![ক্ষমতাবানদের অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতাহীনদের অসহায়ত্ব সমাজজুড়ে](uploads/2024/04/19/1713503393.Sirajul-Islam-Chowdhary.jpg)
পাকিস্তানি হানাদাররা যেসব জঘন্য অপরাধ করে গেছে, সেগুলোর অনেক সাক্ষীর একটি হচ্ছে যুদ্ধশিশুরা। এদের অনেকেরই স্থান হয়েছে এতিমখানায়, কেউ প্রাণ হারিয়েছে পথেঘাটে পরিত্যক্ত অবস্থায়; যাদের কপাল ভালো তারা আশ্রয় পেয়েছে বিদেশে, পালক পিতামাতার গৃহে। ১৫ জন এতিম গিয়েছিল কানাডায়, তাদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন কানাডা অভিবাসী বাঙালি গবেষক ও সমাজকর্মী মোস্তাফা চৌধুরী। বইটির নাম দিয়েছেন ‘আনকনডিশনাল লাভ, এ স্টোরি অব এডপশন অব নাইনটিন সেভেনটিওয়ান ওয়ার বেবিজ’। বইতে ওই ১৫ জনের সবার কথাই আছে। এদের ভেতর পাঁচজন একবার বাংলাদেশে এসেছিল, নিজেদের মাতৃভূমির সন্ধানে।
পাঁচজন এতিম শিশুর একজন ছিল বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা ভেবে সে সর্বদাই দুঃখভারাক্রান্ত থাকত। গোপনে কাঁদত। মেয়েটি আবার কবিতাও লিখত। বাংলাদেশে এসে বিশেষভাবে সে নদী দেখেছে, বুড়িগঙ্গায় নৌকায় বসে সে ভেবেছে এই দেশের কোথাও না কোথাও তার দুঃখিনী মা লুকিয়ে আছেন, যে নাকি তাকে তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পরিত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কানাডায় ফিরে গিয়ে মেয়েটি ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিল। নাম দিয়েছিল ‘চাইল্ড অব দ্য রিভার্স’। বাংলাদেশকে সে নদীমাতৃক বলে জানে। সে কথাটি আছে তার কবিতায়। আছে তার নিজের মায়ের কথাও। বলেছে সে, ‘মা তুমি আমাকে তোমার বুকে রাখতে পারোনি, ছেড়ে দিয়েছিলে, যখন আমি ছোট্টটি ছিলাম। তোমার কথা ভেবে আমি খুব কেঁদেছি এবং আমার সে বেদনা শেষ হবে না যতক্ষণ না আমি তোমাকে খুঁজে পাই, তোমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরি নিজের বুকের ভেতরে।’
মেয়েটির বাংলা নাম রানি; পারিবারিক পদবি মোরাল। রানি মোরালের বিদেশি বাবা-মা অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। মোরালদের নিজেদের একটি সন্তান আছে, তবু তারা আগ্রহের সঙ্গে পালক নিয়েছেন বাংলাদেশের এতিম একটি শিশুকে এবং তাকে আপন সন্তানের মতোই মমতা ও যত্নে লালন-পালন করেছেন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও রানিকে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত। সঙ্গ দেওয়ার জন্য রানির সঙ্গে তারাও বাংলাদেশে এসেছিলেন। আশা করেছিলেন জন্মভূমি খুঁজে পেয়ে রানি তার বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু যা ঘটেছে তা ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশ দেখার পর ২৬ বছর বয়সী রানির যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সহ্য করতে পারেনি। অল্পদিন পরে সে নিজের হাতে নিজের জীবনের অবসান ঘটিয়েছে। অনুমান করি, বাংলাদেশের অবস্থা দেখে তার শেষ ভরসাটুকু তার জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আঁকড়ে ধরার মতো আর কোনো অবলম্বনই তার জন্য অবশিষ্ট ছিল না।
মাতৃহারা যে পাঁচজন মাতৃভূমির খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিল তাদের ভেতর রায়ান নামের ছেলেটি ছিল ভিন্ন ধরনের। টগবগ করত সে আশায়। এসেছিল সম্ভব হলে মায়ের দেশে থেকেই যাবে, এই রকমের একটা গোপন ইচ্ছা নিয়ে। এখানে ছিলও সে বছরখানেক। তার আসার খবরটা জানাজানি হয়ে যায়। মিডিয়া তাকে নিয়ে বেশ খানিকটা হইচই করে। যুদ্ধশিশুর প্রথম বাংলাদেশে আগমন! ব্যাপার সামান্য নয়। রায়ান দেখেছে, শুনেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। লোকের সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু অচিরেই তার ভেতর একটা হতাশা দানা বেঁধে ওঠে। হতাশা নিয়েই ফিরেছে সে কানাডায়। তবে আত্মহত্যা করেনি।
বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় কানাডার আপনজনদের সঙ্গে রায়ান নিয়মিত পত্র যোগাযোগ করত, ই-মেইলে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাত। ঢাকার রাস্তায় একদিন শোনে বোমার আওয়াজ, দেখতে পায় আতঙ্কগ্রস্ত একটি মেয়ে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। পরে শুনেছে সে যে, নারী হয়রানি ও ধর্ষণ বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত আসে সেসব খবর।
কানাডার বাবা-মাকে সে একবার যা লিখেছিল বাংলায় অনুবাদ করলে সেটা এ রকম দাঁড়ায়- ‘বাংলাদেশ মনে হয় একটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়েছে। সুড়ঙ্গটা অন্ধকার। এর শেষ মাথা দেখা যায় না। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ধরনটা পিরামিডের মতো। এর নিচের দিকে রয়েছে তরুণরা। এই তরুণরা অচিরেই বড় হবে; বড় হয়ে দেখবে যে তাদের স্থান সংকুলানের জন্য কোনো সামাজিক উদ্যোগ নেই। কাজ নেই, সুযোগ নেই, বাস্তবিক অর্থে কোনো অবকাশও নেই। বিশ্বায়িত এমন একটি বাংলাদেশে তারা বেড়ে উঠবে, যেখানে কেবল টিভি ও আমদানি করা অন্যান্য সামগ্রী খুবই ব্যস্ত থাকবে; শুধু ব্যস্ত নয়, থাকবে অত্যধিক পরিমাণে ব্যস্ত।’
রায়ান এটা লিখেছিল ১৯৯৮ সালে। আমরা ধারণা করি, বাংলাদেশে সে আর ফিরে আসেনি। একদিন তার মা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন, অনতিক্রম্য এক বিপদে পড়ে। তা নিয়ে রায়ানের মনে দুঃখ ও গ্লানি থাকার কথা। কিন্তু এটা খুবই সম্ভব যে, বাংলাদেশে আসার পর সে নিজেই তার মাতৃভূমি থেকে পলায়ন করেছে, প্রাণভয়ে। নইলে হয়তো তার অবস্থাও তার সমবয়স্ক ও ভগ্নিসম রানির মতোই হতো। রায়ানের জন্য সুযোগ আছে। কানাডা আছে। সে পালাতে পারে। যাদের জন্য কোনো সুযোগ নেই, তাদের অনেকেই চেষ্টায় থাকে পালানোর সুযোগ তৈরি করার। সুযোগ তৈরি না করতে পারলে ভীষণ হতাশ হয়। বিত্তবান পিতা-মাতা বৈদেশিক আশ্রয়ের এক রকমের ব্যবস্থা করেই রাখেন। সন্তানদের জন্য, নিজেদের জন্যও।
হতাশ যুবক রায়ানের ১৯৯৮ সালের অভিজ্ঞতার পর একে একে ২৫ বছর কেটে গেছে। না, অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরঞ্চ অবনতিই ঘটেছে। আমাদের জন্য সমষ্টিগত সুড়ঙ্গবাসের অবসান ঘটেনি। অন্ধকার এখন আরও গাঢ়, ভবিষ্যৎ এখন অধিকতর অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা হলো সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা।
দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছেন কৃষিজীবীরা। সেই কৃষক ভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছে এবং বিকল্প কাজ পাচ্ছে না। রামপালে, বাঁশখালীতে তাদের ভূমি চলে গেছে। প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি। প্রকৃতি ভয়ংকরভাবে বিপন্ন। সুন্দরবনকে তো মনে হয় শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ তার ওপর মুনাফালোভীদের চোখ পড়েছে। প্রাকৃতিক ওই বনটি আত্মহত্যা করবে না, সে শক্তি তার নেই; কিন্তু রানির হারানো মায়ের মতোই দুঃখ নিয়ে সে একদিন হারিয়ে যাবে। বুড়িগঙ্গা নদীকে দেখে রানি তার নিজের মায়ের কথা ভেবেছে, ভেবে কাতর হয়েছে। কেঁদেছে। রানি আজ বেঁচে নেই, যদি বেঁচে থাকত এবং বুড়িগঙ্গার খোঁজ করত, তবে দেখতে পেত নদীটি আর নেই, মরে গেছে। একটা নয়, অনেক নদীই এখন মরা। বড় বড় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, উজানের ভারত পানি ছাড়ছে না বলে। মৃত্যুর আগে রানি দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেছে, নদীর মরণদৃশ্য তার যন্ত্রণা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত। সাভারে রানা প্লাজা ধ্বংস হওয়ায় একসঙ্গে ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক মারা গিয়েছিল এবং তাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারখানার মালিকের কোনো দোষ দেখতে পাননি, ভবনটির পিলার ধরে অলৌকিক হস্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঝাঁকুনি দেওয়াকে শনাক্ত করেছেন। বিশ্ব কাঁপানো ওই মাপের মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনার সংবাদ পেলে রানির যন্ত্রণা কতটা বাড়ত তা আমরা অনুমান করতে পারব না। রানি যদি ভাবত যে, নিহত শ্রমিকদের মধ্যে তার দুঃখিনী মা-ও আছেন, তাহলে তাকে সান্ত্বনা দিত কে? রানি সংবেদনশীল মানুষ, অন্যদের কষ্ট না দিয়ে নিজেই চলে গেছে, বক্ষভেদী দুঃখ বহন করে।
যুদ্ধশিশুরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনোপচনীয় গ্লানির ও দুঃসহ দুঃখের কারণ। বাংলাদেশ যে তার মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, সে ব্যর্থতার ক্ষতিপূরণ কোথায়? আর অন্য সব শিশু? তাদের কী অবস্থা? কেমন আছে তারা? তাদের জন্য খেলার মাঠ কোথায়? চলাফেরার জায়গা কোনখানে? ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা জন্মের পরই উৎপাটিত হয় পরিবেশ, প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে। এমনকি মাতৃভাষা থেকেও। গরিব ঘরের শিশুরা শিকার হয় অপুষ্টির, পাচার হয়ে যায় বিদেশে, বাধ্য হয় অমানবিক শ্রমে। শিশু হত্যা বাড়ছে। শিশুর ওপর যৌন হয়রানি ঘটছে। ভাড়াটের শিশুটি কাঁদছে দেখে বিরক্ত হয়ে বাড়িওয়ালার গিন্নি তাকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলছে; এমন ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ বলে ধরে নিলে ভুল হবে। এটি হলো ক্ষমতাবানদের অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতাহীনদের অসহায়ত্ব এবং সমাজজুড়ে প্রবহমান হিংস্রতারই উন্মোচন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়