চীনের শেনজেনভিত্তিক বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিল্ড ইয়োর ড্রিমস বা বিওয়াইডির গাড়ি দেশের বাজারে এনেছে সিজি-রানার বাংলাদেশ লিমিটেড। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সেডান মডেলের প্রিমিয়াম বিওয়াইডি সিলের দুটি সংস্করণ উন্মোচন করেছে। কয়েক সপ্তাহ বাজার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ শেষে আগামী মে মাস থেকে দেশের সড়কে নামার অপেক্ষায় রয়েছে এই ব্র্যান্ডের গাড়ি।
প্রাথমিক অবস্থায় বিওয়াইডি সিল এক্সটেন্ডেড ও পারফরম্যান্স মডেলের দুটি গাড়ি দেশের বাজারে পাওয়া যাবে। বিওয়াইডি সিলের রিয়ার হুইল ড্রাইভ সংস্করণটি এক চার্জে ৫৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে সক্ষম। এটির আনুমানিক দাম এক কোটি থেকে এক কোটি ১০ লাখ টাকার মধ্যে হবে।
অন্যদিকে অল-হুইল ড্রাইভ (এডব্লিউডি) সংস্করণটি এক চার্জে মাইলেজ দেবে ৫২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সম্প্রতি নেপালে এই সংস্করণের ঘোষিত দাম আগের সংস্করণ থেকে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি হওয়ার দিকে ইঙ্গিত দেয়।
বিওয়াইডির পরিবেশক সিজি-রানার বাংলাদেশ লিমিটেড চলতি মাসে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্রথম নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। ৮ হাজার ৪০০ বর্গফুটের বিক্রয়কেন্দ্রে একসঙ্গে পাঁচটি গাড়ি প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে।
বিওয়াইডি উদ্ভাবিত নিজস্ব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সিল গাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে। এনইভি বা নিউ এনার্জি ভেহিকেল শ্রেণিতে সিলে রয়েছে এআই-প্ল্যাটফর্ম ৩.০। এতে প্রথমবারের মতো ‘সেল টু বডি’ অর্থাৎ সিটিবি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। স্যান্ডউইচ প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়িতে ব্লেড ব্যাটারি স্থাপন করা হয়েছে। সিটিবি প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্লেড ব্যাটারি নিজেই একটি শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করবে। গাড়িতে ৮২ দশমিক ৫ কিলোওয়াটের ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩ দশমিক ৮ সেকেন্ডে বিওয়াইডি সিল পারফরম্যান্স শূন্য থেকে ১০০ কিলোমিচার পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম। গাড়িটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার।
গাড়িটিতে আইট্যাক বা ইন্টেলিজেন্স টর্ক অ্যাডাপশন কন্ট্রোল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির কারণে পিচ্ছিল রাস্তায়ও টর্ক নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যাবে। ফলে গাড়ির যাত্রীরা পাবে বাড়তি নিরাপত্তা। দ্রুতগতির এই গাড়ির চার চাকাতেই রয়েছে ডিস্ক ব্রেক। অ্যাডাপটিভ সাসপেনশন থাকায় অমসৃণ রাস্তাতেও কোনো ঝাঁকুনি অনুভব হবে না।
এতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে হিট পাম্প রয়েছে। এই পাম্পের কারণে ব্যাটারি দ্রুত শীতল হবে এবং কম শক্তি খরচ করে দূরত্ব পাড়ি দেবে। স্লান্টেড রুফলাইন, শর্ট রিয়ার ডেক, ওয়াটারড্রপ মিরর, ওয়েভ ওয়েস্টলাইন ও পিএম ২.৫ ফিল্টারেশন সুবিধা গাড়িকে অনন্য করেছে। ইন্টেলিজেন্ট ককপিট সিস্টেম চালক ও যাত্রীকে বাড়তি সুবিধা দেবে। ১৯ ইঞ্চির চাকাগুলো যাত্রাপথে আলাদা স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। সিল গাড়ির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা যথাক্রমে ৪৮০০, ১৮৭৫ এবং ১৪৬০ মিলিমিটার।
সিল গাড়ির সামনের দিকের নকশা ‘এক্স’ আকৃতির। স্পোর্টস সেডান ধারার এই গাড়ির কাঠামো অ্যারোডাইনামিক নকশায় তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য গাড়িটি বাতাসের প্রতিকূলে আরও সাবলীলভাবে ছুটে চলতে পারে। ‘ইউ’ আকৃতির ব্যাকলাইট গাড়ির দৃশ্যমানতা প্রকাশ করে।
গাড়িতে রয়েছে ১৫.৬ ইঞ্চির মাল্টিমিডিয়া টাচ স্ক্রিন। পর্দা সোজাসুজি এবং আড়াআড়ি দুভাবেই ব্যবহার করা যাবে। চারটি এসি ভেন্ট রয়েছে গাড়ির ভেতরে সামনের সারিতে। মাল্টিমিডিয়া ডিসপ্লের মাধ্যমে এই ভেন্টগুলোর বাতাস প্রবাহের দিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভয়েস কন্ট্রোলারের মাধ্যমেও গাড়িটিতে বিভিন্ন নির্দেশ দেওয়া যায়।
এই গাড়িতে রয়েছে ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা সুবিধা। গাড়ি চালানোর সময় যদি কোনো গাড়ি কাছাকাছি চলে আসে, তবে ক্যামেরাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে, তা ডিসপ্লেতে দেখা যাবে। এ ছাড়া ডানে বা বাঁয়ে সিগন্যাল লাইট জ্বালালেও ক্যামেরায় আশপাশের দৃশ্য পর্দায় দেখা যাবে। গাড়ি ডানে-বাঁয়ে অথবা সামনে-পেছনে চালানোর সময় ডিসপ্লেতে চাকার অবস্থান দেখা যাবে। পুরো গাড়িতে রয়েছে ‘মিউজিক সেন্সড অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট।’ গাড়িতে আরাম-আয়েসে বসার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। সবগুলো আসনেই পা রাখার প্রশস্ত জায়গা রয়েছে। এই গাড়ি একেবারেই শব্দহীন। সাউন্ডপ্রুফ ক্যাবিনেট থাকার কারণে বাইরের কোনো শব্দ ভেতরে প্রবেশ করে না। মসৃণ রাস্তায় গাড়ির গতি খুব একটা বোঝা যায় না। অনেক গতিতে গাড়িটি চালানোর সময় উচ্চ গতি বোঝা যায় না।
চালকের পাশের দরজা খুলতেই আসনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেছনে গিয়ে গাড়িতে ঢোকার জায়গা বেড়ে যায়। এই গাড়িতে ‘সিট মেমোরি’ রয়েছে। চালক নিজের পছন্দমতো লেগস্পেস ও স্টিয়ারিং হুইলের অবস্থান বের করে মেমোরিতে সংরক্ষণ করেতে পারেন। গাড়িতে চালক ঢোকার পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসন ও স্টিয়ারিং সেই অবস্থানে চলে আসবে। গাড়িটির গিয়ার প্যানেলটা বেশ নান্দনিক। গাড়িটি চালু বা বন্ধ, হ্যাজার্ড, অটো হোল্ড, শব্দ নিয়ন্ত্রণ, ড্রাইভিং মোড পরিবর্তনসহ প্রায় সব কাজ এই অংশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
গিয়ার শিফটারের সামনে একসঙ্গে দুটি স্মার্টফোন চার্জ করা যায়। গাড়ির যাত্রী আসনের সারিতেও রয়েছে আলাদা এসি ভেন্ট। সিলে রয়েছে হাই-ফাই ডাইন অডিও প্রিমিয়াম সাউন্ড বুস্টসমৃদ্ধ ১২টি স্পিকার, যা গাড়িতে হোম থিয়েটারের মতো অনুভূতি দেবে। বৈদ্যুতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সামনের আসনগুলোয় রয়েছে হিটেড এবং কুলিং সিট অপশন। দীর্ঘ পথে অথবা অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় চালক বা যাত্রীর ক্লান্তি দূর করতে এই সুবিধাটি বেশ উপকারী।
এই গাড়ির নান্দনিক দিক হলো প্যানারমিক মুনরুফ। সম্পূর্ণ ছাদই মুনরুফ। দিনের বেলায় গাড়ির মধ্য থেকে আকাশ দেখা যাবে। মুনরুফটি অতি বেগুনি রশ্মি (ইউভি) প্রতিরোধক। এতে সূর্যের আলো ঢুকলেও তাপমাত্রা বাড়াবে না।
বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আগ্রহী ক্রেতারা বিওয়াইডি গাড়ির অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। ক্রেতাদের সুবিধার্থে বিক্রয়কেন্দ্রে দুটি চার্জিং স্টেশন রয়েছে। ইভি বিক্রেতাদের মতে, বাণিজ্যিক চার্জিং স্টেশনগুলোয় সব ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় ৪৫ মিনিটে চার্জ করা যাবে। অন্যদিকে বাড়িতে চার্জ করতে সময় লাগবে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল এক হাজার টাকার কম হবে। এখনো দেশে চার্জিং স্টেশনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে না ওঠায়, প্রথমদিকে এর ব্যবহারকারীদের চার্জিং নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে। দেশে যে ৩টি ইভি চার্জিং স্টেশন রয়েছে, সেগুলোর অবস্থানও রাজধানীতে। তবে সারা দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্য দেশের সক্রিয় ইভি ব্যবসায়ীরা চার্জিং নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য উদ্যোগ খুঁজছেন। আগামী জুনে রাজধানীতে ৮টি, কুমিল্লায় এবং চট্টগ্রামে একটি করে মোট ১০টি চার্জিং স্টেশন চালু হবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ৩০টি স্টেশন চালু হবে।
এ.জে/জাহ্নবী