথা তরুণদের অনুধাবন করতে হবে।’
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লিলি ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুধু রবীন্দ্রসংগীত শেখানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। রবীন্দ্রনাথের বাণীই তো আসল, সুর তার অনুষঙ্গ। সেই বাণী নিয়ে যাচ্ছি তরুণদের কাছে। কবিগুরুর বাণীতে তরুণদের উজ্জ্বীবিত করে তাদের শুদ্ধ, পরিশীলিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে কাজ করছি আমরা।’
সংকটে রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম উত্তরণের নিয়ামক
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্য প্রেরণাশক্তি। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে প্রাচ্যদেশ থেকে এক মহামানবের আগমন প্রত্যাশা করেছিলেন, সবসংকট-সমস্যায় যিনি হবেন কাণ্ডারি। তিনি আর কেউ নন- স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে মহান ভাবাদর্শে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল অঙ্গীভূত।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ-বিগ্রহপূর্ণ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম হতে পারে উত্তরণের নিয়ামক শক্তি। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের মধ্যেই আমরা পেতে পারি মানসিক শান্তি ও কাঙ্ক্ষিত অনুপ্রেরণা।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ‘রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ-সংঘাত, হিংসা-হানাহানি আর সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন উল্লম্ফন তা নিরসনে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন প্রধান নিয়ামক শক্তি।’
দেশব্যাপী নানা আয়োজন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি নিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সোনার বাংলা স্বপ্ন ও বাস্তবতা: রবীন্দ্রনাথ থেকে বঙ্গবন্ধু।’ এ বছর রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠান হবে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি। আজ সকাল ১১টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে তিন দিনব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধন করবেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খানের সভাপতিত্বে স্মারক বক্তব্য দেবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। তিন দিনের অনুষ্ঠানে থাকবে স্মারক বক্তব্য। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও অধ্যাপক ফকরুল আলম। তৃতীয় দিন বক্তব্য দেবেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. শাহ আজম। তিন দিনের অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার পর্ব থাকছে।
জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার পতিসরে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে।
রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে ছায়ানটের দু-দিনব্যাপী রবীন্দ্র-উৎসব শুরু হবে আজ সন্ধ্যা ৭টায়। এই উৎসবে পরিবেশিত হবে একক ও সম্মিলিত গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি। অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবেন।
‘বিমল আনন্দে জাগো’ শিরোনামে তিন দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা। আজ সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। তিন দিনের অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে গান, কবিতা ও নৃত্যের সমন্বয়ে। ১১ মে সন্ধ্যায় এই আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সংগীতের একজন গুণী শিল্পীকে দেওয়া হবে কলিম শরাফী স্মৃতি পুরস্কার।