![ভারতের লোকসভা নির্বাচন: নানা হিসাব-নিকাশ](uploads/2024/02/10/1707540491.shukoronjon.jpg)
গত বছর বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনে লড়াই করার জন্য ২৬টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোট গঠন করেছিল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তখনই কংগ্রেসকে সতর্ক করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গেও সমঝোতা করা যায়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশ্বাস করা যায় না। মমতা নিজেই ঘোষণা করেছেন, তিনি জোটে আর থাকছেন না। তিনি একাই লড়বেন। তার এই সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক মহ. সেলিম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মমতা তো বিজেপি-আরএসএস থেকে কোনো দিন বের হতে পারবেন না। তাদের কাছে তার দায়বদ্ধতা বেশি। মমতার গোঁমা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, ভারতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় কোথাও রাহুল গান্ধীর যাত্রাকে বাধা দেওয়া হয়নি। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই তাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল নেত্রী পাল্টা আক্রমণ করে বলেছেন, রাহুল হলো বসন্তের কোকিল। এই বিতর্কের মধ্যে রাহুল পশ্চিমবঙ্গ ছাড়ার আগে মন্তব্য করেছেন, বাংলার মানুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তাতে আমি আপ্লুত। নির্বাচন এলে বিভিন্ন দল বদল হয়। এবারও তা থেকে পিছিয়ে থাকছে না গোটা দেশ।
গত শুক্রবার একটি ইংরেজি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে ভারতের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোর মন্তব্য করেছেন, রামমন্দিরে বিজেপি আরএসএস-এর খুব একটা লাভ হবে না। এবার দেখা যাক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। ২০২৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচন যেকোনো সময় ঘোষণা হতে পারে। কারণ নিয়ম অনুযায়ী সংসদের শেষ অধিবেশন হয়ে গেছে। সম্ভবত এ মাসের মধ্যেই লোকসভা ভোটে নির্ঘণ্ট ঘোষিত হয়ে যাবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো পুরোদমে একে অন্যের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিয়েছে। তারা যে ভাষা একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে তা সংবাদপত্রে লেখা যায় না, টেলিভিশনে দেখানো যায় না। যত দিন যাচ্ছে তাদের এই প্রবণতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে যথাসম্ভব বেশি বেশি করে। আশা ছিল এবারে হয়তো কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলকে বিরোধীরা একটা উচিতশিক্ষা দিলেও দিতে পারবে। গত বছরের আগস্টে ২৬টি অবিজেপি দলকে নিয়ে ইন্ডিয়া জোট নামে একটি জোট গঠিত হয়েছে এবং সেই জোটে যোগ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনই দেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষ, যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতীত জানেন, তারা এই জোটের বিষয়ে কিছুটা হলেও সন্দিহান হয়ে পড়েন। কারণ তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপির সহযোগী হয়ে পড়েন। তিনি অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি সরকারে যোগ দেন। তারপর থেকেই তার সঙ্গে বিজেপির সখ্য। তিনি মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, অথচ একই সঙ্গে তাকে বিজেপির বন্ধু হিসেবেও দেখা যায়, যারা ধর্মনিপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আস্থা রাখে না, গণতন্ত্রে যাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
আসলে তিনি কী- এ নিয়ে রাজনীতি-সচেতন মানুষের মধ্যে একটা প্রশ্ন তখন থেকেই উঠেছে, যখন তিনি বিজেপির পরিচালনায় সরকারে অবধি গিয়েছিলেন। অনেকেই অবশ্য তারপরও আশা করেছিলেন যে দিনে দিনে হয়তো মমতার শিক্ষা হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হয়নি। ১৯৯৯ সালে তিনি দিল্লিতে আরএসএসের অফিস উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন যে, আরএসএস একটি দক্ষ নীতি ও নিয়মনিষ্ঠ দল। তারা নিয়ম মেনে চলে। সেই থেকেই তার সঙ্গে বিজেপি ও আরএসএসের ঘনিষ্ঠতা। তিনি কীভাবে বিজেপি তথা আরএসএসের কাছাকাছি মানুষ হলেন, আসুন সেই ইতিহাস একটু দেখা যাক। ১৯৯৭ সালে বিজেপির কাছাকাছি আসার একদম গোড়ার পর্বে তার সঙ্গে একটি দীর্ঘ বৈঠক হয় বিজেপির তৎকালীন বলিষ্ঠ নেতা, পরবর্তীকালে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার স্বয়ং লালকৃষ্ণ আদভানির। আদভানির সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেন দিল্লির একজন বাঙালি সাংবাদিক। স্বভাবতই এই পর্বের পরে তার সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ৯৭, ৯৮ ও ৯৯ সালের তিনটি নির্বাচনে বিজেপির তিনি সহযোগী ছিলেন এবং পুরস্কারস্বরূপ তিনি এনডিএর মন্ত্রী পদে আসীন হন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আসলে কী চান, তা সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন না। যেমন জানেন না ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি নিজেও গত ১০ বছরে যখন যেভাবে পেরেছেন ভারতের মানুষকে কেবল চমকে দিতেই চেয়েছেন। প্রতিটি পদক্ষেপেই তিনি যা যা বলে প্রধানমন্ত্রিত্বের জায়গায় পৌঁছেছিলেন তাকে এড়িয়ে গেছেন। মানুষের রুটি-রুজি নিয়ে তার বা তার দলের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তার সরকারের গত দুটি পর্বেই তিনি ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে এসে সব কথা বলেছেন, কেবল নিজের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও বলেননি। সেসব কথা সম্ভবত তার মনেও পড়েনি। না পড়াই স্বাভাবিক, কারণ সেসব যে স্রেফ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি মাত্র, যা রক্ষা করা, না করায় কিছু যায় আসে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে, তাদের একমাত্র রক্ষা করতে, নিরাপত্তা দিতে পারেন কেবল তিনিই, সিপিআইএম বা কংগ্রেস পারে না। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার কাজটাই কেবল করে চলেছেন। সম্প্রতিকালে দেখা যাচ্ছে, মমতা এবং তার দল প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে অর্থ বিলি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। কেন এই অর্থ বিলি করা হচ্ছে, এ নিয়ে সিপিআইএম নেতা মহম্মদ সেলিম একটি স্পষ্ট অভিযোগ তুলেছেন। তার বক্তব্য, মমতা এই টাকা বিলি করছেন ভোট কেনার জন্য। তিনি নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে গত এক বছরে অনেক দূর এগিয়েও গেছেন। বাংলাদেশের সরকারের তার ঘনিষ্ঠতা নেই বটে, তবে জামায়াতের সঙ্গে তার দলের আছে। জামায়াতের সঙ্গে তার দলের এই যোগাযোগের পেছনে আছেন সেই সব ব্যক্তি, যারা একদা তসলিমা নাসরিনকে দেশছাড়া করতে এবং তাকে হত্যা করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তার দল। বুদ্ধবাবু তখন রাজ্যকে সেই আশু বিপদ ও সেই সঙ্গে দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন সামরিক বাহিনী নামিয়ে।
তিনটি কর্মসূচি নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বে যিনি মাথায় ছিলেন, যিনি দল ও সরকার পরিচালনার নেপথ্যে ছিলেন, সেই লালকৃষ্ণ আদভানি, তার বয়স এখন ৯১ বছর। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপির মূলনীতি হবে তিনটি: অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানে সারা দেশে সব সম্প্রদায়ের জন্য একই আইন প্রযোজ্য হওয়া এবং সংসদের বর্তমান অধিবেশনে না হলেও কেন্দ্ৰীয় সরকার সম্ভবত আগামী অধিবেশনে এই আইন বিল করে পাস করিয়ে নেবে। এটা তাদের দায়। এ কাজ তারা করবেই। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রামমূর্তি উদ্বোধনের পর সংসদে দেশের সংবিধানের রক্ষক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদের দরজায় দাঁড়িয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলেছেন এবং বাকি বিজেপি সদস্যরাও তাকে অনুসরণ করে ওই ধ্বনি তুলেছেন। এটা কখনো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কল্পনা করতে পারেন না। বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য গত বছর আগস্টে ভারতের ২৬টি অবিজেপি রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়া জোট গঠন করেছিল।
এই জোটে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছেন। স্বভাবতই এটা তার কাছে বিব্রতকর অবস্থা। এই জোট যদি কার্যকর হয় তাহলেই সেটা বিজেপির পক্ষে ভালো হবে না। একই সঙ্গে সেটা মমতার পক্ষেও মন্দই হবে। অন্তত রাজ্যে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যা অবস্থা। তখনই আন্দাজ করেছিলাম মমতার পক্ষে বিজেপি-বিরোধিতা খুব একটা সম্ভব নয়। কারণ, তার এ ক্ষেত্রে অনেক পিছুটান আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যেদিন রামমন্দির উদ্বোধন হলো, তারপরের দিন সকালেই কলকাতায় আরএসএসের কেশব ভবনে গিয়ে বৈঠক করে এসেছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী। কীভাবে সে আদর্শ রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কর্মসূচি না নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম প্রধান জোট-শরিক কংগ্রেসকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করেছেন। এই লেখা যখন লিখছি তখনো এই গালাগাল পর্ব চলছে। গত শুক্রবার যখন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তার ন্যায়যাত্রা নিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করেন, তখন শুধু গালাগাল নয়, মমতার মুক্ত দল তার গাড়ির কাচও ভেঙে দিয়েছে। কেন এই আক্রমণ? না রাহুলের কংগ্রেস সিপিআইএমের সঙ্গে জোটে আছে এবং থাকবে। আসলে বিজেপি যেমন কংগ্রেসমুক্ত দেশ গড়তে চায়, মমতাও চান কংগ্রেস ও সিপিআইএমমুক্ত রাজ্য। এটাই মরিয়া হয়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র এজেন্ডা।
জানি না এ ব্যাপারে তিনি কতটা সফল হতে পারবেন। এর উত্তর ভবিষ্যৎই দিতে পারবে।
নির্বাচনের আগে আরএসএস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কায়দায় কাজ করছেন, আমরা জানি না তার পরিণাম কী হতে চলেছে। আরএসএস যে কায়দায় কংগ্রেসমুক্ত ভারত চায়, মমতাও তাই চাইছেন। অথচ তিনি ভুলে যাচ্ছেন রাজ্যে তিনি যে ক্ষমতায় এসেছেন সেটাও তার দলের একার ক্ষমতায় নয়। সেখানেও তাকে কংগ্রেসের হাতই ধরতে হয়েছিল। এই অকৃতজ্ঞতাই মমতা এবং তার দলের অবলম্বন।
আসলে মমতার উত্থানের পেছনে হাত ছিল প্রধানত বিজেপি তথা আরএসএসের এবং আমেরিকার তরফে সিআইএর। সিআইএর সাউথ এশিয়ার এই অঞ্চলে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি হলেন ন্যান্সি পাওয়েল। তিনি এ ব্যাপারে ব্যাপক সাহায্য করেন। মমতার আসল দায়বদ্ধতা তাই আরএসএস তথা বিজেপির কাছে। তিনি চান দিল্লিতে বিজেপি থাকুক আর রাজ্যে তিনি এবং তার দলবল। এ জন্য কংগ্রেসের সব রকম বিরোধিতা তাকে করতেই হবে। অনেক প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন ভোটাররা। কীভাবে দেবেন, কোন চেহারায় দেবেন, সেটা অদূর ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক