![নিত্যপণ্যের বাজারে সার্বক্ষণিক চাপে অতিষ্ঠ মানুষ](uploads/2024/02/12/1707713415.Golam-Rahman.jpg)
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন একটি সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাদের সামনে নির্বাচন-পরবর্তী বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত বছরগুলোয় মূল্যস্ফীতির ফলে দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সেটাকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম চলছে তা বন্ধ করা নতুন সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে।
যেহেতু আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর, তাই আমাদের অবশ্যই রিজার্ভ বাড়াতে জোর দিতে হবে। বর্তমানে আমরা আমদানি সংকুচিত করে রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তবে এটা কতটা যুক্তিসংগত সেটাও ভেবে দেখা দরকার। দেশে যদি আমদানি কমে যায় তাহলে উৎপাদনও কমবে। পণ্য উৎপাদনের জন্য যে কাঁচামাল প্রয়োজন সেটা যদি আমরা আমদানি করতে না পারি, তাহলে দেশে উৎপাদন ঘাটতি দেখা দেবে।
ফলে রপ্তানিতেও এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কাজেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি যতক্ষণ পর্যন্ত স্থিতিশীল না হচ্ছে, ততক্ষণ নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এই চাপ বিদ্যমান থাকবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়িয়ে কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য খরচ কাটছাঁট করছে। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারছে না। ১ কোটি মানুষকে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেকেই এই কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার। সে ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা যতক্ষণ না আসবে, ততক্ষণ এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে।
কর্মসংস্থান করে আমরা মানুষের আয়-রোজগার বাড়াতে পারছি না। আয় বাড়াতে পারলে দাম বাড়লেও সমস্যা হয় না। স্বাধীনতার পর চালের যে দাম ছিল, সেই তুলনায় এখন দাম অনেক বেশি। তার পরও মানুষ কিনতে পারে। কারণ মানুষের আয় সেই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। আয়বর্ধক কর্মসূচি না থাকায় মানুষের ওপর চাপ পড়ছে। এর সঙ্গে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব ও বাজার কারসাজি। বর্তমান সময়ে মানুষ কষ্টে আছে।
যেহেতু সংগতি নেই, তাই কম খেয়ে, কম পরে জীবন কাটাতে হচ্ছে। আয়-রোজগার বাড়লে এবং পণ্যমূল্য কমলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতো। সরকার নানাভাবে সে জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই পদক্ষেপগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণে কতটুকু সহায়ক হচ্ছে, তা ভোক্তারাই জানেন। সরকার ১ কোটি মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য দিচ্ছে। তার পরও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে একচেটিয়া গোষ্ঠী সাপ্লাই চেইন নষ্ট করছে। বাজারব্যবস্থায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া এবং সেটির বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত কাঠামো না থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই তা কোনো কাজে আসে না। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত বাজার তদারকি এবং নির্ধারণ করা মূল্যে সেটি বিক্রি হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কাঠামো দরকার। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মনিটরিং কাঠামোটি শক্তিশালী নয়। সে কারণে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে যে প্রত্যাশা করা হয়, সেটি পূরণ হয় না। তাদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা দরকার। আলু বিক্রি করতে গেলে আলুর ট্রেড লাইসেন্স, পেঁয়াজ বিক্রি করতে হলে পেঁয়াজের ট্রেড লাইসেন্স, মরিচ বিক্রি করতে হলে মরিচের ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হবে।
লাইসেন্সধারীরা বাজারে যে ব্যবসায়িক লেনদেন করবেন, তা ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা উচিত। একই সঙ্গে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না, বাজার কমিটিগুলোকেও তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাদেরও এক ধরনের দায়িত্ব রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আইনি কোনো দুর্বলতা আছে কি না, সেগুলো দেখে প্রয়োজন হলে সংশোধন করা দরকার। বাজারে বড় ধরনের কোনো অযাচিত প্রভাব আছে কি না, সেটিও দেখা দরকার। বেশি বিক্রেতা যেন একটি বাজারে থাকেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এককভাবে কারও ওপর যেন নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে সেটি দেখতে হবে।
মানুষ অসহায় হয়ে দৈনন্দিন খাওয়া কমাচ্ছে। কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার লড়াই করছে তারা। পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। ওষুধের দাম বেড়েছে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। দাম বাড়ায় অনেকে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। বছরখানেক বা বেশি সময় হলো দামটা অবিরাম বাড়ছে। বাজারের চাপটা সার্বক্ষণিক চাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সামনে রোজা আসছে। এ কারণে চাপটা আরও বেশি মনে হচ্ছে। বাজারের এহেন অবস্থা দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ নেই।
বাজার একচেটিয়া গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। ডিম, পেঁয়াজ, আলু, চালসহ সব পণ্যেরই উৎসে তারা সক্রিয়। এটা তারা করতে পারে। কারণ তারা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব হয়। পণ্য পরিবহন থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত মাঝখানে চলে চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজি যারা করে তারা ক্ষমতাশালী। তাদের নেটওয়ার্ক অনেক ওপরে। চাঁদার ভাগীদারও ইদানীং বেড়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ এটা অনিয়ন্ত্রিত। এসব থামানোর লোক নেই। লোভেরও শেষ নেই। কিন্তু সরকার সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে না, যে কারণে সাধারণ মানুষকে এর মাশুল গুনতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তাদের দুর্ভোগ লাঘবে চেষ্টা থাকতে হবে। বিশেষ করে রমজান সন্নিকটে।
ব্যক্তিপর্যায়ে যেমন প্রচেষ্টা চালাতে হবে, সরকারি পর্যায়ে, জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে করে মানুষের আয়-রোজগার বাড়ে। মানুষের আয় বৃদ্ধি যাতে ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয় সেটিও ভেবে দেখা দরকার। মূল্যস্ফীতির দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাটাই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)