সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে । খবরের কাগজ
ঢাকা ২০ বৈশাখ ১৪৩১, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪

সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে
সুলতানা কামাল

ধর্ষণ বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। শিক্ষার মাধ্যমে যদি সামাজিকভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার মতো সংস্কৃতি তৈরি করা যায়, তাহলে অপরাধ কমে আসবে। একই সঙ্গে সরকার যদি অপরাধ দমনে আন্তরিক থাকে, তাহলেও অপরাধ দমন সহজ হয়ে যায়। কিন্তু সরকার যখন আন্তরিক থাকে না, তখন অপরাধ দমন অনেক কঠিন হয়ে যায়। 

সরকারের পক্ষপাতিত্ব আছে। সবকিছুতে দলীয়করণ করা হয়েছে। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ সবকিছুতে দলীয়করণ করা হয়েছে। দলীয় যে সদস্যরা আছেন তারা এসব করে পার পেয়ে যাবেন, এ জন্য তারা এসব অপরাধ করেন। সেই অপরাধের শাস্তি হয় না বলে এসব অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। 

মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১১:১৪ এএম
বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার চ্যালেঞ্জ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য একটি দেশের ঋণের প্রয়োজন হয়। ব্যক্তি পর্যায়, বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেমন ঋণের প্রয়োজন হয়, তেমনি সরকারেরও ঋণের প্রয়োজন হয়। ঋণ সাধারণত দুটি উৎস থেকে আসে। এক. অভ্যন্তরীণ ঋণ, দুই. বৈদেশিক ঋণ। তুলনামূলকভাবে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ দেখা যায়। এই নিবন্ধে সরকারি বৈদেশিক ঋণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।

অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে আমরা সাধারণত দেখি, বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্র আছে, ডিফেন্স বন্ড আছে, ওয়েজ আর্নার্স বন্ড আছে, যেটা দেশের জনগণের কাছ থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে। এবং সেটা দেশীয় মুদ্রায় সুদ পরিশোধ করে, আবার বিদেশি মুদ্রায় যেটা বিদেশি বন্ড মানে ডলার বন্ড, ইনভেস্টমেন্ট বন্ড যেটা আছে সেটা। আরেকটা বড় উৎস বৈদেশিক ঋণ। বৈদেশিক ঋণ ঢালাওভাবে আমরা বলি।

একটা হলো আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিদেশি কোনো রাষ্ট্র থেকে বা আন্তর্জাতিক কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ, যেটার সুদ দিতে হয় এবং সেটার একটা মেয়াদে থাকে। আরেকটা হলো বিদেশ থেকে আমরা ঋণ নিই কোনো প্রকল্প- যেমন একটা হাসপাতাল তৈরি করা, একটা ব্রিজ তৈরি করা, একটা টানেল বানানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তারপর ফুড এইড আছে, ফুডের জন্য ঋণ নয়; সেটা সাহায্য। তারপর অনুদান আছে, যেটা বিভিন্ন স্বাস্থ্য, শিক্ষার ক্ষেত্রে দিয়ে থাকে। বিদেশি ঋণের জন্য নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হয়, পরিশোধ করতে হয়। এটা সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে একইভাবে আমরা বিভিন্ন সময় ঋণ নিয়েছি।

বৈদেশিক ঋণ সরকারের মোট দেশজ আয়ের কত শতাংশ, সে বিষয়ে প্রথমে দৃষ্টিপাত করা হয়। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সর্বমোট দেশি-বিদেশি ঋণ কিন্তু জিডিপির ৪০ থেকে ৪২ শতাংশের বেশি নয়।

এটা মোটামুটি একটা সহনীয় পর্যায়ের। বিভিন্ন দেশে কিন্তু ঋণ অনেক বেশি থাকে। এবং সেটা অনেক সময় জিডিপির শতভাগের ওপরে উঠে যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কিন্তু আমাদের চেয়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেশি। আমরা জানি, গ্রিস ও ইতালিতে ঋণের বোঝা এত বেশি বেড়েছিল যে তাদের জিডিপির চেয়ে বেশি ছিল ঋণের শতাংশ। তাদের শোধ দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। পরে আইএমএফ, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং অন্যান্য সংস্থা তাদের সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক ঋণ কিন্তু খুব বেশি নয়।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের চ্যালেঞ্জসমূহ এখন আমাদের জন্য কতগুলো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, ঋণ যেটা নিচ্ছি, সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করছি কি না? মানে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ঋণটা ব্যবহার করা হচ্ছে কি না? অনেক সময় দেখা যায়, বাইরের আর্থিক সংস্থাগুলো কিংবা অন্যান্য সংস্থা আমাদের ঋণ নিতে প্রলুব্ধ করে। এতে সরকার এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেকে ঋণটা নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়। সেই টাকা খুব বেশি দরকারে লাগুক বা না লাগুক- ঋণটা পেলে সেটার একটা অংশ কনস্ট্রাকশনসহ নানাভাবে খরচ করা হয়। কারও কারও লাভ হয়। আবার অনেকে এর থেকে কমিশনও নিয়ে থাকে। অতএব, এই ধরনের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। এখানে আমাদের প্রয়োজনটা সবার আগে ভাবতে হবে।

দ্বিতীয়ত, যে ঋণ আমরা নিয়ে থাকি, এটা সময়মতো যেন ব্যবহার করি। এখানে যেন দীর্ঘসূত্রতা না হয়। পাঁচ বছরের প্রজেক্টে ১৫ বছর লেগে গেলে অনেক খরচ বেড়ে যায় এবং সে ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারটা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রথমটা হলো ব্যবহার, দ্বিতীয়টা হলো ঋণের সুদের সামর্থ্য। দুটির প্রতিই আমাদের লক্ষ থাকতে হবে।

তৃতীয়ত হলো, ঋণের সুদের হার কেমন, ঋণ কত মেয়াদে দিচ্ছে সেটা। অনেক সময় দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- এদের ঋণের সুদের হার কিন্তু বেশ কম। এগুলো সফট লোন, মানে সহজ শর্তের ঋণ; সেটা ১.২৫ বা ১.৫-এর বেশি হয় না। সেটা অত্যন্ত সহজ শর্তে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দেওয়া হয়। গ্রেস পিরিয়ড থাকে। মানে সুদবিহীন একটা সময় দেওয়া হয়। এবং শোধ দেওয়ার সময় ১৫ থেকে ২০ বছর মেয়াদি হয়ে থাকে।

আবার কিছু ঋণ আছে আমরা বাই-লেটারালি বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নিয়ে থাকি। আবার কিছু দ্বিপক্ষীয় ঋণ আমরা কঠিন শর্তে নিয়ে থাকি, যেটাকে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট বলে। তার মানে একটা দেশ থেকে ঋণ নিলাম, সে ঋণের সুদের হার একটু বেশি হয়। ঋণের মেয়াদটাও কম হয়; দুই থেকে পাঁচ বছর, পাঁচের বেশি অনেক সময়ই হয় না। সেখানে আবার সুদের হার বেশি থাকে। আর যদি সেটা কোনো প্রজেক্ট বা উন্নয়নকাজে ব্যবহার করা হয়, সে প্রজেক্টে যে দ্রব্যসামগ্রী বা কনসালট্যান্ট, সেগুলো কিন্তু যে দেশ ঋণ নেয়, সে দেশ থেকেই নিতে হয়। এই হার্ড টার্ম বা কঠিন শর্তের ঋণ কিন্তু তেমন সুবিধার নয়। সেই ঋণটায় নানা রকম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। আমাদের জন্য সেটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে না। অনেক সময় সেটা তারা তাদের ইচ্ছামতো বন্ধ করে দেয়।

অতএব, কোন দিক থেকে ঋণ আনব, সহজ শর্তের ঋণ কি না, সুদ কত হবে- এই জিনিসগুলো দেখা দরকার। এগুলো যদি আমরা না দেখে ঋণ নিই, তাহলে কিন্তু আমাদের ওপর ঋণ একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

গত ১০ থেকে ১৫ বছরে বৈদেশিক ঋণ কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে। একটা হিসাবে দেখা গেছে, প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার আমরা ঋণ নিয়েছি এই কয়েক বছরে। এটা একটা বিশাল অঙ্ক। এই ঋণগুলো বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়েছে। আমরা দেখি, ব্রিজ, কালভার্ট, টানেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, রেললাইন নির্মাণে ঋণ নেওয়া হয়েছে। সব কটি যে একবারে প্রাধিকারভুক্ত বা সব কটি স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের উপকারে আসবে- সেটা নয়। এতগুলো ঋণের বোঝা নেওয়ার আগে আমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল।

আমরা প্রতিবছর বাজেটে দেখি, একটা বিশাল অঙ্কের টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ খাতে চলে যায়- সুদ এবং আসল দুটিই। এই সুদ-আসলে পরিশোধের ব্যাপারটা দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগামী দুই বছর তথা ২০২৬ থেকে বেশ কতগুলো ঋণ আমাদের সুদ-আসলে পরিশোধ করতে হবে। আমাদের ফরেন রিজার্ভের যে অবস্থা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পরিশোধ দেওয়ার ব্যাপারটা একটু কঠিন হবে। এখন থেকে আমাদের কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে এবং ফরেন রিজার্ভের ফ্লো বাড়াতে হবে। না হলে আমরা ঋণের কিস্তি বা সুদ-আসল পরিশোধ করতে সক্ষম হব না।

কিছুদিন পর বাজেট আসছে। ঘাটতি বাজেট হবে। ঘাটতি বাজেটের একটা বিশাল অংশ মেটাতে হবে অভ্যন্তরীণ ঋণ, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি থেকে। আরেকটা হলো ব্যাংক থেকে ঋণ করা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। তৃতীয় আরেকটা বিশেষ বিষয় হলো বৈদেশিক ঋণ। বিশাল অংশ কিন্তু বৈদেশিক ঋণ থেকে আসবে। অতএব, সরকারের দেশীয় ঋণ শোধ, বৈদেশিক ঋণ শোধ করাটা একটা চিন্তার ব্যাপার। এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় একটা বিষয় হলো অনেক ঋণ আছে স্বল্পমেয়াদি। এক-দুই বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। আমাদের ফরেন রিজার্ভ এমনভাবে থাকতে হবে, যাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলো আমরা সহজে শোধ দিতে পারি। ১০ বা ১৫ বছরের ঋণগুলো হয়তো একটু দূরে থাকবে, সেগুলো নিয়ে এখনই এত চিন্তাভাবনা করতে হবে না। এসব স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ বাজেটে প্রতিফলন ঘটবে।

আমাদের একটা ভালো দিক, আমরা এখন পর্যন্ত ঋণখেলাপি হইনি। সেদিক দিয়ে ঋণদাতাদের কাছে আমাদের মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, যদিও সেই গ্রহণযোগ্যতা এখন ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জের মুখে। কেননা ঋণদাতারা সুদের হার বাড়াতে চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের যে অবস্থা এবং আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে আছি, ঋণদাতারা তাকে একটু ঝুঁকি হিসেবেই গণ্য করবে। সেই ঝুঁকিটা তারা কাভার করে সুদের হার বাড়িয়ে। যেমন- ফিনল্যান্ড, সুইডেন বা ইউরোপের কোনো দেশে যদি কেউ ঋণ দেয়, সেখানে সুদের হার অনেক কম। ঝুঁকি নেই। সেসব দেশে দুর্নীতি কম। ঋণ ভালোভাবে তারা ব্যবহার করে।

অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা; যেমন- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো- এসব দেশে আইএমএফ শুধু ঋণ দিচ্ছে, সাহায্য করছে, বেল আউট করে, সেটা কিন্তু মোটেও ভালো জিনিস নয়। আর্জেন্টিনা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে আইএমএফের সহায়তা নিয়েই চলছে। এখনো শেষ হচ্ছে না। পাকিস্তান যেমন প্রায়ই ডিফল্ট করছে। ঋণ নিচ্ছে আইএমএফ থেকে, বিভিন্ন দেশ থেকে, ডিফল্ট করছে। অসুবিধায় পড়ছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাও এই সমস্যায় পড়েছে। এই উদাহরণগুলো আমাদের কাছে আছে। এসব থেকে আমাদের শিক্ষণীয় যে, ঋণ আমাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। দেখতে হবে ঋণটা যেন আমরা সঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারি।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, ঋণের বোঝা কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। সম্প্রতি একটা সভায় বলা হয়েছে, মানুষের মাথাপিছু ঋণ প্রায় দেড় লাখ টাকা হয়ে যাবে। এটা একটা হিসাব। এটা একেবারে সঠিক না হলেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে, দিন দিন কিন্তু মাথাপিছু ঋণের হার বাড়ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর যেন আমরা ঋণের বোঝা ক্রমাগত চাপিয়ে না দিই।

আরেকটা বিষয় হলো, আমাদের ফরেন রিজার্ভ, সেটা বাড়াতে হবে। এক্সপোর্ট বাড়ানো দরকার। রেমিট্যান্স বাড়ানো দরকার। ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট তথা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এগুলো বাড়াতে হলে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো শক্ত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বলতে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কথা বলছি। দ্বিতীয়ত, দেশের আইনকানুনগুলো সহজতর করতে হবে। আইনকানুন থাকবে, কিন্তু কোনোক্রমেই যেন সেটা বিদেশিদের জন্য বাধাস্বরূপ না হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলার ব্যাপার আছে। এরপর আছে দুর্নীতির ব্যাপকতা। এগুলো না সমাধান করলে কিন্তু এফডিআই আসবে না। অতএব, এই জিনিসগুলো আমাদের বিশেষভাবে লক্ষ করতে হবে।

আসন্ন বাজেটে স্থানীয় সম্পদ আহরণ করার চেষ্টা করতে হবে। সেটা ট্যাক্সের মাধ্যমে হোক এবং অন্যান্য মাধ্যমে হোক। আমি মনে করি, প্রত্যক্ষ ট্যাক্সের মাধ্যমে বেশি অর্থ আহরণ করতে হবে। আরেকটা হলো এডিপি বা উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রজেক্টের সংখ্যা যেন বেশি না হয়। এগুলো দ্রুত, খুব সুষ্ঠুভাবে দক্ষতার সঙ্গে শেষ করতে হবে। তবেই কিন্তু আমাদের বাইরে থেকে ঋণ নেওয়া সার্থক হবে। এটার সুফল আমরা সবাই পাব।

ঋণের বোঝা বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণের কার্যকারিতা ও সুফল সম্পর্কে বাংলাদেশের যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বহু দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশ বৈদেশিক ঋণের ভারে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

প্লাস্টিকদূষণ রোধে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১১:০৮ এএম
প্লাস্টিকদূষণ রোধে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন
ড. এম এ ফারুখ

মানবসভ্যতার চলমান ধারায় খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ সব ক্ষেত্রেই প্লাস্টিক পণ্য একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পরিবেশদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ এবং ভূমিদূষণের অন্যতম প্রধান নিয়ামক প্লাস্টিক। তদুপরি, তা আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বপ্রথম ১৮৫০ সালে আলেকজান্ডার পার্কস প্রাকৃতিক রাবার থেকে প্লাস্টিক তৈরি করেন, পরবর্তী সময়ে ১৮৬৯ সালে জন ওয়েসলে কৃত্রিম পলিমার ও সেলুলয়েড ব্যবহার করে প্লাস্টিক তৈরি করেন। বর্তমানে আমরা যে প্লাস্টিক ব্যবহার করি তা সম্পূর্ণ কৃত্রিম প্লাস্টিক; যা ১৯০৭ সালে লিও বেকেল্যান্ড তৈরি করেন।

১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বে উৎপাদিত প্লাস্টিকের পরিমাণ ছিল ৬.৩ বিলিয়ন টন। এর মধ্যে ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে, ১২ শতাংশ পোড়ানো হয়েছে, বাকি সব সমুদ্রে, নদীতে, পুকুরে, খালে, ডোবায়-নালায় ও আবাদি জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইনসিনারেটর অল্টারনেটিভস-জিএআইএর ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পতিত হচ্ছে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তবে ২০৫০ সালে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ১ হাজার ২০০ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়াবে। প্রাত্যহিক জীবনে সমগ্র বিশ্বে প্রতি মিনিটে তরল পদার্থের সঙ্গে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল ক্রয় করা হয়। প্রতিনিয়ত আমরা প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করলেও দেখা গেছে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ একবার ব্যবহারের পরই ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নামে পরিচিত। বিগত এক দশকে আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পরিমাণ বিগত এক শতাব্দীর ব্যবহৃত প্লাস্টিকের থেকেও বেশি। প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি মিনিটে সাগরে পতিত হওয়া প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার ৮০০টি। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি থাকবে। প্রতিবছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেলের মতো তেলের দরকার হয়। শুধু এক কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে দুই থেকে তিন কেজি পরিমাণ বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গত হয়; যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে এবং বিগত ৫০ বছরে সমগ্র পৃথিবীতে জনপ্রতি এক টনের বেশি প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদিত হয়েছে। পচনরোধী প্লাস্টিক দ্রব্যের ১০ শতাংশ পোড়ানো হলেও বাকি ৯০ শতাংশ পরিবেশে থেকে যাচ্ছে, যা প্রায় ১ হাজার বছর পর্যন্ত মাটিতে বা পানিতে বিদ্যমান থাকতে পারে।

সার্বিক ফলাফলে সমুদ্রের জলজ প্রাণীগুলো খুব সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে ও সমুদ্রের পরিচিত প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। ঘরের পাশে খাল-বিল, পুকুর ও নদী প্লাস্টিক বর্জ্যে মৃতপ্রায়। ঢাকার চারপাশের সব নদীর পানি বহু আগেই তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়েছে। সমুদ্রে জমে থাকা প্লাস্টিকের ওপর যখন সূর্যের আলো পড়ে, তখন সেটি মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। আর এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মাছের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। শুধু সমুদ্রে পতিত হওয়া প্লাস্টিকের কারণে প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক জলজ প্রাণী নানা রোগে আক্রান্ত হয়।

ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি প্রদেশের ওয়াকাতোবি ন্যাশনাল পার্কসংলগ্ন উপকূলে ১ হাজার প্লাস্টিকের ব্যাগ গিলে সমুদ্রে তিমির করুণ মৃত্যুর খবর আমরা জেনেছি। ধারণা করা হচ্ছে, শুধু প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সমুদ্র থেকে কচ্ছপ একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শুধু জলজ প্রাণী নয়, প্রায় ১০ লাখের মতো পাখি প্রতিবছর প্লাস্টিকদূষণের শিকার হয়। জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ১২৪ টন প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য তৈরি হয়, যার ৮৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। বাকি যে অংশটি ব্যবহৃত হয় না, তার বেশির ভাগ পলিথিন। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নগর অঞ্চলগুলোতে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে সে পরিমাণ ৩ গুণ বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে। বিস্মিত হতে হয় এটা জেনে যে, প্রতিদিন সারা বিশ্বে যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় তার ৫০ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য কাপ, চামচ, খাবার প্লেট বা পলিথিন।

প্লাস্টিক তৈরিতে সচরাচর ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদি যেমন- থ্যালেক্স, ভারী খনিজ, বিস্তানল-এ, ননিফেনল, ডাইক্লোরো-ডাইফেনাইল-ট্রাইকোরো ইথেন, ফেনানথ্রিন, পলিক্লোরিন-ডাই-ফিনাইল-ইথার সবকিছুরই পরিবেশ, মানুষ এবং পশুপাখির ওপর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সাধারণত চিকিৎসাসামগ্রী, পানি এবং বিভিন্ন ধরনের পানীয় ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। রেফ্রিজারেটর, খেলনা ও পিভিসির পাইপ তৈরিতে প্লাস্টিক মূল উপাদান। প্লাস্টিকের বোতলে অথবা অন্য কোনো পাত্রে বেশি দিন খাবার সংরক্ষিত রাখলে তা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক যেটা ৫ মিলিমিটারের কম ঘনত্বসম্পন্ন তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ এটি ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে আণুবীক্ষণিক বিষাক্ত পদার্থে পরিণত হয় এবং অতি সহজে মাটি ভেদ করে ভূগর্ভস্থ পানির আধার বিষাক্ত করে তোলে।

এ ছাড়া প্লাস্টিকের বর্জ্য পোড়ানোর ফলে অদৃশ্য মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বায়ুদূষণ ঘটায়, যা নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের মধ্যে মাইক্রোবিডস থাকে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আবার প্লাস্টিক পোড়ানোর সময় মিথেন গ্যাসযুক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। গাছপালা, ফসলসহ সব প্রাণীর জন্যই প্লাস্টিক ক্ষতিকর। ক্যানসার, চর্মরোগ ও শ্বাসনালির অসুখের মতো অসুস্থতার কারণও এটি। প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে শহরের ড্রেন ও নর্দমাগুলো বন্ধ থাকায় সারা বছরই পানি জমে মশার প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়, সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসের। বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি অথবা মাছ ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুকরা গিলে ফেলে। এগুলো তাদের পেটের ভেতরে জট পাকিয়ে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়।

প্লাস্টিকদূষণ থেকে বাঁচতে হলে প্লাস্টিক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিবেশবিষয়ক ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা। জনগণকে পাট, কাপড় এবং কাগজের ব্যাগ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরির জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। জাপানের শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের পর নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য প্রসেস করে রাস্তা ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়।

প্লাস্টিকদূষণে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ফিলিপাইন। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা শহরের পাশে বাহানাম নামক গ্রামটি প্লাস্টিকদূষণ রোধের উদ্দেশ্যে অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামটিতে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৩০ থেকে ৪০ পেসো। এই গ্রামে দুই কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে এক কেজি চাল বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে এবং এতে করে গ্রামবাসীর মধ্যে প্লাস্টিক যেখানে-সেখানে ফেলার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। আমাদের দেশেও প্লাস্টিক বর্জ্যকে রিসাইক্লিং করে ব্যবহারের উপযোগী করা যেতে পারে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক তৈরি করতে উদ্যোগী হওয়া দরকার। নদী-নালা, খাল-বিল ও আবাদি জমিতে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলার ব্যাপারে জরুরি আইন প্রয়োজন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার, টেকনাফ সৈকতসহ দেশের ছয়টি এলাকাকে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে।

তদুপরি, সেন্ট মার্টিন সৈকতের প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চোখে পড়ে কাচের বোতল, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, স্ট্র, বিস্কুটের প্যাকেট, মাছ ধরার জালের টুকরা, নাইলনের দড়িসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য, যা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডস ওয়েল প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীব্যাপী পরিবেশের বিপর্যয় শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; যা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ২০৫০ সাল নাগাদ এবং এ সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে অভিবাসিত হবে প্রায় ৪ কোটি মানুষ এবং যার অর্ধেকই হবে বাংলাদেশের।

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে এবং নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত সমুদ্র সম্মেলনে ২০২৫ সালের মধ্যেই স্বেচ্ছায় সামুদ্রিক দূষণ কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করে। অথচ প্লাস্টিকদূষণে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান দশম। সরকার পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করেছে, ১৯৯৫ সালে পাস হয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন। ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিবেশদূষণ রোধে প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক। একবার ব্যবহারযোগ্য বা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। সর্বোপরি, বাংলাদেশের ধমনিতে প্রবাহমান নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে, বিপন্ন পরিবেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়, দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য ধরণির প্রত্যাশায় এবং মানবসভ্যতার অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্লাস্টিকদূষণের ভয়াবহতা ও তার প্রতিকারে সচেতনতাসহযোগে কার্যকর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ আশু প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]

মে দিবসের তাৎপর্য এবং বিদ্যমান বিশ্ব

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪, ১০:০৪ এএম
মে দিবসের তাৎপর্য এবং বিদ্যমান বিশ্ব
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নিয়ে যে বিক্ষোভ সমাবেশ পালিত হয়েছিল, ওই সমাবেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে ১০-১২ জন শ্রমিকের আত্মত্যাগে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা নির্ধারণে বাধ্য হয়েছিল রাষ্ট্র ও মালিকশ্রেণি। বিদ্যমান বিশ্বজুড়ে শ্রমিকের আত্মদানে বিশ্বের সব শ্রমিকশ্রেণির মানুষের জীবনে কর্মঘণ্টার পরিবর্তন ঘটলেও; সামগ্রিকভাবে শ্রমিকদের জীবনে আর কোনো পরিবর্তন সূচিত হয়নি, রুশ বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত। সমাজতন্ত্র ত্যাগের ফলে বিশ্বে শ্রমিকশ্রেণি মানুষ পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে। মুনাফাবাজদের মুনাফার যন্ত্র হিসেবে অহর্নিশ শ্রম বিক্রি করেও তাদের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এবং পারার কথাও নয়।

১৯১৭ সালে রুশ দেশে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় সেটি যে শ্রেণিবিভাজন ভাঙতে পেরেছিল তার কারণ মেহনতিদের সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল। এবং মতাদর্শিক অবস্থানটা ছিল পরিষ্কার। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেনিন। তিনি বিপ্লবী ছিলেন, নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না, যে জন্য তিনি রাষ্ট্র ভেঙেছেন রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেই এবং রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছেন রাষ্ট্র ভাঙার কাজে। কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নও তো টিকল না। প্যারি কমিউনের পতন ঘটেছিল ৭২ দিনে, সোভিয়েট ইউনিয়নের ৭২ বছরে। সময়টা দীর্ঘ, তবুও টিকেছে যে এমন তো বলা যাচ্ছে না।

না-টেকার একটা কারণ বহির্বিশ্বের পুঁজিবাদী অবরোধ, আরেকটি কারণ রাষ্ট্রের ভেতরে সুবিধাভোগী ও সুবিধালোভী একটি শ্রেণির গড়ে ওঠা। স্পার্টা যেমন এথেন্সকে সহ্য করতে পারত না, যুদ্ধ চাপিয়ে রেখেছিল, আমেরিকাও সেই রকমের কাজই করেছে, সোভিয়েট ইউনিয়নের ওপর স্নায়ুযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু স্পার্টারূপী আমেরিকা এখন মোটেই ভালো নেই। গোটা পুঁজিবাদী বিশ্বই এখন ভয়ংকরভাবে নড়বড়ে। বিশ্বব্যাপী তার বিস্তার এবং বিশ্বব্যাপীই মনুষ্য সমাজ এখন হব্স-কল্পিত আদিম সমাজের মতোই বর্বরতার ভেতর নিক্ষিপ্ত। কোনো সামাজিক চুক্তি সই করে এখান থেকে বের হওয়া যাবে, এমন ভরসা মোটেই নেই। মুক্তির জন্য প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের; প্রতিটি দেশে, আলাদা আলাদাভাবে।

সমাজবিপ্লবের পথে অনেক অন্তরায় আছে, একটি অন্তরায় উদারনীতিকরা, যাদের প্রসঙ্গটা দর্শনের ইতিহাসে নানাভাবে আসে। উদারনীতিকরা আসলে সংস্কারপন্থি, কখনো কখনো ভান করেন সমাজবিপ্লবীর, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই চেষ্টা করেন বিদ্যমান ব্যবস্থাটে টিকিয়ে রাখতে। ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। তারা এখান থেকে ওখান থেকে নেন, কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট পন্থার সন্ধান দিতে পারেন না। উদারনীতিকদের পক্ষে চমৎকার স্বীকারোক্তি নিয়েছেন তাদেরই একজন; ঔপন্যাসিক ই এম ফরস্টার (১৮৭৯-১৯৭০)। তার হাওয়ার্ডস অ্যান্ড উপন্যাসে, ১৯১০ সালে, তিনি সরাসরি বলে দিয়েছেন, ‘হতদরিদ্রদের নিয়ে আমাদের কারবার নয়। হতদরিদ্ররা চিন্তার বাইরে। তাদের কাছে যেতে পারেন শুধু পরিসংখ্যানবিদ অথবা কবি। আমাদের কারবার ভদ্রমানুষদের সঙ্গে অথবা তাদের সঙ্গে যারা ভান করতে বাধ্য হয় যে, তারা ভদ্রশ্রেণির।’

পুঁজিবাদ এখনো দৌরাত্ম্য করছে। মচকেছে, কিন্তু ভাঙেনি। এবং পাছে ভেঙে পড়ে এই আশঙ্কায় নানাবিধ অশুভ তৎপরতায় ব্যস্ত রয়েছে। পুঁজিবাদীদের পক্ষে রাষ্ট্র এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আছে, রয়েছে আইনকানুন ও শিক্ষাব্যবস্থা; তার পক্ষ নিয়ে সর্বক্ষণ কাজ করছে মিডিয়া। পুঁজিবাদ চেষ্টা করছে মানুষকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডির ভেতর আটকে ফেলতে। ছোট দ্বন্দ্বগুলোকে বড় করে দেখানো হচ্ছে, বড় দ্বন্দ্বকে আড়ালে রাখার প্রয়োজনে। ক্ষুদ্র মোবাইল, ফেসবুক, ইন্টারনেট- আনন্দলাভের এসব আয়োজনের ভেতর দিয়ে বিচ্ছিন্নতাকে সে বাড়িয়ে দিচ্ছে। নেপথ্যে থেকে পুঁজিবাদের সঙ্গে বিরোধিতার ছদ্মবেশে সহযোগিতা করছেন উদারনীতিকরা। এই সহযোগিতার উজ্জ্বল একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের নির্বাচনে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা এখন আর অ্যাডাম স্মিথের যুগে নেই, তারা যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাইবে এটা এখন আর মোটেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিপক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন একজন সমাজতন্ত্রী, বার্নি স্যান্ডার্স। দাঁড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা সরাসরি হতো। স্যান্ডার্স জিতলে তো ভালো ছিলই, না জিতলেও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক শক্তির গড়ে ওঠার জন্য সুবিধা হতো। উদারনীতিকরা কিন্তু সেটা হতে দেননি। স্যান্ডার্সকে তারা মনে করেছেন চরমপন্থি। তারা দাঁড় করিয়েছেন হিলারি ক্লিন্টনকে, যিনি মোটেই সমাজতন্ত্রী নন এবং প্রার্থী হিসেবে একাধিক কারণে দুর্বল। পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবেন না, এটাই ছিল হিলারি ক্লিন্টনের বড় যোগ্যতা, উদারনীতিকদের বিবেচনায়। শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পই জিতেছেন, জেতার জন্য কাজে লাগিয়েছেন বর্ণবাদ ও নারীবিদ্বেষকে এবং নিজেকে উপস্থিত করেছেন একজন বাপের বেটা হিসেবে, যেন নিৎসে-প্রত্যাশিত অতিমানবদেরই একজন, অভিমুখ যার হিটলারের দিকে। পরাজিত হয়েছে উদারনীতি। সারা ইউরোপে এখন এই ঘটনাই ঘটছে। ঘটেছে ভারতেও।

উপমহাদেশে আমরা যে অবস্থায় বসবাস করছি সেটা নৈরাজ্যজনক। এখানে রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু মূল আন্দোলন সমাজ-পরিবর্তনকে নিজের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেনি। দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু তার লক্ষ্য বিদ্যমান সমাজকে ভাঙা ছিল না, লক্ষ্য ছিল সংস্কারের মধ্য দিয়ে সমাজকে রক্ষা করা। মেহনতিদের হয়ে, তাদের পক্ষে তিনি রাজনীতি করেননি, রাজনীতি করেছেন উদারনীতির তথা পুঁজিবাদের পক্ষে।

লিসবনের সেই ভয়ংকর ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয় বিহারেও ঘটেছিল, লিসবনের ঘটনার ২০০ বছর পর। তার জন্য গান্ধী ঈশ্বরের উদাসীনতাকে দায়ী করেননি। সেকালের পাদ্রিদের মতোই দায়ী করেছিলেন মানুষের পাপকে, বলেছিলেন যে, ওটি ছিল অস্পৃশ্যতার পাপের জন্য ঈশ্বর-প্রদত্ত শাস্তি। কার পাপে কে শাস্তি পেল এ প্রশ্ন উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথও তুলেছিলেন, কিন্তু গান্ধী কোনো উত্তর দেননি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইহজগৎবিমুখতা তৈরি করাটা পুঁজিবাদীদের রণকৌশল। বিমুখতার ওই ঐতিহ্যের মধ্যেই উপমহাদেশ আছে। এখনো।

গান্ধীর সময়েই নিজের দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনে ছিলেন লেনিন। তার দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি লড়ছিলেন মেহনতিদের মুক্তির মধ্য দিয়ে সব মানুষের জন্য সুখ নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে। এবং নিজের দেশে তিনি সফলও হয়েছিলেন। জন্মসূত্রে লেনিন মেহনতি শ্রেণির মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তিনি তাদের কাছে গেছেন। গেছেন শ্রেণিচ্যুত হয়ে। শ্রেণিচ্যুতির ওই কাজটা উদারনীতিকরা করতে পারেন না। রক্ষণশীলদের জন্য তো সেটা অকল্পনীয়।

আমরা দেখেছি প্লেটো মনে করতেন গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খদের রাজত্ব। জবাবে বলা যায়, অভিজাততন্ত্র হচ্ছে মেহনতিদের মূর্খ করে রেখে সমুদয় সুখ নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। শাসনের অধিকারটা কেবল শাসকদেরই, শ্রমজীবীদের কাজ শ্রম করতে থাকা, প্রাচীন দার্শনিকদের পক্ষে জ্ঞানতাত্ত্বিক এই বিভাজনটা তৈরি করাটা ছিল শ্রেণি-বিভাজনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তুতি। সমাজ এগিয়েছে। প্লেটোর সময়ের দাসব্যবস্থা ছেড়ে, সামন্তব্যবস্থা পার হয়ে, সভ্যতা পৌঁছেছে পুঁজিবাদী স্তরে। প্লেটোর ফ্যাসিবাদী রিপাবলিকের সঙ্গে টমাস মুরের সমাজতন্ত্রী ইউটোপিয়ার দ্বন্দ্বটা চলছে। ইতিহাস অপেক্ষা করছে মীমাংসার জন্য। মীমাংসা আপসের মধ্য দিয়ে হবে না, ঘটবে রিপাবলিকের পরাজয় এবং ইউটোপিয়ার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই। এর জন্য জ্ঞানের চর্চা অত্যাবশ্যক।

আমাদের বাংলাদেশে জ্ঞানের চর্চা এখন অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। জ্ঞানের চর্চা এখানে বাধা পায় ক্ষুধার কারণে। সমাজ ক্ষুধার্ত। মেহনতিরা তো ক্ষুধার্ত থাকবেই, অভিজাতরাও ক্ষুধার্ত, যদিও তাদের ক্ষুধার চেহারা-চরিত্রটা ভিন্ন প্রকারের। এখানে যে তিন ধারার শিক্ষা প্রচলিত তার কারণ হলো শ্রেণি-বিভাজন। রাষ্ট্রের যারা শাসক তারা জানে যে শিক্ষার এই বিভিন্নতার দ্বারা শ্রেণি-বিভাজনকে আরও গভীর করা যাবে; এবং শিক্ষিতরা ওই বিভাজনকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে শিখবে।

এটা পরিষ্কার যে সামাজিক বিপ্লব না ঘটলে সুখ সর্বজনীন হবে না। উদারনীতিকরা এই সর্বজনীনতায় আগ্রহী নন। উদ্যোগ নিতে হবে তাদেরই, যাদের ভেতর রয়েছে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ও সৃষ্টিশীলতা এবং যারা নিজেদের ও অন্য মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করে না, উদাসীন বা হতাশও হয় না, সচেষ্ট হয় ব্যবস্থাটাকে বদলাতে। সংঘবদ্ধভাবে।

উদারনীতিকরা শিক্ষা ও আইনের শাসনের কথা খুব করে বলেন। খেয়াল রাখেন না যে, দুটিই চলে শাসক শ্রেণির অভিপ্রায় ও নির্দেশ অনুসারে। এ যুগে বৈষম্যপূর্ণ সমাজের ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের পক্ষে প্রকাশ্যে বলার জন্য বড় দার্শনিক পাওয়া ভার, কিন্তু রয়েছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী যাদের অধিকাংশই উদারনীতিক। আর আছে মিডিয়া। সুখকে সর্বজনীন করার সমস্যাটা এখন সারা বিশ্বের। তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও তাই যেমন স্থানীয় তেমনি আন্তর্জাতিক।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শ্রম আইনে ও শ্রমিকের জীবনে মে দিবস

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪, ০৯:৫৭ এএম
শ্রম আইনে ও শ্রমিকের জীবনে মে দিবস
রাজেকুজ্জামান রতন

আজ থেকে ১৩৮ বছর আগে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ নয়, ৮ ঘণ্টা কাজ- এই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন অগাস্ট, স্পাইজ, এঞ্জেলস, ফিসার। মালিক এবং সরকার ভেবেছিল ফাঁসি দিয়ে শ্রমিক নেতাদের হত্যা করে শ্রমিকদের ভয় দেখানো এবং আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু ন্যায্য দাবিতে গড়ে ওঠা শ্রমিকদের এই আন্দোলন হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা যায়নি। বরং আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর দেশে দেশে। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ‘‌দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্যারিস কংগ্রেস’-এ প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সালের নিউইয়র্কে প্রথম মে দিবসের সমাবেশের প্রস্তাবে লেখা হয়, ‘৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবি পূরণের সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব- কিন্তু কখনো ভুলব না, আমাদের শেষ লক্ষ্য হলো (পুঁজিবাদী) মজুরিব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন’। তারপর থেকেই ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি আর সমাজবদলের সংগ্রাম একসঙ্গেই চলছে।

মানুষ প্রতিদিন যা কিছু ব্যবহার করে সব কিছুই মানুষের শ্রমে তৈরি। শ্রমিক কাজের বিনিময়ে মজুরি পায় আর মালিক শ্রমিককে কাজ করিয়ে মুনাফা অর্জন করে। কার্ল মার্ক্স হিসাব করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয় আর মালিক তা শোষণ করে। মালিকরা শ্রমিকের মজুরি যত কম দেবে এবং যত বেশি সময় কাজ করাবে, তাদের মুনাফা ততই বাড়বে। তাই ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যে লাখ লাখ শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তারা চেয়েছিল এমন মজুরি, যাতে সে মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারে, অসুখে চিকিৎসা, মাথাগোজার ঠাঁই নির্মাণ, বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে।

কারণ, ন্যায্য মজুরি না পেলে যতই পরিশ্রম করুক না কেন শ্রমিকের জীবনে স্বস্তি আসবে না। মাস শেষে মজুরি পেতে না পেতেই বাড়ি ভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করে বাকি মাস চালাতে আবার দেনা করা, এই চক্র চলতেই থাকে। যেহেতু শ্রমিককে শোষণ করেই মালিকের মুনাফা হয়, তাই শোষণমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে ন্যায্য মজুরি আদায় করা সম্ভব হয় না। মজুরি বৃদ্ধি ও জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি যেন হাত ধরাধরি করেই চলে। ফলে, ন্যায্য মজুরির আন্দোলন করতে গেলে শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবেই আর স্বপ্ন দেখতে হবে শোষণহীন সমাজের।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ৬ শতাংশের বেশি, মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ আর পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বাড়ে ৫ শতাংশ হারে। ফলে প্রতিবছর শ্রমিক মজুরি হারায়। সরকারি মাথাপিছু আয় এখন ২৭৯৫ ডলার। ১১৫ টাকা ডলার ধরলে ৫ সদস্যের একটি পরিবারে মাসিক আয় ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা হওয়ার কথা সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ, পৃথিবীর বহুদেশ বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রশংসা করছে- এসব কথা আমরা সরকারের কাছ থেকে প্রতিদিন শুনছি। কিন্তু বাংলাদেশের এই উন্নতির পেছনে প্রধান শক্তি যে শ্রমিক তারা এত কম মজুরি কেন পায় সে প্রশ্নের উত্তর কী? পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক আর মালিক-শ্রমিকের বিশাল বৈষম্যের দেশ এই বাংলাদেশ। গার্মেন্টস, নিট, সুয়েটার, রি রোলিং, পাট, চা, তাঁত, যানবাহন চালকসহ পরিবহন শ্রমিক, মোটর মেকানিক, রিকশা চালক, দোকান ও হোটেল কর্মচারী, পাদুকাসহ সব সেক্টরের শ্রমিকরা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের মতো মজুরি থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত মিলে ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেও নিজেদের দারিদ্র্য দূর করতে পারছে না, অন্যদিকে কয়েক লাখ কোটিপতির জীবনে বিলাসিতার শেষ নেই । শ্রমিকদের শোষণ করেই তাদের এই সম্পদের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা সচেতন হলে এই অন্যায় শোষণমূলক ব্যবস্থা পাল্টানোর সংগ্রাম করবেই, সে কারণে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পথে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে রেখেছে। শ্রম আইন, বিধিমালা, প্রশাসন, পুলিশ, মাস্তান, শ্রমিকনেতা নামধারী একদল দালালকে ব্যবহার করে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সংগঠিত হতে বাধা দেয়। কারণ তারা জানে, শ্রমিকরা সংখ্যায় যত বেশি হোক না কেন অসংগঠিত থাকলে তারা দুর্বল ও অসহায়।

আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অনেক বেশি উৎপাদন করা যায়, ফলে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। শ্রমিকের মজুরি এত কম দেওয়া হয় যে, আট ঘণ্টা তো বটেই, ওভারটাইম না করলে তাদের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন। ১৩৮ বছর আগে শ্রমিক দাবি করেছিল আট ঘণ্টা কর্ম দিবসের আর আজ শ্রমিক ওভার টাইম করতে চায়। এর কারণ নিহিত আছে স্বল্প মজুরির ফাঁদে। মজুরি কম বলে অতিরিক্ত খাটতে হয়, অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বলে সে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায় না আর দক্ষতা কম বলে তার মজুরি কম। এ এক দুষ্ট চক্রে আটকা পড়েছে শ্রমিক।

শ্রম আইন শ্রমিকের জন্য অধিকারের সুরক্ষার পরিবর্তে অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইনি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম শক্তির ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। এরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তাদের ক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা, মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও আর্থিক সহায়তা কোনো কিছুই নেই। শ্রম আইনে আছে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না। এই আইনের প্রয়োগ সেখানে নেই। ফলে এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক শ্রম আইনের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক যাদের সংখ্যা ১ কোটি তারাও আইনের বেড়াজালে আটকে আছে।

শ্রম আইনের ১০০ ধারায় উল্লেখ আছে কর্ম সময় হবে ৮ ঘণ্টা কিন্তু ১০৮ ধারার বিধান সাপেক্ষে ১০ ঘণ্টাও কাজ করানো যাবে। শ্রম আইনের ২৩ ধারা ব্যবহার করে অসদাচরণের অজুহাতে বিনা নোটিসে, বিনা মজুরিতে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। শ্রম আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী যেকোনো স্থায়ী শ্রমিককে কর্মচ্যুত করা যাবে। আবার ১৮০ ধারায় আছে শ্রমিক হিসেবে নিয়জিত বা কর্মরত না থাকলে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হওয়া যাবে না। শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা। আর চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করলে ক্ষতিপূরণ মাত্র আড়াই লাখ টাকা।

ফলে সংসারের দায় পালন করতে এসে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে শেষে সংসারের বোঝা হয়ে যাচ্ছে শ্রমিক। ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার এবং হাতিয়ার। বিচ্ছিন্ন বিভক্ত লাখ লাখ শ্রমিক অসহায়ের মতো নিপীড়ন সহ্য করে যদি তারা সংগঠিত না থাকে। বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশন ৮৭ এবং ৯৮ অনুস্বাক্ষর করেছে ১৯৭২ সালে। সে অনুযায়ী সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং দরকষাকষি করার অধিকার পাওয়ার কথা। এই অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানেও স্বীকৃত। কিন্তু এখনো শ্রম আইন সংবিধান ও আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী প্রণীত হয় নেই। সে কারণে ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে মাত্র ৩২ লাখ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য আর প্রায় ২ লাখ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন আছে। ফলে সদস্য সংখ্যা এবং ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা কোনোটাই ৫ শতাংশের বেশি নয়। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের এবং মালিকদের নিয়ন্ত্রিত ট্রেড ইউনিয়ন থাকায় তা শ্রমিক স্বার্থে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

কিন্তু মে দিবস এই শিক্ষা দেয়- শ্রমিকের দাবি যতই ন্যায্য হোক না কেন, লড়াই করা ছাড়া তা আদায় করা যায় না এবং অর্জিত অধিকার রক্ষাও করা যায় না। মালিক এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছে দয়া বা করুণা চেয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, ন্যায্যমজুরি আর ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করতে হলে সচেতন ও সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)

ঢাকাকে একটি মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৪ এএম
ঢাকাকে একটি মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে
নজরুল ইসলাম

বর্তমান সময়ে মহানগরী ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা শহর আজ নানান রকম দূষণের শিকার। বাতাসদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্য পরিষ্কার না হওয়ার দূষণ, দৃশ্যদূষণ ইত্যাদি বহুবিধ দূষণে দূষিত ঢাকা। তবে এই মুহূর্তে বাতাসদূষণই সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। ঢাকায় যেসব কল-কারখানা আছে, তাতে বাতাসদূষণ বেশি হচ্ছে না, দূষণ বেশি হচ্ছে যান্ত্রিক যানবাহন থেকে ও ঢাকার চারপাশে ঘিরে থাকা অসংখ্য ইটভাটা থেকে। উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না। বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে বর্জ্য অপসারণের কাজও সময়মতো ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে করতে হবে। ঢাকা শহরের নাগরিকদের সমস্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা ব্যাপক।

ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি খুব ভালো। কিন্তু সেই পানি ভোক্তার কাছে যেতে যে পাইপলাইন ব্যবহার করা হয়, নানা কারণে সেটি সব সময় পরিচ্ছন্ন থাকে না। অন্যদিকে ঢাকার ভূ-উপরিভাগের পানিতে সমস্যা আছে। আদি উৎস বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহারযোগ্য নয়। অন্য নদীগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। তাছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা সেভাবে নেই। বর্তমানের ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসের পরিবর্তে অবশ্যই ভূ-উপরিস্থিত পানির উৎসের কথা ভাবতেই হবে। ঢাকা ওয়াসা সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওয়াসাকে অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা যে শহরটিতে আছি, সেখানে নাগরিক সুবিধা কতটা মানসম্মত, শহরটি জীবন্ত কি না।

তবে আমি বলব নানা সমস্যা সত্ত্বেও ঢাকা শহর এখনো জীবন্ত। যানজট মোকাবিলা করতে পারলে নাগরিক জীবন অনেকটা স্বস্তিদায়ক হতো। এখন যে মেট্রোরেল হয়েছে, সেটি হওয়ার কথা ছিল কয়েক বছর আগেই। আমরা পরিকল্পনা নিই, কিন্তু সময়মতো জরুরি কাজগুলো হয় না। এ কারণেই নাগরিক ভোগান্তি বেড়েছে। নগর উন্নয়নে যেসব সেবা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোতে যোগ্য ও সৎ লোকের প্রচণ্ড অভাব। আমাদের প্রশাসনের সমস্যা দ্বিমুখী। একদিকে জনগণকে সেবা দেওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগ্যতা ও দক্ষতা কমেছে, অন্যদিকে দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে অর্থাৎ মোদ্দা কথা, সুশাসনের প্রচণ্ড ঘাটতি আছে।

আমরা যদি একটি শহরকে আধুনিক ও বসবাস উপযোগী করতে চাই, তাহলে তার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা খেয়াল করতে হবে। শহরের অর্থনৈতিক শক্তি, জনজীবনে গতিশীলতা, নাগরিকদের নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ও মানবিকতা, টেকসই পরিবেশ, সাংস্কৃতিক শক্তি ও দৃশ্যমান নান্দনিকতা এ রকম কিছু বৈশিষ্ট্য বা সূচক বিবেচ্য। একটি আধুনিক শহরে পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ব্যবস্থা যথাযথভাবে থাকতেই হবে। ঢাকায় এখন অন্যান্য বিষয় মোটামুটি থাকলেও যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ফলে গতিশীলতার দিক থেকে শহরটি অনেক পিছিয়ে আছে। প্রচণ্ড হয়রানির মধ্যেই আছে ঢাকার নাগরিকরা। পরিবেশ-পরিস্থিতিও সমস্যা-সংকুল।

ঢাকার জন্য একটি উপযুক্ত পরিচালন ব্যবস্থা ও যথাযথ বিশ্বাসযোগ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জবাবদিহি থাকলে এ রকম পরিস্থিতি হতো না।
অবশ্যই জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের প্রথম কয়েকটি শহরের একটি। তবে ঢাকা শহরের চেয়েও বেশি মানুষ বাস করে এমন অনেক শহর আছে পৃথিবীতে। তা সত্ত্বেও সেখানে সবকিছু নিয়মমাফিক চলে। আমরা নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, ঢাকা শহরে এখনো প্রতিবছর প্রায় কয়েক শতাংশ হারে মানুষ বাড়ছে। অচিরেই এই বৃদ্ধির হার শূন্যে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ ঢাকা শহরে আর মানুষ বাড়তে দেওয়া যাবে না। এর জন্য বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে ঢাকা শহরের চারপাশে স্যাটেলাইট টাউন বা উপশহর গড়ে তোলার কথা আছে।

সেটি বাস্তবায়ন করতে পারলে চাপ অনেকটা কমবে। তবে এ ধরনের উপশহরে কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে হবে। আরও ব্যাপক অর্থে দেশব্যাপী সত্যিকারের বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কী প্রকারের হবে, তা বিবেচনার বিষয়। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের প্রস্তাবিত মেয়াদ ২০১৬-২০৩৫। কিন্তু মূল প্ল্যানের অনুমোদনের কাজটি এখনো সম্পন্ন হয়নি, সে ক্ষেত্রে এর সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন, অগ্রগতি প্রশ্নসাপেক্ষ। পাশাপাশি অনুমোদিত হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি। এই প্ল্যানের অধীনে পরিবহন খাতে কিছু মেগা-প্রকল্প চলমান রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত মেট্রোরেল প্রকল্প ও বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প। তা ছাড়া রয়েছে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান। যদি এসটিপি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে রাজধানী ঢাকার বসবাসযোগ্যতা বাড়বে। তবে এ কাজটি সময়সাপেক্ষ ও অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ।

রাজউকের দায়িত্ব হলো বৃহত্তর ঢাকার নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা করা এবং তার বাস্তবায়ন। এ ছাড়া তার দায়িত্ব হলো নানা সংস্থা ও ব্যক্তি খাতে সম্পাদিত নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তদারকি বা মনিটরিং করা। ব্যবসা করা তাদের কাজ নয়। দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন হলে মানুষ আপত্তি করত না। কিন্তু রাজউকের কাজকর্মে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ আছে। এই যে নকশাবহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, রাজউকের একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশ ছাড়া সেটি সম্ভব হতো না। আসল কথা সেবা প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে। ঢাকা শহরকে হতে হবে নাগরিকবান্ধব, মানবিক। কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, এসডিজির এমন অঙ্গীকার মনে রাখা উচিত। রাজধানী শহর পরিচালনার ভার যাদের ওপর, তারা এটিকে মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন না কিংবা পারছেন না কেন সেটি নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরবিদ