রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) পেয়েছিলেন আশি বছরের আয়ু। এই দীর্ঘজীবনে তিনি সৃষ্টিশীল ভুবনের যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। অসামান্য কোনো মহৎ প্রতিভার পক্ষেই এ ধরনের অর্জন ও সিদ্ধিলাভ সম্ভবপর। কবি তার ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। আগ্রহ, কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে। তার বিচিত্রগামী প্রতিভার স্ফুরণ প্রতিফলন আছে যে বিপুল রচনাসম্ভারে, তার অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বিজ্ঞানচিন্তার ছাপ দেখতে পাই। বস্তুত শিশুকালেই তার মানসগঠন হয়েছিল বৈজ্ঞানিক আবহে। ক্রমে ক্রমে তা বিকশিত হয়েছে। পেয়েছে পরিণতি। রবীন্দ্র সৃষ্টিসম্ভার বিজ্ঞানের মোহন আলোয় উদ্ভাসিত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত এবং কালজয়ী হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শিশু, তখন থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল। পরিণত বয়সে তিনি লিখলেন বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়’। এ বইয়ে আছে পরমাণুলোক, গ্রহলোক, ভূলোক, নক্ষত্রলোক নামের অধ্যায়। সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি বিজ্ঞানের জটিল সব তথ্য ও তত্ত্ব পাঠকসমীপে উপস্থাপন করেছেন। খুব সহজেই তিনি প্রবেশ করেছেন বিষয়ের গভীরে। তার রচনাশৈলীর যে অনন্য মুনশিয়ানা, তার বৈগুণ্যে বিজ্ঞানের জটিল সব অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে বোধগম্য এবং উপভোগ্য।
তার কালে, পিছিয়ে থাকা বাঙালি সমাজে কেমন করে অতটা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি? ‘বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ভূমিকায় এ সম্পর্কে বিশদ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছেন আমাদের মন অবৈজ্ঞানিক, শুধু বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের অকৃতার্থ করে রেখেছে। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ,
‘…আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত [ঘোষ] মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠাণ্ডা ভারী জল নীচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ ব’লে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা সহজ নয় এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার পরে বয়স তখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রঙ-কানা থাকে আমি তেমনি তারিখ-কানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো) পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্তদিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে ক’রে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিভিন্ন কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাসেও আমরা পাব বিজ্ঞানচেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ও বর্ণচ্ছটা। আমরা জানি, বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ও জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে নিবিড় গভীর বন্ধুতা ছিল কবির। গ্রামোন্নয়ন ও কৃষির উন্নতির কথা শুধু ভাবেনইনি, এই কাজে রীতিমতো ব্রতী ও উদ্যোগী হয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে পাঠিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথের অধীত বিষয় ছিল কৃষি ও গো পালন। গ্রাম উন্নয়ন করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম চালু করেছিলেন সমবায় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীনিকেতনের কাছে কৃষি গবেষণাগার। সারা জীবন তিনি কৃষি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। এক পত্রে তার প্রিয় বিজ্ঞানীবন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখছেন,
‘আমার চাষ-বাসের কাজও মন্দ চলিতেছে না। আমেরিকান ভুট্টার বীজ আনিয়েছিলাম- তাহার গাছগুলা দ্রুতবেগে বাড়িয়া উঠিতেছে। মান্দ্রাজি সরু ধান রোপণ করিয়াছি, তাহাতেও কোন অংশে নিরাশ হইবার কারণ দেখিতেছি না।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী বাংলা একাডেমি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। উপস্থাপিত প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের বহু গল্পে বিজ্ঞান ভাবনার উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। শেষ জীবনে তিনি বিজ্ঞানকে তার ভাবনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয় করে তুলেছিলেন। ছিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি ‘বিশ্বপরিচয়’-এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। তিনি ‘সমগ্র’ দিয়ে বিজ্ঞানকে অনুভব করার কথা বলতেন।’
একই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইব্রাহীম বলেন, ‘জীবনকে যিনি বুঝতে ও উপভোগ করতে চান তার দরকার বিজ্ঞানচর্চা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রায়োগিক বিজ্ঞানী। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ভালো কিছু করার চেষ্টা করতেন। তিনি মহাবিশ্ব, গ্যালাক্সি, সীমা-পরিসীমা সর্বোপরি বৃহতের সন্ধান করতেন। বিভিন্ন গ্রহের মধ্যে জীবের সন্ধান অনুধাবন করেন তিনি, যা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচায়ক।’