জগদ্বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। নাট্যকার, অভিনেতা, ইংরেজদের জাতীয় কবি। বিশ্ব কবিদের কবিও বলা হয় তাকে। অনেকেই তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলে মনে করেন। বিশ্ববরেণ্য কবি হোমার, দান্তে এবং ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয়, চার্লস ডিকেন্স, যারা একেকজন একেক গুণের অধিকারী। কিন্তু কোনো লেখকের খ্যাতিই শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তিনি আজও এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন। যার নাটকগুলো ১৬ শতকের শেষে এবং ১৭ শতকের শুরুর দিকে আলোড়ন তোলে।…
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্ম-মৃত্যু নিয়েও এক ধরনের রহস্য রয়ে গেছে। কারণ এপ্রিল মাসেই একই দিনে তার জন্ম ও মৃত্যু। মানবচরিত্রের বিস্ময়কর পরিধি তিনি উন্মোচন করে গেছেন। শেক্সপিয়ার স্ট্যাটফোর্ড অন-অ্যাভন, ওয়ারউইকশায়ার, ইংল্যান্ডে ২৩ এপ্রিল ১৫৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ২৬ এপ্রিল ব্যাপটিজমে তার জন্ম নথিভুক্ত করা হয়। তার পিতা জন শেক্সপিয়ার ও মাতা মেরি আর্ডেন হেনলি স্ট্রিট নামে এক বাড়িতে এই পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। আজও নানা রহস্যে ঘেরা তার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়। ট্র্যাজেডি, কমেডি, ইতিহাসনির্ভর প্রায় ৪০টি নাটক এবং ৪০০ কবিতা লিখে গেছেন।
১৫৮৫ সাল পর্যন্ত তার জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড-অন-অ্যাভন-এ শেক্সপিয়ারের ছেলেবেলা, শিক্ষাজীবন, বিয়েসহ অন্যান্য বিষয়ে জানা গেলেও তার জীবনের সাত বছর (১৫৮৫-৯২) সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তার জীবনের এই সময়কালকে গবেষকরা ‘লস্ট ইয়ারস’ বা ‘হারানো বছরসমূহ’ বলে অভিহিত করেছে। ওই সময় হয়তো তিনি উদাসী হয়ে ফেরারি জীবনযাপন করছিলেন। সমাজের মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন কিছুটা বিরক্ত। অনেক অর্থেকষ্টে ও সামাজিক বিড়ম্বনায় দিনযাপন করেন। প্রতিবেশীর সীমানায় একবার তিনি হরিণ শিকার করেছিলেন। সেই সময় একে অনেক বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। এই সময় শেক্সপিয়ার এক আইনজীবীর কেরানি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৫৫২ থেকে শেক্সপিয়ারের লেখার হাত নির্ঝরের মতো বইতে শুরু করে। তিনি নিজে অভিনেতা ও মঞ্চকর্মী হওয়ায় নাটকের শিল্পমূল্যের চাইতে নাটকীয়তার প্রতিই তার বেশি ঝোঁক ছিল। ১৫৯৯ সালে মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, জুলিয়াস সিজার, দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর নাটকগুলো লিখেন শেক্সপিয়ার। ১৬০১ সাল থেকে শেক্সপিয়ারের জীবনে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। অতীতের রস-ব্যঙ্গের উচ্ছ্বাসকে সরিয়ে বিষণ্নতা জায়গা করে নেয় তার মানসে। আর্ল অব আসেক্সের পতন শেক্সপিয়ারকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। তারপর থেকেই ক্ষোভ, হতাশা, যন্ত্রণা তার লেখনীর মধ্যে ফুটে ওঠে। তাই তিনি লেখেন সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক হ্যামলেট। ‘টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন’ এই নাটকের সেরা উক্তি। অনেকেই ধারণা করেন যে, এটি শেক্সপিয়ারপুত্র হ্যামনেটের শোকের ছায়া। এ নাটকের স্বগোতোক্তির মাধ্যমে সেরা দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। ১৫৯৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে হ্যামনেট এক অজ্ঞাত রোগে মারা গিয়েছিল। এ বছরেই তার বাবাও মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, ‘সাহিত্যের প্রথম আধুনিক মানুষ’ হ্যামলেট-এর মধ্য দিয়েই পিতার মৃত্যুতে শোকাবহ পুত্রের চরম বিষণ্নতা প্রকাশ পেয়েছে।
ওথেলোতে দেখা যায় ভালোবাসার অভাবে জীবন ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা-
‘বাট আই ডু লাভ দি! অ্যান্ড ওয়েন আই লাভ ডি! নট ক্যাওয়াজ ইজ কাম এগেইন’
ম্যাকবেথের মনে হয় তার জীবন হারিয়ে ফেলেছে-
‘লাইফ ইজ বাট এ ওয়াকিং শ্যাডো, এ পুয়্যার প্লেয়ার’
সমাজের বিভিন্ন চিত্র শেক্সপিয়ারের চোখে পড়ে। দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস-এর সওদাগর চরিত্র অথবা আদালতের যুক্তি ও তর্কের খেলা, অন্যদিকে হেনরি এইট আর দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর- নাটক দুটির সেই চিকিৎসক চরিত্রগুলোকে মনে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, লন্ডনে শেক্সপিয়ারের প্রতিবেশীরা ছিল তার সৃষ্ট এই রকম বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলোর উৎস। ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, সংগীতশিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিবেশীরা ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাগুলোতে যাতায়াত করতেন। চিন্তায় ও কর্মে তারা ছিলেন আধুনিক। গির্জায় বা বিভিন্ন কেন্দ্রে তাদের সঙ্গে দেখা হতো শেক্সপিয়ারের।
নাটকের পাশাপাশি স্বতন্ত্র কাব্য রচনাতেও নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। লন্ডনের প্রকাশক রিচার্ড ফিল্ড শেক্সপিয়ারের প্রথম কবিতা ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু লেখক এবং প্রকাশক যেভাবে আশা করেছিল ততটা সফলতা আনতে পারেনি। তখন তার লেখা ‘দ্য রেপ অব লুক্রেস’ অনেক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তবে তিনি কাব্য প্রতিভায় বিশেষভাবে স্বাক্ষর রেখেছেন সনেট লিখে। তিনি ১৫৪টি সনেট রচনা করেছেন। তার সনেটগুলোর বিষয়বস্তু ভালোবাসা এবং প্রতারণা; বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের খেলা। ১-১২৬ সনেটে অজানা এক যুবক এবং ১২৭-১৫৪ সনেটে এক রহস্যময়ী রমণীকে নিয়ে লেখা হয়েছে। সনেটের প্রথমদিকে যুবককে সংসারী হতে বলে, শেষের দিকে এসে তা বিচ্ছেদ ও বিরহে রূপ নেয়। ভালোবাসা হারানোর বিয়োগ-ব্যথা যেন অন্য এক রূপ নিয়েছে রহস্যময়ী নারীর জীবনে। কবি যেন তার নিজের জীবনের ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ করেছেন। সংসার যেমন কবিকে টেনেছে আবার বিরহ বেদনায় জীবনকে দূরেও ঠেলে দিয়েছে। তার সনেটগুলোতে ভালোবাসা, বিরহ, বিচ্ছেদ, ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের কথা ফুটে উঠেছে। তার সনেটগুলোর গঠনপ্রকৃতিও ভিন্ন। পেট্রার্ক-এর সনেটে যেমন আট ও ছয় লাইনের যে ভাগ রয়েছে, সেখানে তিনি চার লাইনের তিনটি স্তবক এবং শেষ দুই লাইনের কাপলেট দিয়ে চৌদ্দ লাইনে সনেট রচনা করেছেন।
শেক্সপিয়ার বেঁচে থাকা অবস্থায় তার পনেরোটি নাটক অননুমোদিতভাবে মুদ্রিত হয়েছিল। কারণ নাটক মুদ্রণে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। নানাবিধ কারণে নাট্যকাররা তখন নাটক ছাপাতে চাইতেন না। শেক্সপিয়ার মৃত্যুর পর তার দুই বন্ধু ও সহকর্মী হেমিঙ্গেস ও কন্ডেল তার নাট্যসমগ্র প্রথম প্রকাশ করেছিলেন। এটি ফোলিও সংস্করণ নামে পরিচিত যার মাত্র ২০০ কপি পাওয়া গেছে।
২৩ এপ্রিল ১৬১৬ মৃত্যুবরণ করার পরেও বিগত ৪০০ বছরে অন্য যেকোনো লেখকের চেয়ে শেক্সপিয়ারের রচনা সবচেয়ে বেশি পঠিত, নন্দিত, অভিনীত, অনূদিত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এখনো সাহিত্যঙ্গনে এত বড় মাপের কোনো লেখক আজ পর্যন্ত জন্ম হয়নি। বাংলাসহ কমপক্ষে ৮০টি ভাষায় তার রচনা অনুবাদ হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শেক্সপিয়ার রচিত কমেডি অব এররস-এর অনুবাদ করেন ভ্রান্তিবিলাস নামে। আজও শেক্সপিয়ারের রচনা সমাদৃত ও গবেষণা হচ্ছে। শেক্সপিয়ার নিজেই এই মহাবিশ্বের মহাসাহিত্যিক।