![ক্যানসার প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য রোগ](uploads/2024/02/01/1706769206.ni-6.jpg)
আগে বলা হতো, ক্যানসার মানে নো অ্যানসার, অর্থাৎ ক্যানসারের কোন চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু এখন সে কথা প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এই ক্যানসারকে প্রতিরোধ করা যায়। এমনকি সঠিক চিকিৎসা করালে রোগীও সুস্থ হয়।
সারা বিশ্বেই ক্যানসার একটি জটিল রোগ। পরিসংখ্যান বলছে, ক্যানসারের কারণে প্রায় ১৩ ভাগ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ জন্য নানা কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ক্যানসারে মৃত্যুর হার কমানোর চেষ্টা চলছে।
ক্যানসার কী?
যখন দেহের কোনো স্থানে অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোষ বৃদ্ধি হয়ে চাকা বা পিণ্ডের সৃষ্টি হয়, তখনই ক্যানসার রূপ ধারণ করে এবং রক্তনালি ও লসিকানালির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মানুষকে অকালমৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
গঠন
মানুষের শরীর বা দেহ গঠিত হয়েছে কোটি কোটি কোষের সমন্বয়ে। এসব কোষের মধ্যে কিছু কিছু কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে দেহের অন্য স্থানগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে যে জটিলতা তৈরি হয়, সেটিই ক্যানসার। দেহের প্রায় সব প্রান্তে এই রোগ ছড়িয়ে জীবন সংকটময় করে তুলতে পারে।
শরীরের বৃদ্ধির সামঞ্জস্যতা, গঠন, চুল ও চোখের রং সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিনের সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যকারিতার জন্যই মানুষ ছোট থেকে বড় হয়।
আবার একপর্যায়ে বৃদ্ধি হওয়াও থেমে যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী কোষসংখ্যা বৃদ্ধিতে যে জিনগুলো ভূমিকা পালন করে থাকে, তার মধ্যে একটি জিন ‘পটোঅনকোজিন’, যা ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ। যেমন- ভাইরাস, রাসায়নিক পদার্থ (কার্সিনোজেন) ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনকোজিনে রূপান্তরিত হলে সেই কোষের বৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকে।
আবার অপ্রয়োজনীয় কোষ সৃষ্টিতে বাধাদানকারী আরেক ধরনের জিন আছে, যার নাম ‘ক্যানসার সাপ্রেসরজিন’। মূলত এই সাপ্রেসরজিনের কার্যকারিতা নিষ্ক্রিয় হলেই ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
কারণ: সুনির্দিষ্ট কোনো কারণে ক্যানসার হয় না। ক্যানসার সৃষ্টিতে অনেক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ থাকে। তবে বংশগত ও পরিবেশগত কারণকেই ক্যানসারের জন্য মূলত দায়ী করা হয়।
বংশগত : প্রমাণ পাওয়া গেছে, ক্যানসারের সঙ্গে জিনগত বা বংশগত সম্পর্ক রয়েছে। তাই পরিবারের কেউ যদি ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তাহলে অন্যদেরও ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বংশগত কারণে সাধারণত যেসব ক্যানসার হয়, তার মধ্যে স্তন ক্যানসার, বৃহদন্ত্রে ক্যানসার, শিশুদের চোখের ক্যানসার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কলোরেক্টাল ক্যানসার ইত্যাদি।
পরিবেশগত: পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ভৌত কারণ: রোদে বেশিক্ষণ থাকার কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া এক্স-রে, গামা-রে অন্যতম কারণ।
রাসায়নিক পদার্থ: রঙের কারখানা, রাবার বা গ্যাসের কাজে যারা নিয়োজিত, তারা এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এ ছাড়া ধূমপানের ধোঁয়ায় বিদ্যমান ক্ষতিকর পদার্থ (কারসিনোজেন), রঞ্জক পদার্থ অসম্পূর্ণভাবে পোড়া আমিষ, শর্করা বা চর্বিজাতীয় খাদ্য ইত্যাদিও দায়ী।
ভাইরাস: কিছু কিছু ভাইরাস ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী। যেমন- হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস, হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস, এপেস্টেইন বার ভাইরাস ইত্যাদি। জরায়ুমুখের ক্যানসারের জন্য দায়ী করা হয় হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসকে। লিভার ক্যানসার হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। আবার এপেস্টেইন বার ভাইরাস দ্বারা গলার ক্যানসার ও লসিকাগ্রন্থির ক্যানসার হয়।
অন্যান্য কারণ: কিডনি বা পিত্তথলির পাথর থেকেও ক্যানসার হতে পারে। সার্ভিক্স বা বোনের ক্রনিক ইনফেকশন থেকে জরায়ু ও বোনের ক্যানসার হয়। রাসায়নিক বা কেমিক্যাল এজেন্ট, যেমন- এনিলিন ডাইয়ে মূত্রথলির ক্যানসার হয়। খাদ্যে ব্যবহৃত ফরমালিন (পচনরোধক পদার্থ) স্টমাক বা পাকস্থলীর ক্যানসার সৃষ্টি করে। চুলের কলপের ব্যবহারে স্কিন ক্যানসার হতে পারে।
চিকিৎসা
ক্যানসারের ধরন অনুযায়ী শল্যচিকিৎসা, রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা, কেমোথেরাপি, হরমোন চিকিৎসা ও ইমিউনোথেরাপি, টারগেটেড থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা প্রদান করা যায়।
শল্যচিকিৎসা (সার্জারি): স্তন, প্রস্টেট ক্যানসারসহ কিছু চিকিৎসায় সার্জারি রোগীকে বেশি আরোগ্য করে। শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া টিউমারের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অবশ্য নগণ্য।
রেডিওথেরাপি : অপারেশনের পরও খালি চোখে দেখা যায় না- এমন কিছু ক্যানসার কোষের সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে দেওয়া হয় রেডিওথেরাপি। বিশেষ করে এ রোগ মস্তিষ্ক বা হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে জরুরিভাবে প্রশমন করার জন্য রেডিওথেরাপির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা খুবই কম থাকে।
কেমোথেরাপি ও হরমোন : ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও হরমোনথেরাপি প্রয়োগ করা যায়। সামগ্রিকভাবে শরীরের সর্বত্রই এ রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য এর ব্যবহার অপরিহার্য। দেখা গেছে, খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণীত হলে এবং যথোপযুক্ত চিকিৎসা নিলে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী ১০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে। মাঝ পর্যায়ে নির্ণীত হলে এই হার ৫০ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে আসে এবং শেষ পর্যায়ে ভালো কিছু করার সুযোগ প্রায় থাকেই না।
অনুলিখন: আতাউর রহমান
কলি