মধুমাস কোনটি? অনেকেরই মনে হতে পারে, আরে মুধমাস তো জ্যৈষ্ঠ মাস। আসলেই কি তাই?
‘বসন্ত’ নামে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আছে। কবিতাটি এমন-
‘অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটিরপ্রাঙ্গণে
পীতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উম্মাদ পবনে
মন্দারমঞ্জরী,
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু-
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।
সখা, সেই অতিদূর সদ্যোজাত আদি মধুমাসে
তরুণ ধরায়
এনেছিলে যে কুসুম ডুবাইয়া তপ্ত কিরণের
স্বর্ণমদিরায়...
ব্যর্থ জীবনের সে কয়খানি পরম অধ্যায়
ওগো মধুমাস,
তোমার কুসুমগন্ধে বর্ষে বর্ষে শূন্যে জলে স্থলে
হইবে প্রকাশ।
বকুল চম্পকে তারা গাঁথা হয়ে নিত্য যাবে চলি
যুগ যুগান্তরে,
বসন্তে বসন্তে তারা কুঞ্জে কুঞ্জে উঠিবে আকুলি
কুহুকলস্বরে।
অমর বেদনা মোর হে বসন্ত, রহি গেল তব
মর্মরনিশ্বাসে
উত্তপ্ত যৌবনমোহ রক্তরৌদ্রে রহিল রঞ্জিত
চৈত্রসন্ধ্যাকাশে।
কবিতার শব্দগুলো একটু কঠিন মনে হতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে পড়লে কিন্তু জবাব পেয়ে যাবে, আসলে মধুমাস কোনটি?
এবার জানা যাক ‘মধুমাস’ নামটা কী করে এলো?
শব্দটির খোঁজ পাওয়া যাবে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় সমার্থকোষ অভিধান’ থেকে। ওখানে বলা হয়েছে- ‘চৈত্র মাসকে কেন মধুমাস বলা হয়, তার কারণ জানা যায় ‘বসন্ত’ শব্দ থেকে। দুধের থেকে সর, সর থেকে ঘোল-মাখন হয়ে ঘি-এ পৌঁছানো যায়। সেই সুবাদে মধু হলো ঘি। ঠিক সেইরূপ বৈশাখ থেকে বসবাস ও বর্ষের শুরু এবং তার চূড়ান্ত হয় বসন্তে। সেই বসন্তের শেষ মাস হলো চৈত্র মাস। গ্রহণ-বর্জন-পুনরুৎপাদনের নীতিতে চলা মানবজীবনের জৈবিক সার্থকতা পুনরুৎপাদনে। বসন্তের অন্তে বা চৈত্র মাসে মানুষের প্রতিপালন প্রাচীন শব্দবিদগণের অখণ্ড চিন্তাশৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সেই কারণে তারা চৈত্র মাসকে মধুমাস নাম দিয়েছিলেন।’
হিন্দি ভাষায় ‘বাহারি’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অন্যদিকে ফারসিতে ‘বহার’ মানে বসন্তকাল। ‘বহারি’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়। ষোড়শ শতকের বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেছেন, ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ বসন্তের সখা কোকিল। এই কোকিলের আরেক নাম হলো ‘মধুসখা’।
খনার বচনেও আছে-
‘মধুমাসে ত্রয়োদশ দিনে রয় শনি
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্য হানি।’
অথবা-
‘মধুমাসে প্রথম দিবসে হয় যেই বার।
রবি শোষে, মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাওয়ালী সুরে একটি গান লিখেছেন। সে গান হচ্ছে-
মাধবী-তলে চলো মাধবিকা দল
আইল সুখ-মধুমাস।
বহিছে খরতর থর থর মরমর
উদাস চৈতি-বাতাস।
পিককুল কলকল অবিরল ভাষে,
মদালস মধুপ পুষ্পল বাসে।
বেণু-বনে উঠিছে নিশাস।
তরুণ নয়নসম আকাশ আনীল,
তটতরু ছায়া ধরে নীর নিরাবিল,
বুকে বুকে স্বপন-বিলাস।
এ গানেও কিন্তু মধুমাস হিসেবে চৈত্র মাসকেই বুঝিয়েছেন কাজী নজরুল। আর এর পরও যদি মধুমাস নিয়ে কারও সন্দেহ থাকে, তবে বাংলাসাহিত্যের আরও অনেক বিখ্যাত কবি ও লেখক রয়েছেন, তাদের লেখায় মধুমাসের সন্ধান পাওয়া যাবে। যেমন পঞ্চদশ শতকের কবি বিদ্যাপতি, ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক কবি ও লেখকের লেখায় মধুমাস হিসেবে চৈত্র মাসকেই চিহ্নিত করেছেন।
কাজেই মধুমাস কোনটি এ নিয়ে কিন্তু আর বিতর্ক থাকার কোনো মানে হয় না। সোজা কথায়, ফুল ফোটে বসন্তে। মানে চৈত্র মাসে। ফুলের মধ্যে মধু থাকে। কাজেই মধুমাস চৈত্র হওয়াটাই স্বাভাবিক।
জাহ্নবী