![প্রথম কালবৈশাখী](uploads/2024/05/18/Pabritra-Sharkar-1716008609.jpg)
এ বছর তার মতো অভ্যর্থনাযোগ্য আর কিছুই ছিল না। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল, কাগজে (রেডিও শোনা হয় না, টেলিভিশনও দেখা হয় না) মার্চ, এপ্রিল- দুই মাসেই কত কত দশকের গরমের রেকর্ড হচ্ছে বলে দেখাচ্ছিল। আর শুধু কাগজ কেন, আমাদের সর্বাঙ্গে যে জীবিত মনুষ্য চর্ম আছে, তা আমার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পুরু, কিন্তু সেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল যে গরম পড়ছে বটে। প্রতিটি পরের দিন আগের দিনটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে গরমে। আমরা দরদর করে ঘামছি, যেখানে ফ্যানের হাওয়া আড়াল হচ্ছে, সেখানে ঘাম জমছে, বাইরে রোদে বেরোলে শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে, ফিরে এসে জল বা ওআরএস গিলছি চোঁ-চোঁ করে, ঘুমের মধ্যে নিদ্রাহীনতা এসে হামলা করছে। সকালে কলের জল দেখতে দেখতে গরম হয়ে যাচ্ছে, কল থেকে চোখেমুখে জল দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। আমি নিজেকে সর্বহারা ভাবি না, কিন্তু এসি চালাতে গিয়ে মাসের শেষে পিলে চমকে দেওয়া বিদ্যুৎ বিলের কথা ভাবব না, এখনো উচ্চবিত্ততার সেই আরামপ্রদ স্তরে উঠতে পারিনি। দিনক্ষণের হিসেবে আর পারার সম্ভাবনাও নেই।
তাই আমারও এবারের গরমে, আমার প্রয়াত স্ত্রীর ভাষায়, ‘পাগল-পাগল’ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, আর দু-এক ডিগ্রি বাড়লেই প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে শুট করে পালাবে। খবরের কাগজে দেখলামও বটে যে, দেশে বেশ কয়েকজন বৃদ্ধবৃদ্ধা মারা গেছে গরমে। আগে জানতাম শীতকালই বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মরবার পক্ষে প্রশস্ত সময়, এখন দেখছি গরমকালও কম যায় না। যা-ই হোক, এই গরমে ‘এবার আমার গেল বেলা’ গোছের একটা কোটেশন যখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন সে এল।
কে? না, বছরের প্রথম কালবৈশাখী। সে যখন দিন তিনেক আগে সন্ধের পর এল, তখন আমি ঘুমোইনি যে বলব, ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে’। তারপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনামতো তার পাল্লায় পড়ে যাব। আসলে সেসব কিছুই হয়নি। এমনকি বললে অবিশ্বাস্য মনে হবে, আমি তার আসা টেরই পাইনি, সম্পূর্ণ জেগে থাকা সত্ত্বেও। আমি ছিলাম আমার বাড়ির পেছনে আমার কম্পিউটারের কুঠুরিতে, কী একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত। ঘরটায় আগে বারান্দা ছিল, এখন কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা। তবে সবই বন্ধ থাকে। কম্পিউটারের চাবি টেপায় ব্যস্ত ছিলাম বলে বাইরের আওয়াজকে বাইক, অটো ইত্যাদির স্বাভাবিক চলাচলের আওয়াজ বলে আমার অন্যমনস্কতা বুঝে নিচ্ছিল, এমন সময় আমার গৃহসহায়িকার সেই নাতি, এগারো বছরের সুদীপ মিস্ত্রি দৌড়ে এসে বলল, ‘দাদু, খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে!’
শুনে আমার একটা ধাক্কা লাগল। আমার অভ্যস্ত প্রতিবেশে আমি বহাল, আর সেখানে ‘ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে’ এই খবরটা আমাকে অন্যের মুখে শুনতে হলো! সারা জীবনে তো এমন কখনো হয়নি!
পাঠক জানেন, আমি গ্রামের ছেলে, শৈশবের বছর এগারো আমার শহর স্পর্শহীন গ্রামে কেটেছে। আমার বাড়ির সামনেই ছিল দিগন্তব্যাপী শস্যক্ষেত্র- তার আন্তরিক কাজই ছিল উত্তর-পুবের নদী আর গ্রামকে ছেড়ে দিয়ে ওই দক্ষিণের আর পশ্চিমের দিগন্তকে যত দূরে ঠেলে সরিয়ে রাখা যায় তার চেষ্টা, আর দূরের গ্রামের গাছপালাগুলোকে কালো পেনসিলের সামান্য দাগের চেহারা দেওয়া। আমাদের আকাশকে সে টেনেটুনে অনেকটা বাড়িয়ে রেখেছিল, যাতে আমাদের মনে হতো আকাশ শুধু সূর্যোদয় সূর্যাস্তের জায়গা নয়, সে নিজেই একটা ঘটনা। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের শেষ দিকের রাতে কখনো গ্রামের মাঠে শুয়ে সেই আকাশকে লক্ষ করেছি, দেখেছি অন্তহীন গ্রহ-নক্ষত্রের মেলা তার গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে গেছে। সেই বিশাল ছড়িয়ে যাওয়া আকাশে দিনের শেষে যখন কালবৈশাখী দেখা দিত তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তাই আমাদের ছিল না। না, শুধু কাঁচা আম কুড়োনোর স্মৃতি নয়।
দেখতাম দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে মেঘের স্তর ছুটে আসছে প্রবল বাতাসে সওয়ার হয়ে, গ্রামের গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে নাড়তে শুরু করেছে, গাছগুলোর ডালপালা এক দিকে হেলে নুয়ে পড়ছে। শস্যক্ষেত্রের অবস্থাও একই রকম বিপর্যয়কর, কিন্তু সবচেয়ে সংকটজনক ছবি মাঠের গরুবাছুরগুলোর। তারা খুঁটি উপড়ে, গলার দড়িটড়িসুদ্ধ লেজ তুলে ঘরের দিকে দৌড় শুরু করেছে হাম্বা হাম্বা আওয়াজ তুলে, রাখালরা ছুটে গিয়ে তাদের সামলাতে পারছে না। কোথাও গরিবের ঘরের টিনের চাল উড়ে গিয়ে পড়ছে, চতুর্দিকে বিপুল বাজ পড়ার শব্দ আর বিজলির ঝলকানি। মা-কাকিমারা অনেক আগেই উঠোনের তারে শুকোতে দেওয়া শাড়ি-ধুতি তুলে এনেছেন, আর উঠোনে একটা জলচৌকি পেতে দিয়েছেন, যাতে ঝড়বৃষ্টির দেবতা বরুণ একটু শান্ত হয়ে বসেন।
তারই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সব জায়গায় একসঙ্গে নয়। গ্রামে বৃষ্টি একটা দিক থেকে ‘আসত’। আমরা দেখতাম আমাদের ওই বিশাল শস্যভূমির ওপর দিয়ে ভারী ধূসর পর্দা বা দেয়ালের মতো একটা বৃষ্টি এগিয়ে আসছে চরাচর আচ্ছন্ন করবে বলে- দৌড়ে আসছে সে, ওই এল, এল, এসে আমাদের গ্রামকে আচ্ছন্ন করে জলধারা ঢালতে লাগল, গাছপালার বিপন্নতা কেটে গিয়ে যেন একটা উল্লাসে শব্দ শুরু হলো, ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি, সারা বছরের তৃষ্ণার তর্পণ!’
আর আমরা ছেলেপুলের দল তখন কী করতাম! প্রায়ই এমন হয়েছে যে সবাই মিলে ওই বৃষ্টিধারার মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতাম, সর্বাঙ্গে প্রতিটি রোমকূপে ওই বৃষ্টিকে ডেকে নিতাম, কখনো মাঠের ঘাসের ওপরে লুটোপুটি খেতে খেতে। সেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার মতো, ‘পথের পাঁচালী’ তো আমাদেরই শৈশবকে আশ্রয় দিয়েছিল। এখনো এই বৃদ্ধের সারা শরীরে সেই বৃষ্টিজলের প্রথম স্পর্শের স্মৃতি যেন জেগে ওঠে। জেগে ওঠে ধারাস্নান করার অজস্র স্মৃতি।
হায় ২০২৪-এর কলকাতার শহরতলির প্রথম কালবৈশাখী, এবারকার বীভৎস দাবদাহে তুমি যতই কাঙ্ক্ষিত হও, বরণীয় হও, আমি তো তোমাকে সেই শৈশবের মতো তেমন করে অভ্যর্থনা জানাতেই পারলাম না। আরও লজ্জার কথা যে, তুমি এসেছ তা টেরই পাইনি আমি। আমার শহরতলির আকাশ তো অনেক ছোট, তোমার খেলবার জায়গা, তোমার মহিমা আমরা কেড়ে নিয়েছি। অথচ এই ২০২৪-এর গ্রীষ্মে তোমার মতো প্রার্থিত আর কিছুই ছিল না।
এ বছরের প্রথম কালবৈশাখী, বৃদ্ধ হয়েছি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়