সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ২০২৪ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের সময় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।
এদিকে পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) নওয়াজ শরিফ দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে ১ লাখ টাকারও (৩৬০ ইউএস ডলার) বেশি মূল্যের একটি গুচি ক্যাপ পরে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিও ২০১৮ সাল থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন।
রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চের বাইরে ২০২৪ সালের পাকিস্তান নির্বাচন চাপা আর্থিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বছরে ২৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ বিল অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি পায় পাকিস্তানে। এ কারণে অর্থনৈতিক উদ্বেগের বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ নেতা পাকিস্তানের নির্বাচনের প্রচারে নেমে পড়েন।
পিএমএল-এন দেশের বার্ষিক রপ্তানি বাড়ানো, সৌদি আরবের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তেল শোধনাগার চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) অধীনে প্রকল্পগুলো চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একই সঙ্গে পিপিপির লক্ষ্য মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করা এবং সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোকে বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি, বৈশ্বিক সরবরাহ-শৃঙ্খলে বাধা এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিশেষ করে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘর্ষসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
এসব কারণে পাকিস্তানে ক্রয়ক্ষমতা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, নাগরিক অস্থিরতা বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য পতনের ফলে দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে রিজার্ভ ৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ইউএস ডলারে নেমেছে, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রস্তাবিত তিন মাসের ন্যূনতম সীমার নিচেও নেমে গেছে।
২০২৫ সালের মধ্যে ৭৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করা দুঃসাধ্য কাজ, যার মধ্যে চীন ও সৌদি আরবের উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তান অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
পাকিস্তানি রুপির নাটকীয় অবমূল্যায়ন বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে বিশ্বের সেরা পারফরম্যান্সকারী মুদ্রা থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। পাকিস্তানি মুদ্রার অবমূল্যায়নের সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে, যা জ্বালানি, ভোজ্যতেল ও ডালের মতো প্রয়োজনীয় আমদানিকে প্রভাবিত করে।
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) পাকিস্তানকে খারাপ তালিকায় উল্লেখ করে, যা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ২০০৮ সাল থেকে আনুমানিক জিডিপি ক্ষতি ৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে তালিকা থেকে দেশটিকে বাদ দেওয়ায় কিছুটা স্বস্তি আসে। তার পর থেকে পাকিস্তান শক্তিশালী অ্যান্টি মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।
পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণও জটিল, যা চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ককেও প্রতিফলিত করে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির প্রায় ৩৩ শতাংশ। এটি বহুপক্ষীয়, প্যারিস ক্লাব, ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক ঋণের মিশ্রণ; যার ৩০ শতাংশের বেশি চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ এবং উচ্চসুদের হারের কারণে পাকিস্তানের ঋণ পরিশোধে অনেক ঝুঁকি বহন করতে হবে।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর, যাকে ২০১৫ সালে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে রূপান্তরকারী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটে এটি বড় মূল কারণ হয়ে উঠেছে। সিপিইসির অর্থনৈতিক জটিলতা, ঋণ পরিশোধের পুনর্গঠন করতে চীনের অনিচ্ছার সঙ্গে আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপ সৃষ্টি করেছে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা স্বল্পমেয়াদি আর্থিক সহায়তা প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন। বিগত ৬০ বছরে ২২টি আর্থিক ত্রাণ পাকিস্তান ও আইএমএফের মধ্যে সম্পর্ক আরও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে।
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনে সব দলের নেতারাই অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেন। তবে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এবারের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকের সন্দেহ। মিডিয়ার প্রভাব, আইন প্রয়োগকারীদের হামলা, নির্বাচনের ফলাফলের হেরফের নিয়ে উদ্বেগের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন-পরবর্তী দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তানের ৩৪০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঋণ পরিচালনা করে নাগরিকদের ওপর মুদ্রাস্ফীতির বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষ করে দুর্বল জনসংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব সহ্য করে যাচ্ছে। আগত সরকার নতুন আইএমএফ কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ব্যয় হ্রাস এবং ঘাটতি পরিচালনার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
পাকিস্তানের নির্বাচন-পরবর্তী এই মন্থর অর্থনীতিতে দেশকে গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত। নতুন সরকারকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় জলবায়ু প্রশমন এবং অভিযোজন কৌশলগুলোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানে নতুন সরকারকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। পাকিস্তানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য গোটা জাতির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন অপরিহার্য। দেশের রাজনীতি থেকে অর্থনৈতিক শাসনকে দ্বিগুণ করা, প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এগিয়ে আসতে হবে নবাগত সরকারকে।
লেখক: সহযোগী ফেলো, সেন্টার ফর নিউ ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি, ভারত
এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল