গুলু সকাল হলেই দু-মুঠো পান্তাভাত আর কাঁচামরিচ মেখে খায়। তারপর থলে হাতে গাঁয়ের বটতলা দিয়ে হাঁটা ধরে নিশিপুর স্কুলের দিকে। স্কুলের গেটের সামনে চট বিছিয়ে বসে বিক্রি করে ঝালমুড়ি আর ভাঁজা বাদাম।
বেচাবিক্রির ফাঁকে ফাঁকে ঠিক পাখির মতো গলা উঁচিয়ে হাঁক দেয় রাস্তার মানুষদেরও। এই ঝালমুড়ি, ভাঁজা বাদাম, যে খাবেন নিয়া যান, নিয়া যান…
একেবারে সস্তা দাম! নিয়া যান…
একবার খাইলেই ফের মন চাইব, এই সেই ঝালমুড়ি, ভাঁজা বাদাম।
এভাবে হাঁক পাড়তে পাড়তে বিক্রি করতে থাকে ঝালমুড়ি আর বাদাম। স্কুলের ছেলেমেয়েসহ গ্রামের প্রায় সব মানুষই গুলুর কাছেই ঝালমুড়ি কিনে খায়। ছেলে-বুড়ো সবাই গুলুকে এক নামে চেনে! গুলু ঝালমুড়িওয়ালা! সেদিন স্কুলের টুকুন, রাকিব, তনয় গুলুকে ডেকে বলে- গুলু ভাই, তোমার হাতের ঝালমুড়ির যা মজা! তার কোনো তুলনা নেই। আর বাদাম ভাঁজাও অনেক ভালো, একদম মুচমুচে!
আজকাল এত যত্ন করে কজনই-বা বেচাকেনা করে বলো! সবাই কেবল ভেজাল বিক্রি করে।
সারা দুনিয়াটাই ভেজালময় হয়ে গেছে গো গুলু ভাই।
মৃদু হেসে জবাব দেয় গুলু, তা আপনারা ঠিক কথাই কইছেন। তবে এগুলো তো সবই আমার মায়ের হাতের তৈরি। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মায়ের সব জোগাড় সারা হয়ে যায়। মা আগের যুগের মানুষ, ভেজাল কিছু দু-চোখে দেখতে পারেন না।
যাই বল গুলু ভাই, তোমার এই ঝালমুড়ি খেয়ে আমাদের হেডস্যারও তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তাই নাকি ভাইজানেরা! এ তো আমার ভারি সৌভাগ্যির ব্যাপার!
কথার মাঝেই টুকুন বলে ওঠে, এই যে গুলু ভাই, তোমরা যে গল্পেই ডুবে গেলে, কই আমাদের ঝালমুড়ি দাও! সঙ্গে বাদামও দিও।
গুলু বলল, জি ভাইজান দিতাছি।
এই নেন।
এভাবেই সকাল ও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বেঁজে ওঠে টুংটাং, টুংটাং করে।
ছেলেমেয়েরাও বই-খাতা গুছিয়ে বাড়ির দিকে ছুট দেয়। সেই সঙ্গে গুলুরও ছুটি হয়। থলেটা মাথায় তুলে বাড়ির দিকে রওনা হয় গুলু।
রোজ ঝালমুড়ি আর বাদাম বিক্রি করে কোনোমতে দিন পার হয় গুলুর। ভিটেমাটি বলতে তেমন কিছুই নেই। শুধু এক টুকরো জমিতে একটি কুঁড়েঘর।
সেখানেই বৃদ্ধ মাকে নিয়ে থাকে গুলু।
আজ শুক্রবার স্কুল ছুটির দিন। তাই গুলু ঝালমুড়ি বেচতে যায়নি।
এদিকে গুলুর মা ডাকে- বাবা গুলু, নেও বাপু এই তোমার জন্যি একটু চালের গুঁড়ো দিয়ে হালুয়া করেছি, খেয়ে নেও।
গুলু হালুয়া খায়।
একবার এক সপ্তাহ ধরে গুলুর কোনো খবর নেই। ঝালমুড়ি, বাদাম বেচতে যায়নি। গুলুর যে ভীষণ জ্বর!
ঘরে যা পয়সাকড়ি ছিল তা ডাক্তার দেখাতেই শেষ হয়ে গেছে। এক টাকাও পুঁজি নেই! যা দিয়ে ব্যবসাটা আবার শুরু করবে। চিন্তায় গুলুর মাথায় হাত।
এদিকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন গুলুর মজাদার ঝালমুড়ি খাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু তার নাগাল পায় না কেউ।
রাকিব আর টুকুন ভাবে- কী হলো গুলু ভাইয়ের, এতদিন হয়ে গেল দেখা মেলে না। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।
টুকুন বলে, চল আজ গুলু ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে দেখি সমস্যা কোথায়?
যেই ভাবা সেই কাজ! গুলুর বাড়ি গিয়ে তার মুখে সব কথা শুনে টুকুন ভাবে- আসলে কী করা যায়!
টুকুন আর রাকিব পরামর্শ করে।
পরের দিন সকালে স্কুলে তারা হেডস্যারের কাছে গিয়ে গুলুর ব্যাপারে সব কথা খুলে বলে।
সব শুনে স্যার বললেন, তাহলে কী করতে চাও তোমরা?
টুকুন বলে, আপনি অনুমতি দিলে আর কিছু আর্থিক সহযোগিতা করলে ভালো হবে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে গুলু ভাইয়ের জন্য স্কুলের গেটের বাইরে ছোট একটি দোকান করে দিতে চাই। সেখানে বসে গুলু ভাই ঝালমুড়ি, বাদাম, চা-বিস্কুটসহ সবই বেচতে পারবে। তাতে আমাদেরও সুবিধা হবে এবং গুলু ভাইয়েরও উপকার হবে।
সব শুনে হেডস্যার জবাব দিলেন, বাহ! ভালোই বলেছ। আচ্ছা, অনুমতি দিলাম।
পরদিনই টুকুন ও রাকিব স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। ছোট্ট একটা দোকান বানিয়ে দেয়। দোকানে মুড়ি, বাদামসহ নানান কিছু সাজিয়ে দেয়।
পরের দিন গুলুকে ডেকে নিয়ে আসে টুকুন। হেডস্যারকে দিয়ে গুলুর দোকান উদ্বোধন করায়। হেডস্যার বলেন, আজ থেকে এখানে বসেই ঝালমুড়ি বেচবে, বুঝলে গুলু। তোমাকে আর পাড়ায় পাড়ায় হাঁক দিয়ে বিক্রি করতে হবে না। সবাই এখান থেকেই কিনবে।
গুলু তো অবাক! খুশিতে ওর দু-চোখ পানিতে ভরে যায়।
কাঁপা গলায় বলে, কী বলে যে ধন্যবাদ দেব মাস্টার মশাই।
না না গুলু, আমায় ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, সবই করেছে রাকিব, টুকুন ওরা মিলে। আমি তো শুধু সহযোগিতা করেছি।
জাহ্নবী