গত ২৫ এপ্রিল মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ইসির সভা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে সংসদ সচিবালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ওই সভায় মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা। তাদের আশঙ্কার জবাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে প্রশাসনের নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপে কমিশন পাশে থাকবে বলে জানানো হয়েছিল।
ডিসি-এসপিদের আশঙ্কা প্রকাশের পর মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবার সেই আশঙ্কা থেকে সংসদ সচিবালয়ে এই চিঠি পাঠানো হলো। বৃহস্পতিবার (২ মে) নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে এ তথ্য জানান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীর।
স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইসি সচিবের লেখা ওই চিঠির বার্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনদের কেউ প্রার্থী থাকবেন কি থাকবেন না, সেটা দলীয় সিদ্ধান্ত। কারণ কোন প্রার্থী কার (মন্ত্রী-এমপি) আত্মীয়, তা নিয়ে আইনে নিষেধাজ্ঞা নেই। ওই বিষয়ে ইসির হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। তবে তাদের আত্মীয়স্বজনদের কেউ যদি প্রার্থী থাকেন, সেই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কোনো ধরনের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে আইনি পদক্ষেপ নেবে ইসি। আমাদের কাছে সব প্রার্থীই সমান। সব প্রার্থীর প্রতি সমান আচরণ করতে এবং নির্বাচনকে ঘিরে প্রভাবশালীদের অনৈতিক চাপ বা প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ পেলে তা আমলে নিতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত করতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্দেশনা জারি করেছে ইসি। কোনো প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সম্পর্কে অভিযোগ (তিনি প্রার্থীর আত্মীয় বা পক্ষের লোক এ রকম) এলে সেই তথ্য যাচাই বা প্রমাণ ছাড়াই তার নিয়োগ বাতিল করা হবে। সে ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার যে প্যানেল থাকবে, সেখান থেকে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্যানেলে যোগ্য লোক না পেলে প্রয়োজনে পাশের জেলা বা উপজেলা থেকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রিসাইডিং অফিসারের কোনো অভাব নেই। তবে কোনো রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ উঠলে তার প্রমাণ অবশ্যই দাখিল করতে হবে।
উপজেলা নির্বাচনকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবমুক্ত রাখতে মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা সফর করছেন নির্বাচন কমিশনাররা। রংপুরে আছেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। সেখানে বৃহস্পতিবার পাবনা জেলার সব উপজেলার প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে ইসি। প্রভাবশালীরা কোনো রকম প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না; তিনি এমপি-মন্ত্রী যে-ই হোন না কেন!’ নির্বাচনি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি। বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে সাধারণ মানুষের কাছে বিতর্কিত করার চেষ্টা, নির্বাচনকে কলুষিত করার চেষ্টা ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্টকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
নির্বাচনে মাঠ পরিস্থিতি
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সব ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ব্যালট পেপার পাঠানোর ব্যাপারেও কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। কেবল দুর্গম এলাকার (পার্বত্য এলাকা, চর, দ্বীপাঞ্চল বা হাওর এলাকা) কয়েকটি কেন্দ্র ছাড়া বাকি সব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ভোটের দিন সকালে ওই সব ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। ব্যালট পেপার ছাড়া অন্য নির্বাচনি মালামাল ভোট গ্রহণের আগের দিন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অন্যান্য ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে যিনি সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, সেই সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোট গ্রহণের দিন সকালে ব্যালট পেপার গ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটসহ পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
দেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৪৭৬টি উপজেলায় এবার চার ধাপে ভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বাকি ১৯টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের সময় এখনো না হওয়ায় পরে সেসব উপজেলায় নির্বাচন আয়োজন করা হবে। আগামী ৮ মে ১৪৪ উপজেলায় ভোট গ্রহণ দিয়ে শুরু হবে ভোটের আনুষ্ঠানিকতা। প্রথম ধাপের উপজেলাগুলোতে এখন জমজমাট প্রচার চালাচ্ছেন ১ হাজার ৬৯৩ প্রার্থী। বেশ কিছু উপজেলায় তিনটি পদে ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
ইসি জানিয়েছে, প্রথম ধাপে অনুষ্ঠেয় সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে ভোট পরিস্থিতি দেখতে মাঠে থাকবেন ৪ হাজার ৯৫৯ জন স্থানীয় পর্যবেক্ষক। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৩ ও সংশ্লিষ্ট আইন মেনে এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৮টি পর্যবেক্ষক সংস্থার কেন্দ্রীয়ভাবে ২৬৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৪ হাজার ৬৯২ জন পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে ১৬০ উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে ২১ মে। এই ধাপে ভোটে অংশগ্রহণকারী ২ হাজার ৫৫ প্রার্থীর মধ্যে ১৭৭ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় চূড়ান্ত প্রার্থী এখন ১ হাজার ৮২৮ জন। গতকাল প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই মাঠের প্রচারে নেমেছেন প্রার্থীরা। তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় ভোট গ্রহণ ২৯ মে ও চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলায় ৫ জুন ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপে ২২টি, দ্বিতীয় ধাপে ২৪, তৃতীয় ধাপে ২১ ও চতুর্থ ধাপে ২টি উপজেলায় ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে।