![কোনান ডয়েলের বিচিত্র জীবন](uploads/2024/05/18/konal-1716024087.jpg)
আর্থার কোনান ডয়েল। পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র শার্লক হোমসের স্রষ্টা। জন্ম ১৮৫৯ সালের ২২ মে, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে। পুরো নাম আর্থার ইগনেসিয়াস কোনান ডয়েল। তার পরিচয়ের পাল্লাও বেশ ভারি। তিনি একাধারে ছিলেন আত্মিকবাদী, ইতিহাসবিদ, তিমি শিকারি, ক্রীড়াবিদ, যুদ্ধ-সাংবাদিক, ডাক্তার, কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার।
তার বাবা চার্লস আল্টামন্ট ডয়েল, মা মেরি। পাঁচ বছর বয়সে তাদের পারিবারিক বন্ধন নড়বড়ে হয়ে যায়। যে কারণে এক বন্ধুর চাচি মেরি বার্টনের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। পড়াশোনা করেন নিউইংটন অ্যাকাডেমিতে। তিন বছর পর পারিবারিক ঝামেলা মিটে গেলে আবার সবাই একসঙ্গে বসবাস শুরু করেন। নয় বছর বয়সে এক ধনী চাচার সহায়তায় ইংল্যান্ডে গিয়ে লেখাপড়া শুরু করেন ডয়েল। প্রিপারেটরি স্কুল শেষ করে স্টোনিহার্সট কলেজে ভর্তি হন।
তিনি চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন এডিনবার্গ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই সময়ে এডিনবার্গের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনে ব্যবহারিক উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়েও পড়াশোনা করেন। এই পড়াশোনার সময়ই ডয়েল ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। ব্ল্যাকউডস ম্যাগাজিনে গল্প পাঠালেও তা প্রকাশিত হয়নি। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চেম্বার্স এডিনবার্গ জার্নালে। দক্ষিণ আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা সে গল্পের নাম ‘সাসা উপত্যকার রহস্য’। ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় লেখা। ১৮৮০ সালে ‘হোপ অব পিটারহেড’ নামে গ্রিনল্যান্ডেরই এক জাহাজের চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ডয়েল। ১৮৮১ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিনের ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং সার্জারিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এসএস মিয়াম্বা নামের জাহাজের সার্জন হিসেবে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল ভ্রমণ করেন ডয়েল। ১৮৮৫ সালে তিনি ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তবে ডাক্তার হিসেবে চরম ব্যর্থ ছিলেন ডয়েল।
এই ব্যর্থতা তাকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৮৮৬ সালে লিখলেন ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’। এটা ছিল শার্লক হোমস ও ওয়াটসনকে নিয়ে লেখা তার প্রথম কাহিনি। কিন্তু এই কাহিনি প্রকাশ করার মতো প্রকাশক পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। শেষ পর্যন্ত ওয়ার্ড লক অ্যান্ড কো. নামের প্রতিষ্ঠান ১৮৮৬ সালের ২০ নভেম্বর মাত্র পঁচিশ পাউন্ডের বিনিময়ে পাণ্ডুলিপির সব স্বত্ব কিনে নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জোসেফ বেল নামে তার এক শিক্ষক ছিলেন। রোগী দেখার সময় নানারকম প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণ করে তিনি রোগ নির্ণয় করতেন। সেটা নজর এড়ায়নি ডয়েলের। আর সেই জোসেফ বেলের পর্যবেক্ষণ দক্ষতাকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন শার্লক হোমসের কাহিনিতে।
কোনান ডয়েল দুবার ব্রিটেনের নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। এবং তিনি দুবারই হেরে যান। যদিও প্রতিবারই ভালো ভোট পেয়েছিলেন। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল অনেক গল্প, কল্পকাহিনি, ইতিহাসভিত্তিক রোমাঞ্চ কাহিনি লিখলেও বিখ্যাত চরিত্র শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা কাহিনিগুলোই তাকে এনে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা তার গল্পের সংখ্যা ৫৪টি, উপন্যাস ৪টি। একটা সময় শার্লক হোমসকে নিয়ে লিখতেও ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সেই বিরক্তি থেকে ‘তার শেষ অভিবাদন’ (His Last Bow) নামক গল্পে হোম্সকে মেরে ফেলেন। তবে জনতার দাবির মুখে হোমসকে অলৌকিকভাবে বাঁচিয়ে তুলতে বাধ্য হন ডয়েল।
আর্থার কোনান ডয়েল নিজে গোয়েন্দা কাহিনির লেখক হলেও তিনি অতিপ্রাকৃত শক্তিতে অর্থাৎ জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করতেন। ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড শহরের কটিংলিতে দুই বোন পাঁচটি ছবি তুলেছিল। সেই ছবিগুলোতে কিছু ছোট ছোট পরীও ছিল। ওদের বাবা ছিলেন শখের ফটোগ্রাফার। পরে ওদের বাবাই বলেছিলেন, বড় বোন এলসি ছবির কিছু কিছু কারিকুরি শিখেছিল। সম্ভবত এলসিই ছবিগুলোতে কারিকুরি করে পরী বানিয়েছিল। কিন্তু কোনান ডয়েল ছবিগুলোর সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। সেই ছবিগুলো নিয়ে তিনি রীতিমতো একটি বই-ও লিখেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, সে সময় হ্যারি হুডিনি নামের এক জাদুকর বেশ নাম করেছিল। বিশেষ করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বা অন্য কোনোভাবে তাকে বন্দি করে রাখার পর একাই বের হয়ে আসার খেলা দেখানো তিনিই শুরু করেন।
একবার তো জীবন্ত কবর দিয়ে দেওয়ার পর সেখান থেকেও বেরিয়ে আসেন তিনি। জাদুকররা তো মূলত কৌশলে জাদু দেখায়। এ তো আর সত্যি কিছু নয়। শেষ জীবনে সে কথা স্বীকারও করেছিলেন হ্যারি ‘হ্যান্ডকাফ’ হুডিনি। এ কথাও কিন্তু কোনান ডয়েল বিশ্বাস করতেন না! তার ধারণা ছিল, জাদুকররা সত্যিই জাদু জানে। তিনি জাদু জানেন না, কৌশলের মাধ্যমে জাদু দেখান- এটা স্বীকার করার পর হ্যারি হুডিনির সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের ইতি ঘটান আর্থার কোনান ডয়েল।
ব্রিটেনের রানির কাছ থেকে সম্মানসূচক উপাধি নাইটহুড উপাধি পেয়েছিলেন কোনান ডয়েল। সে কারণে তার নামের আগে ‘স্যার’ উপাধি লেখা হয়। তিনি নাইটহুড পেয়েছিলেন বোয়ার যুদ্ধের ওপর লেখা নন-ফিকশন রচনাগুলোর জন্য। আর্থার কোনান ডয়েলের জীবন ছিল বহুমাত্রিক এবং রোমাঞ্চপূর্ণ। বাস্তব জীবনে তিনি দু-দুবার গোয়েন্দাগিরি করে অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের নির্দোষ প্রমাণ করতে সফল হন। উন্মোচন করেছিলেন দুটি সত্যিকার রহস্য। বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দুজনকে। প্রথম রহস্যটিতে ভুক্তভোগী ছিলেন জর্জ এডালজি নামের এক ভদ্রলোক। আরেকটিতে ভুক্তভোগী ছিলেন অস্কার স্ল্যাটার। জর্জ এডালজির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পশু নির্যাতনের। পরে কোনান ডয়েল দেখালেন, এডালজির বিরুদ্ধে যেসব পশু নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে, সেসব পশুকে নির্যাতন করার মতো শারীরিক শক্তিই নেই এডালজির।
তা ছাড়াও, তার বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও ঠিক নয়। জর্জ এডালজির ভাগ্য ভালো ছিল, কোনান ডয়েলের বদৌলতে তিনি বেঁচে যান। তবে অস্কার স্ল্যাটারের ভাগ্য ততটা ভালো ছিল না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এক মহিলাকে খুন করার। কোনান ডয়েল এখানেও দেখালেন, প্রমাণগুলো সবই ভুল। খুনের সময় তিনি অন্যত্র ছিলেন। কিন্তু ততদিনে স্ল্যাটারের রায় হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাড়ে ১৮ বছর কারাভোগের পর ছাড়া পান স্ল্যাটার।
/আবরার জহিন