ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

মধুমাস কোনটি?

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:২২ পিএম
মধুমাস কোনটি?

মধুমাস কোনটি? অনেকেরই মনে হতে পারে, আরে মুধমাস তো জ্যৈষ্ঠ মাস। আসলেই কি তাই?
‘বসন্ত’ নামে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আছে। কবিতাটি এমন-
‘অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটিরপ্রাঙ্গণে
পীতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উম্মাদ পবনে
মন্দারমঞ্জরী,
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু-
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।
সখা, সেই অতিদূর সদ্যোজাত আদি মধুমাসে
তরুণ ধরায়
এনেছিলে যে কুসুম ডুবাইয়া তপ্ত কিরণের
স্বর্ণমদিরায়...
ব্যর্থ জীবনের সে কয়খানি পরম অধ্যায়
ওগো মধুমাস,
তোমার কুসুমগন্ধে বর্ষে বর্ষে শূন্যে জলে স্থলে
হইবে প্রকাশ।
বকুল চম্পকে তারা গাঁথা হয়ে নিত্য যাবে চলি
যুগ যুগান্তরে,
বসন্তে বসন্তে তারা কুঞ্জে কুঞ্জে উঠিবে আকুলি
কুহুকলস্বরে।
অমর বেদনা মোর হে বসন্ত, রহি গেল তব
মর্মরনিশ্বাসে
উত্তপ্ত যৌবনমোহ রক্তরৌদ্রে রহিল রঞ্জিত
চৈত্রসন্ধ্যাকাশে।

কবিতার শব্দগুলো একটু কঠিন মনে হতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে পড়লে কিন্তু জবাব পেয়ে যাবে, আসলে মধুমাস কোনটি? 
এবার জানা যাক ‘মধুমাস’ নামটা কী করে এলো?

শব্দটির খোঁজ পাওয়া যাবে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় সমার্থকোষ অভিধান’ থেকে। ওখানে বলা হয়েছে- ‘চৈত্র মাসকে কেন মধুমাস বলা হয়, তার কারণ জানা যায় ‘বসন্ত’ শব্দ থেকে। দুধের থেকে সর, সর থেকে ঘোল-মাখন হয়ে ঘি-এ পৌঁছানো যায়। সেই সুবাদে মধু হলো ঘি। ঠিক সেইরূপ বৈশাখ থেকে বসবাস ও বর্ষের শুরু এবং তার চূড়ান্ত হয় বসন্তে। সেই বসন্তের শেষ মাস হলো চৈত্র মাস। গ্রহণ-বর্জন-পুনরুৎপাদনের নীতিতে চলা মানবজীবনের জৈবিক সার্থকতা পুনরুৎপাদনে। বসন্তের অন্তে বা চৈত্র মাসে মানুষের প্রতিপালন প্রাচীন শব্দবিদগণের অখণ্ড চিন্তাশৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সেই কারণে তারা চৈত্র মাসকে মধুমাস নাম দিয়েছিলেন।’

হিন্দি ভাষায় ‘বাহারি’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অন্যদিকে ফারসিতে ‘বহার’ মানে বসন্তকাল। ‘বহারি’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়। ষোড়শ শতকের বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেছেন, ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ বসন্তের সখা কোকিল। এই কোকিলের আরেক নাম হলো ‘মধুসখা’।

খনার বচনেও আছে-
‘মধুমাসে ত্রয়োদশ দিনে রয় শনি
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্য হানি।’
অথবা-
‘মধুমাসে প্রথম দিবসে হয় যেই বার।
রবি শোষে, মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।’
 
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাওয়ালী সুরে একটি গান লিখেছেন। সে গান হচ্ছে-
মাধবী-তলে চলো মাধবিকা দল
আইল সুখ-মধুমাস।
বহিছে খরতর থর থর মরমর
উদাস চৈতি-বাতাস।
পিককুল কলকল অবিরল ভাষে,
মদালস মধুপ পুষ্পল বাসে।
বেণু-বনে উঠিছে নিশাস।
তরুণ নয়নসম আকাশ আনীল,
তটতরু ছায়া ধরে নীর নিরাবিল,
বুকে বুকে স্বপন-বিলাস।

এ গানেও কিন্তু মধুমাস হিসেবে চৈত্র মাসকেই বুঝিয়েছেন কাজী নজরুল। আর এর পরও যদি মধুমাস নিয়ে কারও সন্দেহ থাকে, তবে বাংলাসাহিত্যের আরও অনেক বিখ্যাত কবি ও লেখক রয়েছেন, তাদের লেখায় মধুমাসের সন্ধান পাওয়া যাবে। যেমন পঞ্চদশ শতকের কবি বিদ্যাপতি, ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক কবি ও লেখকের লেখায় মধুমাস হিসেবে চৈত্র মাসকেই চিহ্নিত করেছেন।

কাজেই মধুমাস কোনটি এ নিয়ে কিন্তু আর বিতর্ক থাকার কোনো মানে হয় না। সোজা কথায়, ফুল ফোটে বসন্তে। মানে চৈত্র মাসে। ফুলের মধ্যে মধু থাকে। কাজেই মধুমাস চৈত্র হওয়াটাই স্বাভাবিক।

জাহ্নবী

সুন্দর পাখি টোকো টোকান

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৪ পিএম
সুন্দর পাখি টোকো টোকান
টোকো টোকান অত্যন্ত সামাজিক পাখি। ছবি সংগৃহীত

টোকো টোকান অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর পাখি। এদের মূলত দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এদের চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হলো তাদের বিশাল ও রঙিন ঠোঁট। এটি শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

শারীরিক গঠন
টোকো টোকান হলো টোকান প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় পাখি। একটি পূর্ণবয়স্ক টোকো টোকানের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওজন হয় প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম। এদের ঠোঁট প্রায় ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে, যা পুরো দেহের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। ঠোঁটটি দেখতে ভারী মনে হলেও এটি আসলে খুব হালকা। কারণ এটি কেরাটিন নামক এক ধরনের প্রোটিন দিয়ে তৈরি, যার ভেতরটা ফাঁপা।
এই ঠোঁটটি কমলা, হলুদ ও লাল রঙের সংমিশ্রণে তৈরি এবং তার প্রান্ত সাধারণত কালো রঙের হয়। এদের চোখের চারপাশে উজ্জ্বল নীল বা কমলা রঙের বৃত্ত থাকে, যা তাদের আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এদের শরীর সাধারণত কালো রঙের হলেও বুক এবং গলা সাদা বা হালকা রঙের হয়।

আবাসস্থল
টোকো টোকান সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার উষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলে বাস করে। তবে তারা শুধু গভীর অরণ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তাদের কখনো কখনো খোলা সাভানা, ফলবাগান এবং গ্রামীণ বনের আশপাশেও দেখা যায়। এরা সাধারণত গাছে বসবাস করে এবং গাছের ফাঁকফোকর, পুরোনো কাঠঠোকরার গর্তে বাসা বানায়।

খাদ্যাভ্যাস
টোকো টোকান সর্বভূক পাখি। এরা মূলত ফল খেতে পছন্দ করে, বিশেষ করে পাকা, নরম ফল তাদের প্রধান খাদ্য। তবে শুধু ফলে সীমাবদ্ধ না থেকে তারা পোকামাকড়, ছোট ছোট সরীসৃপ, পাখির ডিম এবং বাচ্চাও খেতে পারে। এদের ঠোঁটটি ফল ছেঁটে খাওয়া এবং দূরের শাখা থেকে ফল পেড়ে আনার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।

ছানাপোনা
টোকো টোকান জোড়া হিসেবে থাকে। এরা সাধারণত গাছের উঁচুতে বাসা তৈরি করে এবং স্ত্রী পাখি প্রতি মৌসুমে দুই থেকে চারটি ডিম পাড়ে। বাবা-মা উভয়ই ডিমে তা দেয় এবং বাচ্চাদের যত্ন নেয়। বাচ্চারা সাধারণত প্রায় দুই মাস পরে উড়তে শেখে এবং ততদিন তারা বাসাতেই থাকে।

আচরণ
টোকো টোকান অত্যন্ত সামাজিক পাখি। তারা প্রায়ই ছোট দলে ঘুরে বেড়ায় এবং একে অপরের সঙ্গে ঠোঁট ঠোকরানোর মাধ্যমে মজা করে। তারা উচ্চৈঃস্বরে ডাকাডাকি করে, যেটি অনেক দূর থেকে শোনা যায়। এই ডাকের মাধ্যমে তারা তাদের এলাকা চিহ্নিত করে এবং বিপদে সতর্কতা সংকেত দেয়।
উড়তে একেবারেই ভালোবাসে না টোকো টোকান। যতটা না ওড়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি লাফিয়ে চলে। পুরো গাছই লাফাতে লাফাতে পার হয়। জীবনের বেশির ভাগ সময় মগডালে কাটায়। বৃষ্টিময় আমাজন বনমালার আলো-ছায়ায় ওরা রঙিন শরীর লুকিয়ে শিকারিদের ফাঁকি দেয়।

 

পাতালপুরী অভিযান

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩০ পিএম
পাতালপুরী অভিযান
এঁকেছেন মাসুম

হাবলুর বয়স ১০ বছর। তবে তার মাথার ভেতর ২৫টা প্ল্যান আর ৮০ ধরনের সন্দেহ সারাক্ষণ ঘুরপাক খায়। সে ভাবে—স্কুলের হেডস্যার আসলে এলিয়েন, গ্রামের মোড়ের পাঁপড়ি বিক্রেতা জ্যোতিষী, আর সবচেয়ে বড় কথা—তার বাড়ির পেছনের কুয়োটা পাতালপুরীর গোপন গেট!
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ! হাবলু তিন মাস ধরে সেই কুয়োর দিকে সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। কারণ? একদিন দুপুর বেলা, সে কুয়োর ধারে বসে খেজুর খাচ্ছিল। হঠাৎ কুয়োর ভেতর থেকে একটা ফিসফিসে আওয়াজ ভেসে এল— চিকেনপুরী নাকি ডিমপুরী?
হাবলু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাত থেকে খেজুর পড়ে গেল কুয়োয়। আর তারপর আবার সেই আওয়াজ— ডিমপুরী শেষ! এখন কেবল পাতালপুরী!
সেই দিন থেকে হাবলুর মাথায় পেঁচিয়ে গেছে পাতালপুরীর ধাঁধা। পরের দিনই হাবলু তার দুই সেরা বন্ধুকে ডেকে পাঠায়—মুনিয়া আর টোকনকে। মুনিয়া হলো একদম গম্ভীর, চশমা পরা মেয়ে। সে নাকি তিনবার হেডস্যারকে চোখের ইশারায় ভীত করেছে। আর টোকন—সে নিজেকে গুগল বলে দাবি করে। মানে, সব জানে। যদিও সে দিনকে ‘উল্টা রাত’ আর গরুকে ‘আলগা গরিল্লা’ বলেই ডাকে।
তো এই তিনজন মিলে কুয়োর পাশে বসে একটা প্ল্যান তৈরি করে। প্ল্যানের নাম দেয়—‘অপারেশন পাতালপুরী’।
হাবলুর কাজ—গার্ডকে পাহারা দেওয়া।
মুনিয়ার কাজ—লিপিবদ্ধ করা।
টোকনের কাজ—পাতালপুরীর সোর্স খোঁজা।
তিন দিন পর্যবেক্ষণের পর একদম ভর দুপুরে তারা দেখে, কুয়োর নিচ থেকে ধোঁয়া উঠছে! আর ধোঁয়ার মধ্যে কেমন যেন ঘিয়ের গন্ধ!
টোকন তখন চিৎকার করে বলে, বন্ধুরা! এটা পাতালপুরীর ধোঁয়া না হলে আমার নাম টোকন গুগল না!
হাবলু ঘোষণা দেয়, কাল ভোরে কুয়োয় নামব!
মুনিয়া চোখ সরু করে বলে, সাবধান। কুয়োর নিচে যদি কুমির থাকে!
টোকন হেসে বলে, তাহলে পাতালপুরী তো কুমিরেই বানায়!
পরদিন ভোরে তারা একে একে রশি বেঁধে হাবলুকে নামিয়ে দেয় কুয়োয়। হাবলু এক হাতে টর্চ, আরেক হাতে ছাতু দিয়ে বানানো হেলমেট পরে কুয়োর নিচে নামে। নামতে নামতে সে হঠাৎ কেমন যেন হাওয়ায় ভাসে। চোখ খুলে দেখে সে পড়েছে এক বিশাল পাতালপুরীতে! চারপাশে ছোট ছোট দোকান, দোকানের নাম ‘পেঁয়াজপুরী প্যালেস’, ‘চিকেন চাট চেম্বার’, ‘ঝালঝোলে জমিদারপুরী’। আর মাঝখানে এক বিশাল রঙ্গিলা চেয়ার, তাতে বসে এক মোটা লোক, যার মাথায় টমেটো রঙের টুপি আর গলায় ঝোলানো—‘পণিপতি’ লেখা ব্যাজ!
পণিপতি বলল, তুমি কি পৃথিবী থেকে এসেছ?
হাবলু বলল, আমি হাবলু। তোমার পাতালপুরীর গন্ধে এসেছি!
পণিপতি গম্ভীরভাবে বলল, হুঁ... তুমি নির্বাচিত হয়েছ। তুমি পাতালপুরীর ‘তরকারি তত্ত্ব’ জানো না তো?
হাবলু মাথা নাড়ল। পণিপতি ব্যাখ্যা দিল, পৃথিবীর মানুষ এখন আর মনের সঙ্গে কথা বলে না। তারা শুধু মোবাইলে গল্প করে। কিন্তু যে শিশু সত্যি সত্যি খাওয়ার গন্ধ শুঁকে সঠিক পুরী চিনতে পারে, তার মন এখনো জীবিত। তাই তাকে আমরা বেছে নিই পাতালপুরীর রক্ষক হিসেবে!
তারপর হাবলুকে দেওয়া হয় একটি ‘ঝাল ঝাঁঝাল ঝুড়ি’, যাতে থাকে বিশেষ মসলা। বলা হয়— যখন কারও মন খারাপ হবে, একটু ঝুড়ি খুলে ছিটিয়ে দিলেই তারা হাসবে।
হাবলু ফিরে আসে সেই ঝুড়ি হাতে। কুয়ো থেকে উঠে দেখে, মুনিয়া আর টোকন এক এক করে ওকে জড়িয়ে ধরে। তারা কেউ বিশ্বাস করে না এই গল্প। কিন্তু তার পর দিন মুনিয়ার দাদি যখন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যান, হাবলু তার চারপাশে হালকা করে মসলা ছিটায়। দাদি হঠাৎ নাচতে শুরু করেন! টোকনের ভাই যখন জিদ করে পড়তে চায় না, হাবলু মসলা ছিটায়, সে গাইতে শুরু করে, আয় খুকু আয়!
সেই থেকে পাড়ার সবাই জানে—হাবলু আসলে পাতালপুরীর বাহক। আর কুয়োর পাশে ছোট একটা গাছ এখন বাড়ছে, যার পাতায় টক-ঝাল গন্ধ ছড়ায়। কেউ জানে না—ওটাই একদিন হবে ‘ঝালরং পাতাল গাছ’—যার পাতায় লাগলে মন হাসে।

বিভিন্ন দেশের জাতীয় পশু

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২৭ পিএম
বিভিন্ন দেশের জাতীয় পশু
মালদ্বীপের জাতীয় পশু টুনা মাছ

তোমরা জানো কি, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেরই একটি করে জাতীয় পশু থাকে? এই জাতীয় পশু সেই দেশের সাহস, ইতিহাস, প্রকৃতি আর সংস্কৃতির প্রতীক। আজ আমরা এক দারুণ ভ্রমণে বের হব, আর জানব কোন দেশের জাতীয় পশু কী এবং কেন!
শুরু করি আমাদের প্রিয় নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে। আমাদের দেশের জাতীয় পশু হলো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে রাজত্ব করা এই বাঘ শুধু শক্তিশালীই নয়, দেখতেও দারুণ সুন্দর।
এরপর যাই প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ভারতের জাতীয় পশুও বাঘ। সাহস আর গর্বের প্রতীক হিসেবে ভারতবর্ষে এই বাঘের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা শান্তিপূর্ণ হিমালয় কন্যা নেপাল গরুকে তাদের জাতীয় পশু হিসেবে বেছে নিয়েছে। নেপালিরা মনে করে, গরু শান্তি, পবিত্রতা আর মমতার প্রতীক। সবুজে ঘেরা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার জাতীয় পশু হলো সিংহ। সাহস, শক্তি আর নেতৃত্বের প্রতীক এই প্রাণীটিকে তারা এতই শ্রদ্ধা করে যে, তাদের জাতীয় পতাকায়ও সিংহের ছবি রয়েছে।
এবার পা রাখি প্রাচীন সভ্যতার দেশ চীনে। তাদের জাতীয় পশু হলো পান্ডা। সাদা-কালো রঙের, গোলগাল, শান্ত স্বভাবের এই মজার প্রাণী কচি বাঁশ খেতে খুব ভালোবাসে। চেরি ফুলের দেশ জাপানের জাতীয় পশু হলো রঙিন ডানার গ্রিন ফেজ্যান্ট পাখি। সৌন্দর্য, শান্তি আর সুগঠিত প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে জাপানিরা এই পাখিকে অনেক ভালোবাসে। অন্যদিকে, পর্বতঘেরা দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পশু বাঘ। কোরিয়ানরা বিশ্বাস করে, পাহাড়ে পাহাড়ে এই বাঘ পাহারাদার হয়ে ঘোরে।
দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পশু হলো ক্যাঙ্গারু। এর পেটের থলেতে ছোট্ট ছানা থাকে আর এক লাফেই এটি অনেক দূর চলে যেতে পারে। এবার যাই তুষারে ঢাকা শান্তশিষ্ট কানাডায়। তাদের জাতীয় পশু হলো বিভার। এটা একটা ছোট প্রাণী, যে কঠোর পরিশ্রমে ছোট ছোট বাঁধ তৈরি করে। বিভার যেন বলে দেয়, পরিশ্রমেই সাফল্য! অন্যদিকে আমেরিকার জাতীয় পশু হলো বল্ড ঈগল। এর বড় ডানা আর তীক্ষ্ণ চোখ সাহস আর স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গর্বের জায়গা করে নিয়েছে।
ইউরোপের দেশ স্কটল্যান্ড তাদের জাতীয় পশু হিসেবে বেছে নিয়েছে ইউনিকর্নকে। এটা এক ধরনের কাল্পনিক ঘোড়া যার কপালে একটি লম্বা শিং আছে। বরফে মোড়া রাশিয়ার জাতীয় পশু হলো ভালুক। শক্তি, ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এই প্রাণীকে রাশিয়ানরা নিজেদের মতোই গম্ভীর আর দৃঢ় মনে করে।
তপ্ত মরুভূমি আর সাভান্নার দেশ আফ্রিকান কেনিয়া ও বতসোয়ানায় জাতীয় পশু হিসেবে দেখা যায় হাতিকে। শুধু আকারেই নয়, স্মার্টনেস আর স্মৃতিশক্তিতেও হাতি চ্যাম্পিয়ন।
মেক্সিকোর জাতীয় পশু হলো গোল্ডেন ঈগল। এই বিশাল পাখিটি তাদের জাতীয় পতাকাতেও স্থান করে নিয়েছে।
সব শেষে চলে যাই ব্রাজিলে। ওদের জাতীয় পশু হলো জাগুয়ার-এক ধরনের দ্রুতগামী শিকারি প্রাণী, যে গাছে চড়তে পারে, আবার পানিতে সাঁতার কাটে।
প্রতিটি প্রাণী তার দেশের গুণ, চরিত্র আর কল্পনার এক অনন্য প্রতীক। তোমরাও যদি এমন কোনো প্রাণী বেছে নিতে চাও, যে তোমাদের ভালো লাগা, বিশ্বাস আর স্বপ্নকে তুলে ধরবে, তাহলে সেটা কোন প্রাণী হবে?

বাঘ ও ভিমরুলের ভয়ংকর যুদ্ধ

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৮ পিএম
আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২১ পিএম
বাঘ ও ভিমরুলের ভয়ংকর যুদ্ধ
এঁকেছেন মাসুম

ভারতের উত্তরপ্রদেশের ভাভর বনাঞ্চল। সে বনে পশুপাখিরা মিলেমিশে, হেসেগেয়ে ভালোই সময় কাটাচ্ছিল। কেউ কাউকে আক্রমণ করত না। শিকার করে খেত না। কারণ, তারা সবাই মিলে ওটস চাষ করত। তারা একটা চুলাও তৈরি করেছিল। সেই চুলায় সকাল, বিকেল দুবেলা খিচুড়ির মতো করে ওটস রান্না হতো। পশুপাখিরা সবাই মিলে বনের মাঝখানে মাদুর বিছিয়ে আনন্দ করে খাওয়া-দাওয়া করত। রাতের খাওয়া শেষে ময়ূর পাখি ও বাঁদর বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নাচ দেখাত। কাঠবিড়ালী গিটার বাজাত আর কোকিল ও কাকাতুয়া মিলে ডুয়েট গান ধরত। এভাবে আনন্দ করে তারা ঘুমাতে যেত। 
সে বনের রাজা সিংহ মশাই খুব সজ্জন ও ভদ্রলোক ছিল। কিন্তু একদিন হলো কী, পাশের বন থেকে একটা প্রকাণ্ড আকৃতির হিংস্র বাঘ ভাভর বনে ঢুকে পড়ল। সে এসেই বনের রাজা সিংহকে লড়াইয়ের আহ্বান জানাল। সিংহ তো অনেক দিন লড়াই, যুদ্ধ করেনি। তার অভ্যাস নেই। সে ভয়ংকর হিংস্র বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে বন থেকে পালিয়ে গেল। বাঘ তখন হুংকার দিয়ে বলল, আজ থেকে আমি হলাম এই বনের নতুন রাজা। 
তারপর প্রতিদিন সে ইচ্ছেমতো নানা প্রাণী মেরে কচকচিয়ে চিবিয়ে খেত। পাখিদের বাসায় হামলা চালিয়ে তাদের ডিম খেয়ে ফেলত। বনের পশুপাখিরা বাঘের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। তারা মিটিং ডাকল। মিটিংয়ে আলোচনা চলতে লাগল কীভাবে বাঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ কোনো উপায় বের করতে পারল না। তখন ভিমরুল উঠে বলল, আমি যুদ্ধ করে বাঘকে পরাজিত করব। তোমরা আয়োজন করো। 
বানর তখন বার্তাবাহক হয়ে বাঘের ডেরায় গিয়ে ভিমরুলের যুদ্ধের ঘোষণা জানিয়ে দিল। শুনে বাঘ রেগে আগুন। একটা পুঁচকে ভিমরুল করবে বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ! সে বানরকে বলল, কাল দুপুরে খোলা মাঠে যুদ্ধের আয়োজন করো। ভিমরুলকে এমন শিক্ষা দেব যেন বনের আর কোনো পশুপাখি আমার ওপর চোখ তুলে তাকাতে সাহস না করে। 
পরের দিন দুপুরে সব পশুপাখি মাঠে এসে স্টেডিয়ামের মতো গোল হয়ে বসল। যথাসময়ে বাঘ ও ভিমরুল এসে হাজির হলো। তারপর শুরু হলো ভয়ংকর যুদ্ধ। ভিমরুল বাঘের দিকে উড়ে আসতেই, বাঘ ভিমরুলকে লক্ষ করে থাবা মারল। কিন্তু ভিমরুল পলকের মধ্যেই সরে গেলে থাবার আঘাত এসে লাগল বাঘেরই গালে। গাল কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেল। বাঘ ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। এই সুযোগে ভিমরুল বাঘের আরেক গালে ভয়ংকরভাবে হুল ফুটিয়ে দিল। হুলের বিষে চিৎকার করে আরেক গালে থাবা চালাতেই ভিমরুল সরে গেল। আর থাবার আঘাতে বাঘের অপর গালটিও রক্তাক্ত হয়ে গেল। পরক্ষণেই ভিমরুলটি বাঘের পিঠে বসে হুল ফুটিয়ে দিল। বাঘ পিঠে থাবা মারতেই ভিমরুল সরে গেল। থাবার আঘাতে বাঘের পিঠের হাড় কড়াৎ করে ভেঙে গেল। বাঘ তখন কোনোমতে দৌড়াতে দৌড়াতে বন থেকে পালিয়ে বাঁচল। ভিমরুলের যুদ্ধ জয়ে বনে সাত দিন উৎসব চলল। তারপর বনের পশুপাখিরা আগের মতোই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

মরুভূমির বিচিত্র গাছ বাওবাব

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪১ পিএম
মরুভূমির বিচিত্র গাছ বাওবাব
ছবি সংগৃহীত

ঘটনাটি ঘটেছিল স্বর্গে। চমৎকার সুন্দর একটি গাছ ছিল সেখানে। কিন্তু সুন্দর জিনিসের ভাগ্য বরাবর খারাপ হয়; সবার কুদৃষ্টি পড়ে তার ওপরে। আর শয়তানের মাথায় তো মন্দবুদ্ধি গিজগিজ করছে। সে তখন স্বর্গেই থাকত। শয়তান যখন অত সুন্দর গাছটিকে দেখল, তার গা জ্বলে উঠল। গাছটির পেছনে না লাগলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না সে। তাই তক্কে তক্কে রইল। একদিন সুযোগ বুঝে গিয়ে গাছটিকে উপড়ে ফেলল সে। তারপর সেটাকে পৃথিবীতে এনে ডালপালা শুদ্ধ মাটির গভীরে উল্টো করে পুঁতে ফেলল। আর শিকড়গুলো রয়ে গেল মাটির ওপরে। বেচারা গাছ! তার তো আর হাত-পা নেই যে চাইলেই সোজা হয়ে যাবে। উল্টো হয়েই রইল অমন। 
গল্পটি সত্য কী মিথ্যা তা কে জানে। তবে গাছটি কিন্তু সত্যি। বিশ্বাস না হলে যেতে হবে আফ্রিকার মরুভূমির বুকে। সেখানেই আছে এই বাওবাব গাছ!

নিবাস
গাছটির আদি নিবাস আফ্রিকা, আরব এবং অস্ট্রেলিয়াতে। তবে পাওয়া যায় মাদাগাস্কার এবং ভারতের কয়েকটি অঞ্চলেও। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মেসিনা নামক অঞ্চলে। তাই মেসিনাকে বলা হয় দ্য বাওবাব টাউন। মাদাগাস্কারে বাওবাব গাছকে ‘টি পট ট্রি’ বলে, কারণ কাণ্ডের সঙ্গে চায়ের কাপের অদ্ভুত মিল। অস্ট্রেলিয়ায় একে বলে দ্য প্রিজন ট্রি, মানে জেলখানা গাছ! 

গাছের কথা
বাওবাব গাছ Adansonia গণের উদ্ভিদ, জন্মে মরুভূমিতে। একহারা গড়নের গাছের কাণ্ডটি মাটি থেকে সোজা ঊর্ধ্বমুখী। ডালপালার বালাই নেই বললেই চলে। মাথায় ঝোপের মতো কয়েকটি ডাল ছাতার মতো সাজানো। দূর থেকে দেখলে কারও মনে হবে একটি গাছকে বুঝি কেউ উঠিয়ে শিকড় উপুড় করে পুঁতে দিয়েছে! সবচেয়ে বড় গাছটি আছে দক্ষিণ আফ্রিকার লিনপোপো প্রদেশের একটি খামারে। সেটার উচ্চতা ৪৭ মিটার আর বেড় ২২ মিটার। এর নাম সানল্যান্ড বিগ বাওবাব। কার্বন ডেটিং করে এই গাছটির বয়স নির্ধারিত হয়েছে ৬ হাজার বছর। অর্থাৎ গাছটির যখন জন্ম, সম্রাট অ্যালেক্সান্ডার তখনো পৃথিবীতে আসতে সাড়ে ৩ হাজার বছর দেরি। সক্রেটিসের খোঁজ নেই। পিরামিড তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে।
শিমুল গোত্রীয় গাছটি পত্রমোচী ঘরানার। বছরের অধিকাংশ সময়ে কোনো পাতা থাকে না। তখন মৃত গাছ বলে ভ্রম হয়। গ্রীষ্ম শেষে নতুন পাতা গজায় বাওবাব গাছে। পাতা না থাকলেও এরা কাণ্ডের ভেতরে খাদ্য এবং পানি সঞ্চয় করে রাখে। খাদ্য-পানি সঞ্চিত হতে হতে কাণ্ডটি ব্যারেলের মতো মোটা হয়ে যায়। কোনো কোনো গাছ তার কাণ্ডে ১ লাখ ২০ হাজার লিটার পানি ধরে রাখতে পারে। এত পানি নিজের শরীরে ধরে রাখলেও জলাবদ্ধ জায়গায় এরা বাঁচতে পারে না। প্রাণিকুলের হাত থেকে যথেষ্ট সুরক্ষিত এরা, একমাত্র হাতিই পারে এর ক্ষতি করতে। আরেক জাতের ছত্রাক এদের জন্য প্রাণঘাতী। সব গাছের আকার এক রকম হয় না। এদের আকার নির্ভর করে এলাকা ও প্রজাতির ওপর।

মানুষের আবাস
মাদাগাস্কারের প্রকাণ্ড সব বাওবাব গাছের কোটরে একসময় সেখানকার আদিবাসীরা বসবাস করত। আর অস্ট্রেলিয়ার বাওবাবগুলো ব্যবহার হতো আরও বৈচিত্র্যময় কাজে। সেখানকার অধিবাসীরা কারাগার হিসেবে ব্যবহার করত বাওবাবের প্রকাণ্ড খোঁড়ল। কোনো কোনো কোটরে নাকি ২০-২৫ জন বন্দিও ধরে যেত! ভাবুন তাহলে কত বড় হয় বাওবাব গাছ। এজন্য এদের নাম বাওবাব প্রিজন ট্রি! অস্ট্রেলিয়ার উইন্ডহ্যাম অঞ্চলে দেখা মেলে এই বাওবাব প্রিজন ট্রির। এখন অবশ্য বন্দি রাখার বন্দোবস্ত নেই। বরং পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় এক জায়গা এটি! রীতিমতো সারা বিশ্ব থেকে মানুষ আসে এই গাছগুলো দেখতে।