![ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকা](uploads/2024/04/08/1712553939.Sultan-Mahmud-RAna.jpg)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতিবিহীন রাখতে এখনো অনড় অবস্থানে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছেন তারা। যাতে প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির বাইরে রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে। অবশ্য অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে এ বিষয়ে। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক পক্ষ বলছে, এই মুহূর্তে দেশে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নেই। আরেক পক্ষ যুক্তি দিচ্ছে ছাত্ররাজনীতির অপরিহার্যতা নিয়ে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ছাত্ররাজনীতির ন্যায্যতা নিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। তাদের অসংখ্য যুক্তি গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি না থাকার বিষয়ে যে মতামত দিচ্ছে সেগুলোরও বেশ কিছু গ্রহণযোগ্য।
ইতিহাসের পাতায় ছাত্ররাজনীতি হলো বড় বড় রাজনৈতিক নেতা তৈরির সূতিকাগার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, পরবর্তীকালের তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গড়ে উঠেছেন। কিন্তু বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি কি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতা তৈরি করতে পারছে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে অনেক মতদ্বৈধতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ এ বিষয়ে একমত হওয়া কঠিন হবে।
ক্ষমতার আধিপত্য, বড়াই-লড়াই, হল দখল, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাটুকারিতা, পকেট নেতা তৈরি, প্রশাসনের অন্যায্য সমর্থন প্রভৃতি কারণে ছাত্ররাজনীতির যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না। ইদানীং গণমাধ্যমে প্রায়ই সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কতিপয় নেতা-কর্মীর নামে অন্যায়-অপকর্মের খবর পাই। পরক্ষণেই আবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্তৃক সংশ্লিষ্টদের বহিষ্কারসহ নানাবিধ শাস্তিমূলক আয়োজন দেখে অভীভূত হই। মনটা ভরে যায়। মনে হয় আবার যেন ছাত্ররাজনীতি তার পুরোনো রূপ ফিরে পাচ্ছে।
একসময়ে দেখেছি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ভয়াবহ তাণ্ডব এবং বাড়াবাড়ি। শিবিরের ইয়ানতের নামে চলেছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইয়ানত (চাঁদা) দিতে বাধ্য করা হতো। কোনো শিক্ষার্থী সেটি দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে কথিত টর্চার সেলে নিয়ে টর্চার করা হতো। এখন ওই সব ইতিহাস পেছনে পড়ে গেছে। কারণ বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। আর এখন যারা ছাত্র তাদের বয়স বিবেচনা করলে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, তারা সেই ইতিহাস দেখেননি। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই বর্তমানের প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, সেটি স্বাভাবিক। বিগত সময়ের ঘটনা শুধুই ইতিহাস। যারা সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী নয় তারা এর ভয়াবহতা অনুমান করতে পারবে না।
এখনো কতিপয় ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বিতর্ক তৈরি করেছে। অনেকেই ক্ষমতার দাপটে অপকর্মে লিপ্ত হয়ে নিজেদের প্রিয় সংগঠনকে কলুষিত করে ফেলছে। প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি, ছাত্রলীগের অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নির্বাচিত কিংবা মনোনীত হচ্ছে, যাদের পারিবারিক প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না। বরং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠনের সক্রিয়দের পারিবারিক উত্তরসূরিরা ছাত্রলীগের পদ ধারণ করছে। আর এতে সহযোগিতা করছেন আওয়ামী লীগের অনেক হাইব্রিড নেতা। এ কারণে গণমাধ্যমের বদৌলতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বিব্রত হয়েছেন অনেক নেতা।
আমার প্রায় দেড় দশকের শিক্ষকতা জীবনে বেশ কিছু সাধারণ শিক্ষার্থীর নির্যাতন কিংবা অসহায়ত্বের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছি। বড় বড় রাজনৈতিক ইস্যুর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী কর্তৃক এমন ঘটনা সামাল দিতেই অনেক সময় সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। বর্তমান সরকারের শুরু থেকে ছাত্রলীগের বহু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিব্রত হয়েছেন।
প্রায়ই শুনে থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাধারণ ছাত্র নির্যাতন, অতঃপর হুমকি-ধমকি ও হল থেকে বিতাড়নের ঘটনা। অভিযোগ শুনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শঙ্কিত হই। লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে যে বঙ্গবন্ধু তো এমন রাজনৈতিক আদর্শকে প্রশ্রয় দেননি, কখনো শেখাননি। তাহলে কেন এগুলো ঘটছে? ধরে নিতে পারি যে, যারা এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নয়। শুধু ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নয় এমন নেতিবাচক প্রশ্রয় ওপরতলার রাজনীতিতেও আছে। আর এ কারণে বলা যায় ছাত্ররাজনীতির বর্তমান দশার জন্য শুধু ছাত্ররাই দায়ী নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতি থেকে আগাছা উপড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন বারবার। দেশের মূল রাজনীতি, এক কথায় বড় রাজনৈতিক দলগুলো আগাছামুক্ত না হলে তাদের লেজুড়বৃত্তি করছে যে ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের আগাছামুক্ত করা যাবে না। দলের কমিটি গঠন ও শাখা গঠনের জন্য এখন যোগ্যতার পাশাপাশি চলে লাখ লাখ টাকার রাজনৈতিক বাণিজ্য। এই অপরাজনীতির দাপটে ক্রমেই ছাত্ররাজনীতি হয়ে উঠছে অসৎ ও অশুভ। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ছাত্রদের ওপর।
আমি বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি, অনেক ছাত্রই বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন, শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন। আর এই পছন্দ থেকেই একজন সাধারণ ছাত্র তার পরিবারকে যথাযথ আদর্শের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। সব শিক্ষার্থীই যে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে থাকবে, আবার সবাই যে মিছিল-মিটিংয়ে যাবে এমনটি কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয় তখন এর প্রভাব কেমন হতে কিংবা কতদূর পৌঁছাতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
ইদানীং যারা ছাত্ররাজনীতি করে তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কোনো আদর্শ ধারণ করে করে না। মূল বিষয় হচ্ছে হলে থাকা, রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সুবিধা আদায় করা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকেই ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণে ক্ষমতার রদবদল হলে এদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং রং বদলে মিশে যায় অন্য দলে। এত কিছুর পরেও বিশ্বাস করি, ছাত্ররাই পারে অপার শক্তি ও সাহস নিয়ে জাতির পাশে দাঁড়াতে, ছাত্রদের ওপরই সেই আস্থা রাখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইতিহাসের প্রত্যেকটি সফলতায় ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এমনও শিক্ষার্থী আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনীতি করে নিজের জীবন বলি দিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছে। আবার অনেকেই ছাত্রত্বকে বলি দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে। দেশের ছাত্ররাজনীতি যদি কলুষমুক্ত না হয়, আগাছামুক্ত না হয়, তাহলে জীবন বলিদান ও ছাত্রত্ব বলিদানের ঘটনা অনবরত ঘটতেই থাকবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]