ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৫ এএম
আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৫ এএম
মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়
তোফায়েল আহমেদ

প্রতিবছর জাতীয় জীবনে ‘মুজিবনগর দিবস’ ফিরে আসে এবং এ বছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের ৫৩তম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে কত কথা আমার মানসপটে ভাসছে। ২৫ মার্চ দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় নিই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।’ 

২৫ মার্চ রাতে আমরা ছিলাম মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে। রাত ১২টায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি। এক রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরও আগেই গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি।’ ‘দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিশড।’ 

তারপর কারফিউ জারি হয় এবং ২৬ মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র কথা বারবার প্রচার করে বলছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সেনাকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ 

এরপর দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব; মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী সাহেব এবং কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব। আমাদের এই যাত্রাপথ আগেই ঠিক করা ছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে নির্বাচিত এমসিএ (Member of Constituent Assembly) ডাক্তার আবু হেনাকে বঙ্গবন্ধু যে পথে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন, সেই পথেই আবু হেনা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। 

ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টালবাহানা শুরু করে, তখন ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে জাতির পিতা জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানে  তোমরা থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ এপ্রিল আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নিই। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘Proclamation of Independence’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও যা ঘোষিত হয় তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ 

রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় ‘ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’, ‘একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করিলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের’ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, ‘কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সব ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।’ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক জাতীয় নেতা উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন।

পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’- এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেই দিন থেকে কার্যকর হবে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ১০ এপ্রিল ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।

সে সময় তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুড়ি পৌঁছাই, তখন সেখানে পূর্বাহ্ণে ধারণ করা তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপসহীন, এককাতারে দণ্ডায়মান। পরবর্তী সময়ে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান একটা গাড়িতে করে রাত ৩টায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওনা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। 

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। দিনটি ছিল শনিবার। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতারা দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা আমাদের সঙ্গে সমস্বরে গগনবিদারী কণ্ঠে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল। 

মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানস্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহণ করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকরা পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতাদের প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএর উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে মুক্তির বাণীগুলো পাঠ করা হয়। 

আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চারজন বীর সন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সবার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ 

এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। 

পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড় জাতির বন্ধুত্ব।’ ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয় বাংলা।’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তারা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। জাতীয় নেতারা, নির্বাচিত এমসিএ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক, পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে, সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত করে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন নিয়ে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোয় বাঙালির চেতনায় বন্দি মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দুটোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ৩০ লাখ প্রাণ আর ২ লাখ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।

প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এই মহান দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের অমর স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জাতীয় চার নেতা জীবনে-মরণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু বেইমানি করেননি। ইতিহাসের পাতায় তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তারা যে আত্মদান করেছেন সেই আত্মদানের ফসল আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয় নেতাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সর্বত্র স্মরণ করা উচিত। জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য 
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। [email protected]

এতগুলো তাজা প্রাণ গেল, দায় নেবে কে?

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:২৫ এএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:২৫ এএম
এতগুলো তাজা প্রাণ গেল, দায় নেবে কে?
এম সাখাওয়াত হোসেন

ছাত্রছাত্রীদের কোটা আন্দোলনের দাবি ছিল একটি যৌক্তিক দাবি। তাদের কথা ছিল, মেধার ভিত্তিতে কোটা সংস্কার করতে হবে। অন্য কোনো দাবিদাওয়া তাদের ছিল না। এমনকি তারা সরকারের বিরুদ্ধেও কোনো কথা বলেনি। কিন্তু শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে উসকে দেওয়া হলো! আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কে বা কারা করল? এ বিষয়টি আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। 

মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর হয়ে গেছে। এখনো যদি মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিসহ ৫৬ শতাংশ কোটাভিত্তিক নিয়োগ হয়, তাহলে মেধাবীরা বঞ্চিত হবে স্বাভাবিকভাবেই। কাজেই ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কারের এই দাবি শতভাগ যৌক্তিক দাবি বলেই আমরা মনে করেছি। 

তা ছাড়া এতে করে কোটারও অপব্যবহার হচ্ছিল বলেই মনে হয়। দেশের একজন উপদেষ্টা একবার সাধারণ ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা পরীক্ষা দাও। বাকিটা আমি দেখব।’ গত কয়েক দিনে দেশব্যাপী যা ঘটল, সারা দেশের মানুষ যা দেখল, আমরা যতভাবেই এর ব্যাখ্যা দিই না কেন, এর সঠিক উত্তর আমাদের কারও কাছেই নেই। 

এখন স্বভাবিকভাবেই যে কথাটি সবার মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে তা হলো, ছাত্র আন্দোলনের এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্ত করল কারা? আরও যেটি দৃশ্যমান ব্যাপার তা হলো, সরকারের পক্ষ থেকে উসকানিমূলক কাজগুলো আসলে করল কারা? সেই ছাত্রছাত্রীরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত আন্দোলনে ছাত্রলীগসহ বাইরের ছেলেরা কেনইবা যোগ দিল? 

এরা এসে পুলিশের সঙ্গে মিলে প্রকৃত ছাত্রদের যেভাবে মেরেছে তা দেখার পর আমাদের সত্যিই কোনো ভাষা নেই! এ ধরনের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ন্যক্কারজনক অপরাধ। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সরকারের যে দাম্ভিক ব্যবহার দেখা গেছে, সুধী সমাজ কোনোভাবেই তা গ্রহণ করেনি বরং ব্যাপকভাবে সর্বত্র সমালোচিত হয়েছে। যেকোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষের জন্যই এ ধরনের ঘটনা অপমানজনক। 

সারা দেশে এতগুলো কোমলমতি প্রাণ গেল, এর দায় নেবে কে? আন্দোলনের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে সেনাবাহিনী নামানো হলো। তাদের জনগণের মাঝে নিয়ে আসা হলো। 

বিবিসি থেকে ২ শতাধিক লোকের প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। সারা বিশ্ব তা প্রত্যক্ষ করেছে। এগুলো একটি সভ্য স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না। 

পত্রপত্রিকায় ছাত্রছাত্রীদের রক্তাক্ত ছবি দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়েছি। সাঈদের ছবি, ফারহানের ছবি, পথচারীর ছবি ইত্যাদি দেখার পর একজন বিবেকবান মানুষ কীভাবে চুপ করে থাকে? এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। 

পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করা হলো, এতে করে মনে হয়, আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী নিরাপত্তা বিধানের পরিবর্তে এতটা নৃশংস হবে কেন? যে পুলিশ বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকার কথা, সেই পুলিশ কেন জনমনে ভীতির সঞ্চার করল। 

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। জনগণ একদিক থেকে অকারণে মার খাচ্ছে, অন্যদিকে প্রচণ্ড ভোগান্তিতে আছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। বাজারে যেতে পারছে না। নিম্ন আয়ের মানুষ, দিনমজুরের বাড়িতে আজ খাবার নেই। নিত্য আয়ের এই মানুষগুলো চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে! একটি দেশের সরকার থাকে জনগণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য। 

এখানে আমরা তার বিপরীত চিত্রটি দেখতে পাচ্ছি। আমরা নিজেরাও বাবা-মা। আমরা এর দায় কার কাছে দেব? আমরা আমাদের সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বেরিয়েছে, ১২-১৪ বছরের বাচ্চাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হু আর দিজ পিপল? এরা কারা? এটা আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। যারা শাসনব্যবস্থায় আছেন তাদের বিষয়টি আমলে নিতে হবে। কথায় কথায় লোকজন ধরে নিয়ে যাওয়া, গুম করে ফেলা, একটা সভ্য দেশে কারও কাম্য নয়। এসব অনভিপ্রেত ঘটনা থামানো উচিত।
  
আমার কথা হচ্ছে, সরকার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বসে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে যে আন্দোলন সমাধান করে দিতে পারত, সেখানে সাধারণ এই আন্দোলনে সেনাবাহিনী নামাতে হলো, কারফিউ দিতে হলো। ক্ষয়ক্ষতি শুধু এখানেই নয়, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে আছে। 

আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা যেহেতু টেকনোলোজির ওপর নির্ভরশীল, সে ক্ষেত্রে ইন্টারনেট নেই, যোগাযোগব্যবস্থা নেই, সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত করা হলেও তা স্বাভাবিকভাবে চলমান নয়। ২০২৬ সালে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যাচ্ছি। কিন্তু এসব নাশকতা করে কোথায় চলে গেছি আমরা? এর কারণও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ১৮ কোটি লোক জিম্মি হয়ে আছে। 

পুলিশ প্রশাসনের ব্যবহারে আমরা ভীষণভাবে মর্মাহত। আপনারা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ব্যান্ড করে দেন। প্রতিটি মৃত্যু সে যে-ই হোক, নেতা থেকে শুরু করে ইউনিফর্ম পরিহিত লোকজন আহত, নিহত হচ্ছেন। একটি ছোট দেশ আমাদের। 

কাজেই এর উন্নয়নশীল ধারা অব্যাহত রাখতে হলে এগুলো কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের খাদ্য, পানি, যাতায়াত সমস্যা, সেখান থেকে এতসব হানাহানি, আমার কথা মানতে হবে, আমার মতো চলতে হবে, তা না হলে আমি কারও কথা শুনব না- এই মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে।  

আমি নিজেও এসব ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে জড়িত। একজন অভিভাবক হিসেবে আমি ছাত্রদের বলব, আসো, তোমাদের সঙ্গে বসি। তোমাদের কী সমস্যা শুনে দেখি। পরস্পর মতবিনিময় হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কাজেই আমার কথা, যে যেভাবেই ক্ষমতায় থাকুন, আপনারা অনুভূতিশীল হোন। দেশের মানুষের কথা শুনুন। জবাবদিহির জায়গায় আসেন।  

দেশটিকে একটি ভালো প্রশাসন দেওয়ার মনোভাব তৈরি করতে হবে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো এত দেউলিয়া, তাদের ভেতর কোনো গণতন্ত্র নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো ঐক্য নেই। কোনো ধরনের জবাবদিহি নেই। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে পরস্পরের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে চলতে হবে। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, সেখানেও মারামারি হানাহানি আছে। মণিপুর এক বছর ধরে জ্বলছে। পাঞ্জাবে গণ্ডগোল হচ্ছে। এ রকম বহু ঘটনার কথা বলা যায়, কিন্তু আমরা এই পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। আমাদের কারও না কারও কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। 

লেখক: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

নাশকতাকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:২১ এএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:২১ এএম
নাশকতাকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে কোটাসংক্রান্ত জটিলতার অবসান হয়েছে। প্রজ্ঞাপনও হয়েছে। মেধাবীদের জন্য ৯৩ শতাংশ চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের সম্মানার্থে তাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা থাকলেও সেটিও মূলত মেধাবীদের জন্যই প্রযোজ্য হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এই মুহূর্তে বাংলাদেশে চাকরিতে আবেদনের উপযুক্ত বয়সী নেই বললেই চলে। ফলে বলা যেতে পারে, চূড়ান্তভাবে মেধাবীদের জন্যই ৯৮ শতাংশ চাকরির সুযোগ থাকছে। এ থেকে স্পষ্ট যে ছাত্রসমাজের মূল দাবি যথাযথভাবে পূরণ হয়েছে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখনই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তার বিশ্বাস থেকে বলেছিলেন, আন্দোলনকারীরা আদালতের রায়ে হতাশ হবেন না। তাদের পক্ষেই আদালতের রায় যাবে। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ভয়াবহ তাণ্ডব। 

মূলত দেশের উন্নয়নের প্রতীকে আঘাত হেনে দেশবাসীকে আতঙ্কিত করা এবং বিদেশিদের কাছে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাই অন্যতম লক্ষ্য ছিল। যখন ভয়াবহ হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তখন সেটি দেখে আর কারও বুঝতে বাকি থাকেনি যে, ওই হামলা এবং তাণ্ডব সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়েছে। 

বিশেষ করে, ওই সময়ের পরিস্থিতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল যে, একটি মহল চেয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠুক। আর যত সংকটপূর্ণ হবে ততই সাধারণ জনগণকে সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানো সম্ভব হবে। 

খুব স্বাভাবিকভাবে কোনো সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে সেই সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আর প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টি অনেকটা আপেক্ষিক। যতভাবেই প্রত্যাশা পূরণ করা যাক না কেন, মানুষের চাহিদার শেষ থাকে না। আর এ সুযোগে সাধারণ জনগণকেও সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন সহজ হয়। 

সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিরোধীরা যে সরকার পতনের আন্দোলনের সুযোগ নিয়েছিল, সেটি ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়েছে সব মহলের কাছে। বিশেষ করে এটি বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি যে, সুপরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো গোষ্ঠী কর্তৃক এটি সংঘটিত হয়েছে। 

বাংলাদেশকে যেকোনোভাবেই অনিরাপদ প্রমাণ করতেই মরিয়া রয়েছে একটি কুচক্রী মহল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের অন্যতম নিরাপত্তাবেষ্টনী হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অনেক সময় নিরাপত্তার শঙ্কা হিসেবে বিবেচিত হয়। 

এখানে প্রতিনিয়ত সরকারকে বিপাকে ফেলার টার্গেট নিয়ে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। তাতে যদি সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্নও হয় তাতেও তাদের মাথাব্যথা থাকে না। এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতাই অধিকভাবে লক্ষ করা যায়। 

কোটা সংস্কার ইস্যুতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পরিবেশ সৃষ্টির পর সরকার যখন অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছিল, ঠিক তখনই ওত পেতে থাকা গোষ্ঠী সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। যারা সব সময়ই দেশকে অস্থিতিশীল করার কাজে লিপ্ত থাকে তারাই সুযোগ নিয়েছে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা সারা দেশ থেকে গিয়ে রাজধানীর আশপাশে অবস্থান নিয়েছে। তাদের টার্গেট ছিল ঢাকা দখল করা। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠেছিল, ঠিক সেই সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানভাবে অর্থনৈতিক সাপোর্টসহ মানসিক সমর্থন জুগিয়ে আসছিলেন জামায়াত-বিএনপির নেতা-কর্মীরা। 

জামায়াত-বিএনপির দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় না থাকার যে ক্ষোভ এবং অপ্রাপ্তি রয়েছে, সেটির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা চাচ্ছিলেন যে কোটা সংস্কার আন্দোলন যেকোনোভাবেই ঘোলাটে হয়ে যাক। আর সেটিকে পুঁজি করে তারা সামনে এগিয়ে যাবেন। সরকারের পক্ষ থেকে সরলভাবে সমাধানের চিন্তা থাকার পর বিষয়টি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। 

এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে, সহজ বিষয়কে কিছুটা সরলভাবে দেখতে গিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমরা সত্যিই শঙ্কিত এবং ব্যথিত হয়েছি। সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী একটি সরকার এমন সরল বিষয়কে কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের পিলার হিসেবে হাতে তুলে দেবে, এটি অনুমান করাই আমাদের জন্য কষ্টকর ছিল।

সরকারের এটি বোঝা উচিত ছিল সরকারবিরোধীরা যেকোনো মূল্যে কোটা সংস্কার কিংবা বাতিলের চেয়ে বরং এই আন্দোলনকে পুঁজি করে সরকারের পতনের চিত্রটি দেখতে চায়। শুধু কোটা ইস্যু নয়, যেকোনো ইস্যুতেই তারা সুযোগ নিতে চায়। 

কোটা আন্দোলনের শুরুতেই লক্ষ করেছি, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক ও কুরুচিপূর্ণ পোস্ট। আর ওই সব চক্র কোটা সংস্কার আন্দোলনটি যখন ভিন্নভাবে সামনে আসছে তখন তাদের বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপির সমর্থকদের আনন্দিত হতে দেখা গেছে। 

তাদের আনন্দ দেখে মনে হয়েছে, কোটা সংস্কারের দাবি বাস্তবায়ন মানেই হলো- এ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের একটা বিজয়। আবার কোনো কোনো সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য দেখে পরিষ্কার মনে হয়েছে, তারা কোটা সংস্কার কিংবা বাতিল চায় না, বরং তারা চায় আন্দোলন আরও গভীর হয়ে সরকার পতনের দিকে যাক। 

এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যারা কোটা সংস্কারের পক্ষে মাঠে নেমেছিল, তাদের বেশির ভাগই বর্তমান সরকারের কার্যক্রমকে ইতিবাচকভাবেই দেখে। কিন্তু কোনো কোনো প্রেক্ষাপটে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই আন্দোলনের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত নেপথ্যে থেকে এই আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। 

এমনকি তারা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার একটি সুপ্ত বাসনা পোষণ করেছে এবং তা যেকোনোভাবেই বাস্তবায়নও করতে চেয়েছে। 
সাধারণ মানুষ পুরোনো সব অর্জনের কথা ভুলে যায় বর্তমানের কোনো অর্জন কিংবা ব্যর্থতায়। 

ইতোপূর্বে হাজার ভালো কাজ সরকার করে থাকলেও যখন কোনো স্পর্শকাতর ইস্যু জনগণের সামনে আসে, সেটির প্রভাব পড়ে জাতীয় রাজনীতিতে। কাজেই জনগণের ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে সরকারের উচিত হবে তাণ্ডবকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। এমনকি এমন ব্যবস্থা করা, যাতে কোনো দিন কোনো ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করতে সাহস না পায়। 

আমি মনে করি, হানাহানি ও বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে মৌলবাদী অপশক্তির ষড়যন্ত্র নির্মূলের এখনই উপযুক্ত সময়। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ ভুলে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। 

শুধু সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে এর মূলোৎপাটন করা কোনোভাইে সম্ভব নয়। মূলত ষড়যন্ত্র নির্মূলে সামাজিকভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনসচেতনতার ভিত্তিতে গণমানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে গণপ্রতিরোধ গড়ার কোনো বিকল্প নেই। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

সবার পরামর্শ নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
সবার পরামর্শ নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত
নূর মোহাম্মদ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে দেশে যে অরাজকতা বিরাজ করছিল তা এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যে কঠিন সহিংসতা ঘটে গেছে তা খুবই ভয়ংকর। গত কয়েক দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে দুর্বিষহ সময় গেল তা চিন্তার বাইরে। মানুষের মধ্যে নানা রকম উৎকণ্ঠা, শঙ্কা ও ভয়ভীতি কাজ করেছে। দেশে কী হতে যাচ্ছে বা ভবিষ্যতে কী হতে পারে, এমন নানাবিধ শঙ্কা। সরকার এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার নিয়ে যে দাবি তুলেছিল তা যৌক্তিক ছিল। মেধার ভিত্তিতে চাকরি হোক। গণপ্রজাতন্ত্রের চাকরিতে যে কোটা ছিল তা নিচের দিকে নামিয়ে আনা। এগুলো খুবই যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য দাবি ছিল। এই দাবি আদায়ে যে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল এবং জানমালের ক্ষতি হলো তা খুবই কষ্টদায়ক। সরকারি অনেক স্থাপনা নষ্ট হলো। 

সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কোনো দেশপ্রেমিক এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে না। এর দায়ভারটা কে নেবে? সরকারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিল বা যারা পরামর্শক ছিলেন, তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। এই সিদ্ধান্ত যদি আগেই দিতে পারত, তাহলে এমন সহিংসতা হতো না। তাহলে এতগুলো মানুষের প্রাণ হারাতে হতো না। 

নাশকতায় স্থাপনা ধ্বংস হতো না। আমি মনে করি, এখানে কিছুটা ভুলভ্রান্তি হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। এত দ্রুত সহিংসতা বেড়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হবে তা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। দেশের সবকিছুর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে এলেও এই মানুষগুলোকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। প্রাণ হারানো মানুষগুলোর পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হলো, এর দায়ভার কে নেবে?

দেশের মানুষের মধ্যে ভয়ংকর এক অবস্থা বিরাজ করছে। আন্দোলন তো সব সময়ই হয়। এবারের ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে বিরোধী পক্ষ কিছু একটা করে সরকারকে দেখাতে ও বোঝাতে চেয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রেও বিরোধীরা এমন আচরণ করে থাকে। সরকারের দুর্বলতা সব সময় খুঁজতে থাকে বিরোধীরা বা তৃতীয় পক্ষ। কিন্তু এভাবে সরকারি স্থাপনা নষ্ট করা মোটেও কাম্য নয়। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দেশ হঠাৎ করে যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবেই। আমার মনে হয়, সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তাতে অচিরেই দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করার চেষ্টা করছে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত বা দেশের মিলিটারি যা বলে সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপরি শান্ত হয়ে যাবে। এখন যে অবস্থা তাতে সারা দেশে ছোটখাটো দুর্ঘটনা হতে পারে। বড় কোনো সংঘাত তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা নেই। 

অন্যভাবে বলা যায়, যদি বেহালায় একটা টান দেওয়া হয়, তাহলে প্রথমে বড় একটা শব্দ করবে। তার পর ধীরে ধীরে সেই শব্দ বিলীন হতে একটু সময় লাগে। তেমনি দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে একটু সময় নেবে। তার পরও সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে বলে মনে করি।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায়ও একটু ঘাটতি ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাদের এমন দুর্বলতা থাকে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুলি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ক্ষেত্রেও গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। গোয়েন্দাদের নজরদারি সব সময় সঠিক হয় না। তাদেরও কিছু ব্যর্থতা বা সচেতনতার অভাব থাকে।

যেহেতু কোটা সংস্কারের বিষয়টি সরকার আগে থেকেই জানত, সে ক্ষেত্রে ছাত্রদের এই আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত ছিল। সরকারের যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল সেটা নিতে পারেনি। 

দেশে আন্দোলন বড় রূপ ধারণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তা পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রতিহত করা কঠিন হয়। এবারের আন্দোলনে এত বেশি নাশকতা হয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না। একটু আগে যদি এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হতো, তাহলে আন্দোলন সারা দেশে এত ছড়াতে পারত না। ছাত্র আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা বলেছিলেন, আন্দোলন আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে সময় সরকার শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আবার ফিরে আসবে। সেই সময় ছাত্রছাত্রীরা তাদের অন্যান্য দাবির জন্য আন্দোলন করতে পারে। তখন সরকারকে একটু চিন্তাভাবনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আগেই পরিকল্পনা করা ঠিক 
হবে না। ছাত্রদের আন্দোলনের ব্যাপারে ছাত্রলীগের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী সময়ে যাতে না বাড়ে, সে জন্য রাজনৈতিক দলসহ সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ছাত্ররা পুনরায় দাবিদাওয়া তুললে সরকার আগে শুনবে। তারপর ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করবে। ছাত্ররা ১০টা দাবি তুললে সরকার হয়তো ৫টা রাখল, এভাবেই সমাধানে যেতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুরই সমাধান সম্ভব। আলোচনা না করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেই। ছাত্রদের সঙ্গে যথাসময়ে আলোচনা করলে সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নিতে পারত না। এসব বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের ওপর পুলিশের গুলি করাটা খুবই অমানবিক কাজ হয়েছে। কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। গুলি তখনই করে, যখন জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। পুলিশ যাকে গুলি করেছে তার দিক থেকে বড় কোনো শঙ্কা বা ভীতিকর অবস্থা ছিল না। 

সবকিছু মিলিয়ে আবু সাঈদের যে অবস্থা দেখা গেল, সে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা লাঠি। সে খালি হাতে ঢিল ফেরাচ্ছে। পুলিশ তাকে গুলি করার কোনো অর্থই খুঁজে পাই না। সেই পুলিশ কনস্টেবল একদম অপেশাদারির পরিচয় দিয়েছে। একজন প্রশিক্ষণহীন মানুষের মতো কাজ করেছে। সেই কনস্টেবল একজন অবিবেচক ও অমানবিক কাজ করেছে।

দুষ্কৃতকারীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ ও সরকারি স্থাপনায় যেভাবে আগুন দিয়েছে তা ধারণার বাইরে। দুষ্কৃতকারীদের ধারণা ছিল, এভাবে ধ্বংসাত্মক কাজ করে সরকারকে অচল করে দেওয়া যায় কি না। এ জন্যই সরকারি স্থাপনাগুলোতে আঘাত করেছে।

উচ্চ আদালত কোটা সংস্কারের যে রায় দিয়েছেন, তা যথেষ্ট সম্মানজনক। ছাত্রদের কোটা সংস্কার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পরবর্তীকালে নারী কোটাসহ অন্যান্য কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে পারে। দেশে ইন্টারনেট না থাকায় যে অচলাবস্থা হয়েছে তা মানুষের জন্য বড় দুর্ভোগ। 

আমার মনে হয়, এখনই ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া উচিত। ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া জরুরি। কিন্তু সরকারের অবস্থান থেকেও বুঝতে হবে যে, এখনই যদি ইন্টারনেট খুলে দেওয়া হয়, তাহলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না। সরকার যখন চিন্তাভাবনা করে দেখবে যে, দেশ পুরোপুরি নিরাপদে আছে, তখনই খুলে দেওয়া সম্ভব। তবে সরকার খুব দ্রুতই খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় আছে।

এই মুহূর্তে সরকারের উচিত সবার পরামর্শ নিয়ে কাজ করা। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ছাত্রদের যদি আরও কোনো যুক্তিসংগত দাবিদাওয়া থাকে; তাহলে আলোচনার মাধ্যমে কিছু দাবি মেনে নিয়েই সরকারের সামনে এগোনো উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এখনো কিছুটা শঙ্কা আছে। আশা করি, বৃহত্তর জনস্বার্থে সরকার অচিরেই শান্তি ফিরিয়ে আনবে।

লেখক: সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল,
বাংলাদেশ পুলিশ

কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বই হতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বড় শক্তি

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বই হতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বড় শক্তি
সাইমন জেনকিন্স

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদের দৌড়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী এখন কমলা হ্যারিস। তাকে দেখে কিছুটা দুর্বল মনে হলেও তিনি সফল হতে চান। আমেরিকার সাবেক দুই প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়। মার্কিন গণতন্ত্রে নেতাদের ব্যর্থতার সমালোচনা করা ইউরোপীয়দের দীর্ঘদিনের খেলা। 

কমলা হ্যারিস ৫৯ বছর বয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার একজন আইনজীবী। তিনি একজন অভিবাসী শিক্ষাবিদদের মেয়ে। তার বাবা-মা দুজন দুই দেশের, একজন জ্যামাইকান এবং অন্যজন ভারতীয়। তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তিনি তার রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল এবং শেষ পর্যন্ত একজন সিনেটর হয়েছিলেন। তিনি প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান, যিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন।

যদিও মনে হচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রচারাভিযানে কমলা হ্যারিসের জাতি এবং লিঙ্গের ওপর আক্রমণ করবেন। বারাক ওবামাও দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। যদিও ওবামার জাতি এবং লিঙ্গ নিয়ে সীমাহীন ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এতেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এ ধরনের প্রচারণা ভোটারদের খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। নারীর জন্য হোয়াইট হাউসে নিশ্চয়ই প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কৃতিত্বের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও এগিয়ে যাচ্ছেন। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্ত সংকট দিয়ে প্রথমেই তাকে বেঁধে দেন বাইডেন। তার সমালোচকরা এমনটাই দাবি করেন। অদ্রবণীয় ছিল। গর্ভপাত এবং অপরাধ নিয়ে বিভাজনে দেশীয় নীতিও বিভক্ত। প্রথমত, হ্যারিস একজন স্পষ্টবাদী প্রচারক। দ্বিতীয়ত, তিনি রক্ষণশীল বই লেখক হিসেবেও পরিচিত। 

হ্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভেঙে পড়া ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে ট্রাম্পকে থামাতে সক্ষম না হলেও কমপক্ষে এমন এক কংগ্রেসকে নির্বাচিত করা হয়, যা তার বন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম। এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বের দক্ষতা প্রয়োজন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্চি ব্রাউন তার চ্যালেঞ্জিং কাজ ‘দ্য মিথ অব দ্য স্ট্রং লিডার’-এ এই থিসিসটি ভেঙে দিয়েছিলেন যে, যারা সহকর্মীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে তারা সবচেয়ে বেশি সফল হন। 

তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সহকর্মীদের ওপর নেতৃত্ব দেওয়াকে প্রায়শই দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাকে বড় শক্তি হিসেবে দেখা হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইজেনহাওয়ার ও রিগান এবং ব্রিটেনের অ্যাটলি ও উইলসনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

ব্রিটেনে একজন নেতার ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদীয় দলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে কাজ করার ক্ষমতা থেকেই উদ্ভূত হয়। তেমনি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশংসা করে এবং তাদের ইচ্ছার কাছে নত করে খুব কম নেতাই জয়ী হয়েছেন। বারাক ওবামাকে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যেমনভাবে দেখা গেছে। 

কমলা হ্যারিসের শক্তি নিশ্চয়ই অন্য জায়গায়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। কারণ অনেকেই জো বাইডেনের বিদায়কে বিভিন্নভাবে আঘাত করতে শুরু করেছিলেন। এখন তাকে ঘিরেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে চায়। তার নিজের কোনো নির্বাচনি এলাকা নেই। তার অংশীদার, সমর্থক, সহযোগী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং প্রতিভাপূর্ণ একটি দল প্রয়োজন। তাদের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্টেটগুলোতে সমর্থন জোরদার করতে হবে। কমলা হ্যারিসের শক্তি প্রচার করতে হবে এবং তার দুর্বলতাগুলো হ্রাস করতে হবে।

অতীতের অনেক প্রেসিডেন্টের উচ্চপদে আসীন হওয়ার অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তবে এতে ভেঙে পড়ার দরকার নেই। অ্যাটর্নি এবং সিনেট কমিটিতে কমলা হ্যারিসের অনুসন্ধানী ক্ষমতা তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আপনি ইতোমধ্যে শিখেছেন- এমন বিশ্বাসের চেয়ে শেখার প্রস্তুতি প্রায়শই আরও বেশি কার্যকর। 

কমলা হ্যারিস যত পরামর্শ শুনবেন, তার তত জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তার চেয়েও বড় কথা, ট্রাম্পের আরেকটি প্রেসিডেন্সি এড়াতে মরিয়া আমেরিকানদের এখন আর কোনো বিকল্প নেই। কমলা হ্যারিসকে জয়ী করতে তাকে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে।  

লেখক: গার্ডিয়ানের কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নজর দিতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দিকে

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০ এএম
বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নজর দিতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দিকে
শাহদীন মালিক

ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখেছি। প্রথম দিকে আন্দোলন কোনো রকম সহিংসতা ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য শৃঙ্খলবদ্ধভাবে এই আন্দোলন করেছেন। অবরোধের মধ্যে কিছু কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ হয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য। তবে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা সংঘটিত হতে দেখা যায়নি। 

তারপর সহসা আমরা দেখলাম চারদিকে সহিংসতা শুরু হয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করা হলো। গাড়িঘোড়া পোড়ানো হলো। নরসিংদীর জেলখানা ভেঙে ৮০০-এর মতো কয়েদি পালিয়ে গেল। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক কিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- কারা এ ধরনের সহিংস আন্দোলনের পথে গেল!

সরকারের জবাব একটাই। এ কাজ করেছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে অবস্থিত ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ৬০ জন রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই কাজ সংঘটিত করেছে বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রফ্রন্ট ইত্যাদি গোষ্ঠী। 

সরকার মনে করে, বড় বড় দেশ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা এসব কে করছে, কেন করছে, এসবকিছুই তারা জানেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা অনেক কিছুই জানেন। সারা বিশ্ব এ সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। এই সহিংসতা কে করেছে? এই সহিংসতা করেছে একটি অশুভ শক্তি, যারা কখনো দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল চায় না। তারাই দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়েছে। এরাই সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সহিংসতায় বিএনপি-জামায়াতের যে সম্পৃক্ততা নেই, সেটা কেউই জোর গলায় দাবি করছে না। এ ধরনের সহিংসতার পেছনে অবশ্যই জঙ্গিবাদী দলের সম্পৃক্ততা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছু সহিংস লোক থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, এভাবে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর ওপর সংঘবদ্ধভাবে হামলা করা, এটা রাষ্ট্র আক্রমণের শামিল। এ ধরনের আক্রমণ দল-মতনির্বিশেষে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীই করতে পারে।

এ ধরনের কার্যক্রম করে তারা পরিবেশ অস্থিতিশীল করে থাকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেন্দ্রিক যে সহিংসতা হয়েছিল, স্থানীয় সরকারের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, পাঠাগার পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম হয়েছিল। সেটাও জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে। সরকার শুধু বিএনপি-জামায়াতে ভূত দেখছে। এটা সম্পূর্ণ অমূলক। 

জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপানোয় সরকারের অতি উৎসাহের কারণে এই সন্ত্রাস গোপনে গোপনে ব্যাপক আকারে সংঘটিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে নজরদারির প্রয়োজন ছিল, সেই নজরদারি অনেকটাই শিথিল। হোলি আর্টিজেনের কথা যদি আমরা মনে করি, যে ছেলেরা এই হোলি আর্টিজেনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা জামায়াত-বিএনপির ছিল না। 

তারা ছিল উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষিত সদস্য। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় বিএনপির বর্ষীয়ান নেতাকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। কিন্তু ছাত্রী মেরে ফেলা কোনো জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের কথা আমরা শুনিনি। বিএনপি-জামায়াতের নিশ্চয়ই কিছু সংশ্লিষ্টতা আছে। এ ধরনের সহিংসতা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করে, এমন সব স্থাপনায় ভাঙচুর করা, ইন্টারনেট অকেজো করে দেওয়া, আমি বিশ্বাস করতে চাই না, ভালোমন্দ যেটাই হোক, বিএনপির মতো পুরোনো রাজনৈতিক দল এটা করতে পারে না। 

এসব কাজ করে থাকে চরমপন্থী জঙ্গিরা। আমরা দেখছি সরকার বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করছে। ফলে চরমপন্থী জঙ্গিরা যে ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে, সেদিকে সরকারের যতটুকু তৎপর হওয়ার কথা ছিল, সেই তৎপরতা দেখছি না। এতে আশঙ্কা করা হয়, সরকার এক পক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে আরও অন্যান্য যে ভিশন শত্রু দেশে সয়লাব হয়ে গেছে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়েছে। 

এটাই সবচেয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কার ব্যাপার যে, এতে নিশ্চয়ই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের বিরাট ব্যর্থতা আছে। এত জায়গায়, এতভাবে আক্রমণ হলো এভাবে সংঘবদ্ধ আক্রমণ, অথচ তারা কিছুই জানত না। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সরকারের যে একচোখা মনোভাব দেখাল, এতে আমাদের রাষ্ট্রই সশস্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ল। 

আমরা চাই দেশব্যাপী অস্থিতিশীল পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এখন অবধি সঠিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকার যদি সমঝোতার পথে আসতে চায়, তাহলে শুরুতেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা দরকার। 

পুলিশের গুলিতে নিহত রংপুরের আবু সাইদের মৃত্যু এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তদন্তের মাধ্যমে বিচার করা উচিত। দেশে অন্যায়-অবিচার হলে সব মহলই বিচারের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সঠিক বিচার তারা পায় না। আমার মতে, বিচার বিভাগকে অচিরেই ঢেলে সাজানো খুবই জরুরি। 

দেশব্যাপী সহিংসতায় অর্থনীতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশে সেনাবাহিনী নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে, হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারকে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সব সমস্যা সমাধানের পথে যেতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাপীঠে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দেশ ও দেশের স্বার্থকে সবার আগে আমলে নিয়ে দল-মতনির্বিশেষে সব পক্ষকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তৎপর হতে হবে।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক