![সামাজিক অপরাধের পরিসীমা বিস্তৃত হচ্ছে](uploads/2024/04/18/1713416828.sakhaoyat-hossain.jpg)
মিস্টার রহমান সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে শহরে ২-৩ শতাংশ জায়গা কিনে একটি বাড়ি বানানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। জমির রেজিস্ট্রি পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু জমি দখল করতে গিয়ে তিনি বেকায়দায় পড়লেন। এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেরা এসে বাধা দিল, তারা মহল্লায় নতুন একজনকে জমি দখল করতে দেবে না। উপায়ান্তর না দেখে এলাকার একজন রাজনৈতিক নেতার মধ্যস্থতায় তিনি ছেলেদের সঙ্গে কথা বললেন। রাজনৈতিক নেতার ভাষ্য ছিল, ছেলেদের খুশি করে জায়গা দখলে নিয়ে নিন এবং এটাই এখন অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাধ্য হয়ে রহমান সাহেব ছেলেদের ভালো অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে জমি দখলে নেন। পরিস্থিতি এবং বাস্তবতার মিশেলে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ না হয়ে প্রচলিত নিয়মেই উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করেন।
একটি প্রতিষ্ঠিত ডেভেলপার কোম্পানি বিভাগীয় শহরে ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্দেশ্যে জমি ক্রয় করে এবং নিয়মমাফিক জমি দখলও করে। কিন্তু জমি পাইলিং করার সময় বিপত্তি দেখা দেয়। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মালিকপক্ষের কাছে হুমকি আসতে শুরু করে এবং কয়েকটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ এসে কাজ বন্ধ করতে বাধার সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে একই কায়দায় (পূর্বে উল্লিখিত) মালিকপক্ষকে মধ্যস্থতা করতে হয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে। এই প্রভাবশালীরা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, সরকার পরিবর্তিত হলেও তাদের প্রভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না। এই প্রভাবশালীরা মেকানিজম করে সর্বসময় আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। বড় বড় শহরে যারা ফ্ল্যাট ব্যবসার কাজে যুক্ত, তারা নির্মাণকাজ শুরুর আগেই প্রভাবশালীদের খুশি করেই কাজ শুরু করে থাকে। এই যে প্রভাবশালীদের খুশি করতে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়, সেই খরচের রেশ কিন্তু সাধারণ ক্রেতাদের ওপর বর্তায়, ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যায়। উল্লিখিত দুটি ঘটনাই সামাজিক অপরাধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবং এ ধরনের অসংখ্য সামাজিক অপরাধের চিত্র সমাজব্যবস্থায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে এবং সমাজ ক্রমান্বয়ে আরও পরিবর্তিত হবে। সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পরিবর্তনশীলতা। এই পরিবর্তনশীলতাকে ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা পৃথিবী প্রতিনিয়ত অগ্রগামী এবং অগ্রগামী পৃথিবীর ধারায় আলোকিত ও কল্যাণকর পৃথিবী নির্মাণে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে ভবিষ্যতের স্বার্থে। সে জায়গায় যদি সমাজকে সঠিকভাবে বিনির্মাণে ব্যর্থ হতে হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের শেষ থাকবে না। বাংলাদেশে শহর এবং গ্রামে উভয় জায়গাতেই সামাজিক অপরাধের প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং সামাজিক অপরাধের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি সমাজ নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। কাঠামোবদ্ধ সমাজই মূলত একটি সমাজকে স্থিতিশীল ও ইতিবাচক গতির মধ্যে রাখে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে যখন সমাজ সামনের দিকে অগ্রসর হয়, চলমান থাকে সেটি প্রকৃত অর্থে কাঠামোবদ্ধ সমাজের নিদর্শন। কাঠামোবদ্ধ সমাজের ধারাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া থেকেই সমাজবিরোধী অপকর্মগুলো সাম্প্রতিক সময়কালে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সমাজকে স্থিতিশীল রাখার তাগিদেই সমাজের মধ্যে সমাজসৃষ্ট অনুশাসন, রীতিনীতি ও নিয়মকানুনের চর্চা অব্যাহত থাকে। এ চর্চাগুলো নানাবিধ কারণে অনুপস্থিত রয়েছে সমাজে। যে সুযোগটিকে কাজে লাগায় উঠতি বয়সী তরুণরা এবং এ তরুণদের নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি মহল। শহরাঞ্চলে বহু আগেই সমাজ কাঠামোর পঠিত চর্চা অনুপস্থিত এবং গ্রামাঞ্চলে যৎসামান্য আকারে যতটুকু উপস্থিত ছিল সেটিও কালক্রমে বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থানের কারণেই মূলত সামাজিক অপরাধের পরিসীমা বিস্তৃত হচ্ছে। সামাজিক অপরাধ মূলত সেসব অপরাধ যা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত অপরাধ নয়, কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধ। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত অপরাধে যাদের সংযুক্ততা পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ে এ শ্রেণিটিই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত অপরাধ কাঠামোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর আবহ সৃষ্টি করে থাকে।
Douglas and Waksler, সমাজচ্যুত আচরণগুলোকে একটি চিমনির (ফানেল) মধ্যে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কারও আচরণ ভুল, অদ্ভুত এবং আশ্চর্য মনে হলে; কারও আচরণ অপছন্দ এবং অরুচির মনে হলে; কেউ মূল্যবোধ এবং নিয়মরীতির ব্যত্যয় ঘটালে; কারও দ্বারা নৈতিক মূল্যবোধ ও নৈতিক নিয়মের ব্যত্যয় হলে; নৈতিক বিচারের মানদণ্ডে কেউ মূল্যবোধ এবং নিয়মরীতির ব্যত্যয় ঘটালে; নৈতিক বিচারে নৈতিক মূল্যবোধ ও নৈতিক নিয়মের ব্যত্যয় হলে; মন্দ আচরণের মাধ্যমে আইনের ব্যত্যয় হলে; আইনকে পাশ কাটিয়ে গুরুতর অপরাধ সম্পন্ন করলে; ব্যক্তিত্বের মধ্যে মানবিক আচরণ অনুপস্থিত থাকা এবং সর্বশেষ কৃতকর্ম প্রকৃত অর্থেই অশুভ হলে উল্লিখিত বিষয়বাদি সমাজচ্যুত আচরণের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের সমাজচ্যুত আচরণ যাদের চরিত্রে উপস্থিত তাদের মাধ্যমেই সামাজিক অপরাধ সংঘটন সম্ভব এবং সামাজিক অপরাধের প্রবণতা থেকেই মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আইন ভাঙার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
শহরে পরিবেশগত নিরাপদ ব্যবস্থার কারণে অনেক স্থানেই অপরাধের হারও স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে, তবে কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে বস্তি ও তৎসংলগ্ন এলাকা, ভাসমান এলাকা, নদীবিধৌত এলাকা, শ্রমজীবী ও কর্মজীবীদের আবাসস্থল প্রভূত এলাকা ও অঞ্চলে সামাজিক অপরাধের ব্যাপকতা মারাত্মকভাবে পরিলক্ষিত হয়। গ্রামাঞ্চলে কার্ড খেলার নাম করে জুয়া খেলা, ক্যারম বোর্ডে জুয়ার আসর বসানো, বাজি ধরে দাবা খেলাসহ অপ্রদর্শিত সামাজিক নিয়মের ব্যত্যয় দেখা যায় সর্বস্ব। সমাজ যে কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘকাল ধরে সেটির ব্যত্যয়ের কারণেই সামাজিক অপরাধ পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। সমাজে একটি শৃঙ্খলা বজায় ছিল সব সময়, যেখানে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। কিন্তু কালের পরিবর্তনে শৃঙ্খল কাঠামোর বিপরীত আমরা একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছি। সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের সমাজ পরিচালনায় এখন আর দেখা যায় না। কেননা সমাজের শৃঙ্খল পরিস্থিতিকে ভাঙার কারণেই মূলত গণ্যমান্য ও সম্মানিতরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। এমনও সময় ছিল পুরো ইউনিয়ন থেকে কোনো অভিযোগ নিকটস্থ থানায় দায়ের করা হতো না। তার মানে কি ওই ইউনিয়নে অনিয়ম বা অন্যায় সংঘটিত হতো না? অবশ্যই হতো কিন্তু সমাজের নিয়মকানুনের দায়বদ্ধতার কারণেই মূলত সামাজিক বিচারেই সমস্যাগুলো নিষ্পত্তি হয়ে যেত। বিচারে বাদী-বিবাদী দুই পক্ষের সুবিধা-অসুবিধা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো, যাতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই লাভবান হয়। বর্তমান সমাজে এ শৃঙ্খল ব্যবস্থা অনেক সমাজেই বিলীন হয়ে গেছে, সামান্য একটি ঘটনা ঘটলে থানা-আদালত পর্যন্ত গড়ায় অভিযোগ হিসেবে।
সামাজিক শৃঙ্খলব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সারা দেশে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা দেখা যাচ্ছে। স্কুল-কলেজে দেখা যায়, ছেলেরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে পিয়ার গ্রুপের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে অনিয়মের চর্চা করছে। আমাদের সমাজেই স্কুল চলাকালীন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো একসময় অসম্ভব ছিল। কিন্তু সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা সমাজবিরোধী অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিশোর অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অভিভাবকরাও এ বিষয়ে উদাসীন, স্কুল ফাঁকি দেওয়ায় তারা কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা আদৌ শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে? হয়তো পরীক্ষার ফলাফল ভালো করার ক্ষেত্রে তাদের একটি ভূমিকা রয়েছে। কোচিং সেন্টারে শৃঙ্খলার ব্যাপারটি অনুপস্থিত থাকে। কেননা শিক্ষার্থীরা মনে করে এখানে তারা টাকা দিয়ে সেবা গ্রহণ করছে। তৎপ্রেক্ষিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার শৃঙ্খলার যে বন্ধন সেটি পুরোপুরি রকমের অনুপস্থিত থাকে এবং শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়।
পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, ইভ টিজিং, সেক্সুয়াল হ্যারেসমেন্ট, ব্ল্যাকমেলিং, বুলিং ইত্যাদি রকমের অপকর্ম স্কুলশিক্ষার্থীদের দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত শিক্ষকরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকেন; বিশেষ করে একজন শিক্ষকের মূল কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীর মেধা ও মননকে বিকশিত করার লক্ষ্যে অনুপ্রেরণা প্রদানের মধ্য দিয়ে উদ্ভাবনীমূলক কাজের অনুসন্ধানে সহযোগিতা করা। যেখানে শিক্ষার্থীর জন্য অবাধ সুযোগ এবং অবারিত দ্বার উন্মোচন করা থাকে এবং এ সুবিধাসমূহ পরিপক্ব আকারে নিজের জীবনে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসে শিক্ষার্থীরা সামনের পথচলায় ইতিবাচকতাকে অনুসরণ করে থাকে। আমরা সবাই জানি, শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে কিশোর শিক্ষার্থীরা অনুকরণপ্রিয়, ইতিবাচক কাজের অনুপ্রেরণা একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ পথচলাকে মসৃণ, সুন্দর ও উজ্জ্বল করবে।
ওপরের আলোচনায় উল্লিখিত সব অপরাধই সামাজিক অপরাধ নয়, রাষ্ট্রীয় আইনে স্বীকৃত অপরাধও রয়েছে। তবে আলোচনায় নিয়ে আসার অন্যতম কারণ হলো, সব অপরাধ সামাজিকভাবেই নিষ্পত্তি হয়ে যেত এবং বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই সামাজিকভাবে নিষ্পত্তিকৃত সালিশের মাধ্যমে উপকারভোগী হতো। এসবের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে কিংবা সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে সমাজকে ঢেলে সাজাতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করতে হবে এবং সমাজ স্বীকৃত রীতি, নিয়ম, প্রথা, বিধিবিধানকে মেনে চলার যোগ্য নাগরিক তৈরি করতে পারলেই সামাজিক অপরাধের পরিধি ও ভয়াবহতাকে নিমেষেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়