‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!’…
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছিন্নপত্র’ ১০ মে ১৮৯৩ সালে শিলাইদহে লিখেছেন, ‘এই দরিদ্র প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশুসন্তানের মতো নিরুপায়। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে- কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনই সমস্ত কিছু ভুলে যায়।’...
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় নন্দনতত্ত্ব, বিশ্বমানবিকতা বা মানবধর্ম প্রধানত ছিল তার গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধিজাত ও সত্য। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর সৃষ্টি ও বিবর্তনের লীলাকে গ্রহণ করেও তিনি মানুষ এবং পৃথিবীর সামগ্রিক পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়ার জন্য দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টি উন্মুক্ত রেখেছিলেন, এখানেই তার অনন্যতা এবং বিশেষত্ব। রবীন্দ্রনাথ তার কৈশোর থেকে পরিণত বয়সে বহুবার কুষ্টিয়ার শিলাইদহ এসেছেন এবং কুঠিবাড়িতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। শুধু সস্ত্রীক শেষবার যখন এসেছিলেন, তখন উপলক্ষ ছিল জমিদারির পড়ে থাকা বকেয়া খাজনা আদায়। যত না খাজনা আদায় হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি গ্রাম-বাংলার অজপাড়াগাঁয়ের সৌন্দর্যসুধা প্রাণ ভরে উপভোগ করেছেন। পদ্মা-গড়াই পলিবিধৌত শান্ত-সমাহিত গ্রাম ও মেঠোপথের ছবি যেমন বক্ষে ধারণ করেছেন, তেমনি তার কাব্যিক দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করেছেন খেয়া পারাপারের মাঝিটিকে পর্যন্ত। এসবের ছাপ তার ‘সোনার তরী’ ও ‘মানসী’ কাব্যে পাওয়া যায়।
কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ গ্রাম ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এই বিশ্ববিখ্যাত নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে। সম্ভবত, খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে শিলাইদহে পূজনীয় শীলাদেবীর মন্দির ও শিলাকুঞ্জ বা দহ ছিল। সেই থেকে শিলাইদহ নামের উৎপত্তি। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাংলার নদনদী’ গ্রন্থে এর সমর্থন পাওয়া যায়। ১৭৯১-১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ রামলোচন ঠাকুর নাটোররাজ রামকৃষ্ণ রায়ের জমিদারি অঞ্চল বিরাহিমপুর পরগনা নিলামে ক্রয় করেন। ঠাকুরবাড়ির শিলাইদহ জমিদারি ছিল অবিভক্ত নদীয়া জেলার ৩৪৩০ সংখ্যক তৌজিভুক্ত। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকর সাহেব মি. শেলীর নীলচাষের জমিজমা ও কুঠিবাড়ি ক্রয় করেন এবং ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিলাইদহে চিনি কারখানা স্থাপন করেন। শিলাইদহে নীলকর সাহেবদের কুঠি নদীগর্ভে বিলীন হলে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান নতুন কুঠিবাড়ি নির্মিত হয়; যা ১৩ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত এবং আম, কাঁঠাল, ফুলের বাগান, দুটি পুকুরসহ বিস্তৃত সবুজের সমারোহে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি।
রবীন্দ্র জীবনীকার শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারী তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ’ গ্রন্থে লিখেছেন: “মাত্র ১৫ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে শিলাইদহে প্রথম আসেন। এখানকার জঙ্গলে বিশ্বনাথ শিকারির সঙ্গে বাঘশিকারের কথা কবি তার ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে লিখেছেন।” কবি ২৭ বছর বয়সে ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে শিলাইদহে এসে নৌকাবাস করেন। ২৯ বছর বয়সে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কবি জমিদারি দেখাশোনার ভার পান এবং শিলাইদহে এসে কাছারির পুণ্যাহ উৎসবে যোগ দেন, প্রজাদের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়। কিন্তু কবি ‘ছেলেবেলা’ বইতে তার ছেলেবেলার স্মৃতিচারণে শিলাইদহের আব্দুল মাঝির কথা এবং অন্য পাতায় শিলাইদহে ফুল বাগানের মালির সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো বিষয়ে যা লিখেছেন তাতে সুস্পষ্ট ধারণা হয়, তিনি ১৮৭৬ সালে অথবা তার আগেও শিলাইদহে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮৯১ সালে ‘ছিন্নপত্র’ গ্রন্থে উল্লেখ, কবি শিলাইদহ থেকে একখানা চিঠিতে যা লিখেছেন সেটাও ওই ধারণার সহায়ক। এ ছাড়া এর আগে কবি বাল্যকালে তার দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে রেলগাড়িতে চড়ার শখে কুষ্টিয়া এসে তার পর নদীপথে শিলাইদহে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ১৮৯০-১৯১০। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় এসে জমিদারি পরিদর্শন করেন এবং সমুদয় ভার গ্রহণ করেন। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ‘চিত্রা’ ও পরে ‘পদ্মা’ বজরায় নদীভ্রমণ করতেন আর প্রজাবর্গের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। জীবনের শেষ পাদপীঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন: ‘আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পরিচিতি সারা দেশ, এমনকি বিশ্বব্যাপী। তবে খাজনা আদয়ের লক্ষ্যে কুঠিবাড়ির খুব কাছেই স্মৃতিধন্য আরেকটি স্থাপনা ১৮৯২ সালে নির্মিত হয় দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট শিলাইদহ কাছারি বাড়ি। শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কেন্দ্রবিন্দু। কবি এখান থেকেই শাহাজাদপুর, পতিসর যাতায়াত করতেন। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে কাছারি বাড়িকে জাঁকজমকের সঙ্গে সজ্জিত করা হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক পূজা-পার্বন-অনুষ্ঠানে পুণ্যপ্রার্থী প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মিশে যেতেন, বরকন্দাজরা গোল হয়ে ঘিরে ধরত তাকে। লাঠিয়ালরা নানারূপ লাঠিখেলা, কুস্তি, বল্লম ও তরবারী খেলায় বাহাদুরি প্রদর্শন করে বাবু মশায়ের নিকট থেকে পুরস্কার নিত। এই কাছারিতে থাকত না কোনো পার্থক্য জমিদার এবং প্রজার। এক আসনে বসতে হবে রবীন্দ্রনাথের হুকুম!
‘কোনো জিনিসের আরম্ভ কী করে হয় তা বলা যায় না। সেই আরম্ভকালটি রহস্যে আবৃত থাকে। আমি চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত পদ্মার বোটে কাটিয়েছি, আমার প্রতিবেশী ছিল বালিচরের চক্রবাকের দল। তাদের মধ্যে বসে বসে আমি বই লিখেছি। হয়তো চিরকাল এইভাবেই কাটাতুম। কিন্তু মন হঠাৎ কেন বিদ্রোহী হল, কেন ভাবজগৎ থেকে কর্মজগতে প্রবেশ করলাম।’...
রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি’। ১৮৯১ সালে শিলাইদহে ব্যবসা পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় কবি আজিজুর রহমান সড়কে। পরে ১৮৯৫ সালে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’র অফিস স্থাপন করেন টেগর লজে। ‘টেগর লজ’-এর নামকরণ ‘কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি’ কবি নিজেই করেন। ‘টেগর লজ’-এর পাশেই ভুষিমালের ব্যবসার পাশাপাশি এখানে জুট বেলিং প্রেস এবং আখমাড়াই কল ও কৃষি সরঞ্জামনির্মাণ ব্যবসা যুক্ত করেন। অনেক সময় কলকাতা থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়ায় নেমে শিলাইদহে যাওয়ার পথে ‘টেগর লজে’ বিশ্রাম নিতেন কিংবা রাত্রিবাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে শিলাইদহে আসেন। তাই কবি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন,
‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি’।
বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাদের মধ্যে অন্যতম।