ঢাকা ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫
English

পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের মতো কেউ ত্যাগ স্বীকার করেনি: ইউসুফ রামাদান

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ১১:১৫ এএম
পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের মতো কেউ ত্যাগ স্বীকার করেনি: ইউসুফ রামাদান
বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান

বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। ৯ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার অবদান অতুলনীয়। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী চলমান আন্দোলনসহ তার ব্যক্তিজীবন ও ফিলিস্তিনসংক্রান্ত নানা প্রসঙ্গ নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ রহমানরিয়াজ উদ্দীন। সঙ্গে ছিলেন রায়হান রাশেদ

খবরের কাগজ: প্রথমেই জানতে চাই, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি কী? 

ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে ইসরায়েলের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে তারা কিছু সংশোধনী দেয় এবং হামাস এ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। হামাসের সম্মতির বিষয়টি নেতানিয়াহুকে খুবই অবাক করেছে। কারণ, তিনি এমনটা শুনতে চাচ্ছিলেন না। নেতিবাচক কিছু শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। তারা ভেবেছে, এ সংশোধনী হামাস প্রত্যাখ্যান করবে। 

নেতানিয়াহুর হয়ে যারা কাজ করে, তারা তাকে বলেছে- এ প্রস্তাব হামাস মেনে নেবে না। কিন্তু হামাস শেষ মুহূর্তে চমক দেখিয়েছে, মেনে নিয়েছে। নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের জন্য এটি অবাক করা খবর। কারণ তিনি যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। এ যুদ্ধের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে তার ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জড়িত। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে নেতানিয়াহুর ক্যারিয়ারও থমকে যাবে। 

বিশ্বের প্রায় সব সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে, এ যুদ্ধটা ইসরায়েলের নয়; নেতানিয়াহুর এবং তার সরকারের যুদ্ধ। যদিও বর্তমান সময়ের সবকিছু নেতানিয়াহুর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

মিসর, কাতার, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রভাবশালী দেশসহ ফিলিস্তিনিরা চাচ্ছেন, এবার অন্তত এ যুদ্ধটি বন্ধ হোক। কিন্তু নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির কারণে বিষয়টি থমকে আছে। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, ইসরায়েল একা লড়তে পারে। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করছি সামনে কী ঘটে। 

খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থা কেমন?

ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো নেই। এ পরিস্থিতির সঠিক ব্যাখ্যা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। গাজার মানুষ পুরোপুরি দুর্দশাগ্রস্ত, এমনকি পশ্চিম তীরের মানুষও মারা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিটা আসলে অনুমান করা সম্ভব নয়, লাখ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। গাজা ভূখণ্ডের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে এখন নিজ দেশেই শরণার্থী। এর ওপর খাবারের চরম সংকট বিরাজ করছে। গাজায় যে পরিমাণ খাবার প্রবেশ করছে, তাতে ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও মিটছে না। ২০ শতাংশ মানুষের অপ্রতুল খাবার বণ্টিত হচ্ছে পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ফলে তৈরি হচ্ছে তীব্র খাদ্যসংকট। 

এর মানে এই নয় যে, বহির্বিশ্ব আমাদের সহযোগিতা করছে না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ খাবার ও ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করছে। কিন্তু ইসরায়েল সেসব সামগ্রী ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ইন্টারনেট নেই, যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, খাদ্য ও পানি নেই, ওষুধ নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ, চার্চ ধ্বংস করা হয়েছে। হামলার কারণে অকার্যকর হয়ে গেছে সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক। কারও কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধও নেই। ছোট একটি উদাহরণ দিই, কোথাও কোনো অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা নেই। অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া সব ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে। ১০ বছরের একটি বালকের পা কেটে ফেলা হয়েছে অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই। এবার আপনি চিন্তা করে দেখুন, সেখানকার মানুষ কেমন জীবন যাপন করছে!

খবরের কাগজ: যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী?

ইউসুফ রামাদান: দেখুন, রাজনীতিতে সবাই নিজ নিজ স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করে। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলকে সমর্থন করা। ‘ইসরায়েলেরও তাকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে’- এমন নীতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। আমরা অনেকেই জানি, আমেরিকায় জায়োনিস্ট লবি (কট্টরপন্থি ইহুদিদের প্রভাব ও গ্রুপিং) খুবই শক্তিশালী এবং কার্যকর। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অন্য কোনো লবি আমেরিকায় নেই। এটা যেমন বর্তমানে আছে, তেমন অতীতেও ছিল। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের শুরু (১৯৪৮ সাল) থেকে, আমেরিকার জায়োনিস্ট লবি ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে। দেখুন, আমেরিকায় ৬০-৬৫টি দেশের ৩০-৪০ লাখ মুসলমান রয়েছে। তারা সবাই আলাদা দলে, কমিউনিটিতে বিভক্ত। আলাদা স্থান ও সমাজে বসবাস করে। তাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য নেই। আর এই অনৈক্য ভিন্ন লবিকে আমেরিকায় যেভাবে খুশি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দিচ্ছে। 

এ ছাড়া জায়োনিস্ট লবির আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি এবং গণমাধ্যমেও তারা খুবই সক্রিয়। ফলে জায়োনিস্ট লবি আমেরিকায় খুবই শক্তিশালী। হোয়াইট হাউস, সিনেট, কংগ্রেসসহ আমেরিকার সর্বত্র এদের বিচরণ। আমি এটাকে ‘আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার’ বলে থাকি। এ লবি আমেরিকার সরকারের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতাকে বাজেয়াপ্ত করার মতো প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনি আমেরিকান হলে আমেরিকার সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করতে পারবেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেস সদস্যদের নিয়েও কথা বলতে পারবেন, কিন্তু কোনোভাবেই ইসরায়েলের সমালোচনা করতে পারবেন না। এভাবে আপনার কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেটা নিয়ে আমেরিকারও কিছু করার নেই। ইসরায়েলের সমালোচনা করলে তারা আপনাকে অ্যান্টিসিমেটিকের তকমা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করলে কিছুই হবে না।

বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিনের চৌকস কিছু সাংবাদিক সবকিছু রেকর্ড করছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই জীবন হারিয়েছেন, অনেকে পরিবার হারিয়েছেন। তবু তারা কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে আমেরিকায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।

খবরের কাগজ: আপনার কথার সূত্র ধরে জানতে চাই, আমেরিকার ছাত্র আন্দোলনকে ফিলিস্তিন কীভাবে দেখে?  

ইউসুফ রামাদান: এই বিপ্লব, ছাত্রদের এই আন্দোলন আমেরিকার প্রশাসনকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, কার পক্ষে অবস্থান নেবে তারা। আমেরিকার জনসাধারণের স্বার্থ দেখবে নাকি ইসরায়েলের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেবে। আর এ কারণে আমেরিকা এখন জোরালোভাবে যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে। অথচ তারা ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের দাবিতে আলজেরিয়ার প্রস্তাবে ভেটো দেওয়াসহ তিনবার যুদ্ধবিরতিতে ভেটো দিয়েছে। ছয় মাসে তারা চারবার ভেটো দিয়েছিল। আর এটাই জায়োনিস্ট লবিস্টদের অভূতপূর্ব ক্ষমতা। এভাবেই নেতানিয়াহু সমর্থকরা জো বাইডেনকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলে। 

পরিস্থিতি এখন কিছুটা পাল্টেছে। বাইডেন বুঝতে পারছেন, বারবার একই পথে যাওয়াটা তার দেশ, জনগণ ও প্রশাসনের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে। তিনি বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দেওয়ার কথাও বলছেন। এর মানে এই নয় যে, তিনি গাজার মানুষকে ভালোবাসেন কিংবা তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন; আসলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা আশাবাদী। কারণ ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। হামাসের প্রস্তুাব মেনে নেওয়াটা ইসরায়েলকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এখন হয়তো তারা চরমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, নয়তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করবে।   

খবরের কাগজ: বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ, বিশেষত আরব বিশ্বের ভূমিকায় কি আপনারা সন্তুষ্ট?

ইউসুফ রামাদান: আরব বিশ্বের ভূমিকা কিংবা সাধারণ মুসলিম দেশের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে এবং সেটা যে কেবল ফিলিস্তিন ইস্যুতে সীমাবদ্ধ, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমস্যা আছে। অনেক ইস্যুতেই যথার্থভাবে তারা পাশে দাঁড়াচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলা যায়। ফিলিস্তিন ইস্যুর তুলনায় এটা অনেক অনেক সহজ ইস্যু। এখানে কি মুসলিম বিশ্ব কিংবা আরব বিশ্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে? তারা এখনো উদ্বাস্তু এবং বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা এটি বহন করছে এবং দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা (আরব বিশ্ব) অবশ্যই তাদের মতো করে ভূমিকা পালন করছে। তারা কি পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে? না, সেটা তারা করছে না। তারা কাজ করছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ-আমেরিকাসহ বিভন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে, একে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। ফিলিস্তিনি মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট। এমনটা এর আগে ঘটেনি। একেবারেই নতুন কিছু হচ্ছে। এটা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাপ্য। কারণ তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার মূল্যটা বেশ ভারি। যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ, দুর্দশা ও নির্যাতন ফিলিস্তিনের মানুষ সহ্য করছে, তারা এমন একটি সংহতি পাওয়ার প্রকৃত হকদার। 

গোটা বিশ্বের মানুষ এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করছে। তারা বুঝতে পেরেছে, ইসরায়েলের এ হামলা শুধু ফিলিস্তিনের বিপক্ষে নয়, এটা মানবতা ও ন্যায়ের বিপক্ষে এবং এ কারণে মানবতা কলঙ্কিত হচ্ছে। 

আমেরিকার মানুষ তাদের সরকারকে প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় তোমার মানবতা, কোথায় তোমার নীতি-আদর্শ, কোথায় তোমার নৈতিকতা ও মোরালিটি? তোমরা আমাদের যেসব নীতি ও মানবতার কথা বলেছ, তা কি শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য? আমরা কি সেসব নীতির পক্ষে অবস্থান নেব?’ সুতরাং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন এবং এমন কাজ চালু রাখতে আমরা তাদের আরও উৎসাহিত করি। 

বাংলাদেশের জনসাধারণকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বাংলাদেশের জনগণ যে আন্দোলন-সংহতি বাস্তবায়ন করছে, তা খুব দারুণ। আশা করি, বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই কাজ করবে। ফিলিস্তিনি মানুষের সমর্থনে এগিয়ে আসবে এবং আশা করি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এ সংহতি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। 
 
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন?

ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক অসাধারণ। এ সম্পর্ক খুবই গভীর ও আন্তরিক। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ, যাদের সরকার ও জনগণ যেকোনো ইস্যুতে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে থাকে। গত ৯ বছর ধরে আমি বাংলাদেশে বসবাস করছি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ এবং যে মানের সাহায্য-সহযোগিতা ফিলিস্তিন গ্রহণ করেছে, আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি এবং আমি এর প্রধান সাক্ষী। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বীকৃতি পত্র পাঠিয়েছিল। যদিও সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য এ স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তখন ফিলিস্তিনের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু।

বর্তমানে সবাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, ফিলিস্তিনের যুদ্ধের বিষয়টি কেবল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবন্ধ নেই; বরং এটা ভালো ও মন্দের মধ্যকার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই ভালোর পক্ষে থাকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং আশা করি থাকবে। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ফিলিস্তিনে যেসব সহযোগিতা পাঠানো হচ্ছে, আদৌ কি তা সেখানে পৌঁছে?

ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমরা প্রথমবার বিপুল পরিমাণ ওষুধ এবং পরবর্তী সময়ে শুকনো খাবার সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং কায়রোয় থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তা গ্রহণ করে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের এ সাহায্য ফিলিস্তিনের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এগুলো হস্তান্তর করা, পৌঁছানো, বিতরণ, রান্না করা এবং খাওয়ার অনেক ভিডিও রয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা পেছনে রেখে সাহায্য গ্রহণ করার সময় শিশুরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে- এমন ভিডিও রয়েছে। 

এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও বহু মানুষ এবং অনেক সংগঠনের কাছ থেকে আমরা বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি। গত রমজানেও আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে ইফতারের সহযোগিতা গ্রহণ করেছি এবং যথাযথভাবে তা ফিলিস্তিনে পৌঁছিয়েছি। তবে সমস্যা হচ্ছে, যে পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছি, সব পৌঁছাতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কোনো কিছু প্রবেশ করাতে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করছে। 

গাজায় ‘বাংলাদেশ অনাথ আশ্রম’ নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে বলে আশা করি। আরও একটি খুশির সংবাদ হলো, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনিদের ফুল ফ্রি শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে সম্মত হয়েছে, যেটা ফিলিস্তিনের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। অনেক বড় সহযোগিতা। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া পেয়েছি আমরা। এ জন্য আমি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ফিলিস্তিনের প্রত্যাশা কী? 

ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই পরিষ্কার। তারা অতীতে যা করেছেন, বর্তমানে যা করছেন- এটাকে অব্যাহত রাখুন। হাল ছেড়ে দেবেন না। এ দেশের জনগণ যা করছে, তা অভূতপূর্ব। ফিলিস্তিন একে মূল্যায়ন করে। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের পাতায় এসব সাহায্য-সহযোগিতার কথা খচিত থাকবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা পড়বে এবং জানবে। ফিলিস্তিন মুক্ত হওয়ার পর, আশা করছি আমরা একদিন বাংলাদেশের এ ভালোবাসার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদান দেব।  

খবরের কাগজ: গাজায় ইসরায়েলের হামলার ক্ষতির প্রভাব কী?

ইউসুফ রামাদান: এ হামলার ক্ষতির প্রভাব অবর্ণনীয়। আমি আগেই বলেছি, গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। কীভাবে আমরা এগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব? এগুলো পুনর্নির্মাণ করতে বহু অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু ফিলিস্তিনের সে সামর্থ্য নেই। ফিলিস্তিনের আর্থিক সক্ষমতা এমনিতেই কম। এ হামলা ও যুদ্ধের ফলে তারা আরও পঙ্গু হয়ে গেছে। 

ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ধ্বংস হওয়া জনপদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ফিলিস্তিনের যেহেতু এ সামর্থ্য নেই, সুতরাং সারা বিশ্বের সহযোগিতা প্রয়োজন। 

এ যুদ্ধ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ জনপদ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কেউ সহযোগিতাও করবে না। কারণ আজকে নির্মাণ করলে কালকে যে আবার ইসরায়েল তা ধ্বংস করে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।    

খবরের কাগজ: গাজায় আপনার কি কোনো আত্মীয় রয়েছে? 

ইউসুফ রামাদান: সরাসরি রক্তের সম্পর্কের কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমার একজন জামাতা রয়েছে সেখানে। যুদ্ধের প্রথম তিন সপ্তাহে সে তার পরিবারের ৫৯ সদস্যকে হারিয়েছে। আর আমি গাজার অধিবাসীও নই। আমি ফিলিস্তিনের অন্য অংশের অধিবাসী। ফলে গাজায় আমার সরাসরি কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, গাজায় যত ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং বর্তমানে যত মানুষ জীবিত রয়েছেন, সবাই আমার আত্মীয়। তাদের কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ আমার বোন, কেউ ভাই, কেউবা ছেলে কিংবা মেয়ে। তারা সবাই আমার পরিবারের সদস্য।

খবরের কাগজ: ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনে হামলা চালাচ্ছে? এখানে কি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণ জড়িত? মূলত কি কারণে তারা হামলা চালাচ্ছে বা যুদ্ধ করছে? 

ইউসুফ রামাদান: তাদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। লুকানোর কিছু নেই। ৭৬ বছর ধরে যার জন্য তারা যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেটা হলো- ফিলিস্তিনের পুরো ভূখণ্ড তারা দখলে নিতে চায়। পুরো ভূমি দখল করার পর তারা ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গঠন করতে চায়। অন্য সব কারণ গৌণ। এটাই মূল বা প্রধান কারণ। নেতানিয়াহুর মতো কিছু কট্টরপন্থি ইহুদি এ মিশন বাস্তবায়নে জড়িত। এই মিশনের অংশ হিসেবে এখন তারা যেকোনো মূল্যে গাজার জনসাধরণকে ভূমিছাড়া করতে চাচ্ছে। গাজাকে খালি করে এটা দখল করবে এবং তাদের ‘বৃহত্তম ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ সম্পন্ন করবে, এটাই তাদের উদ্দেশ্য। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের এ মিশন কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে দেবে না। তারা তাদের জন্মভূমি রক্ষায় আমরণ লড়াই করে যাবে। ফিলিস্তিনি মানুষের দেশপ্রেম ও সাহসিকতা বিশ্বের মানুষকে বিস্মিত করেছে। 

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি ফিলিস্তিনিদের মতো ত্যাগ স্বীকার করেনি। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনভাবে এখানে জন্মেছে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার তাদের আছে। কেউ তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার রাখে না। তারা সৃষ্টিকর্তার দাস। নেতানিয়াহু, বাইডেন কিংবা অন্য কারও দাসত্ব করার জন্য তাদের জন্ম হয়নি। 

খবরের কাগজ: অনেকে বলেন, ‘হামাস ও ফাতাহ গ্রুপে বিভক্ত থাকা এবং শক্তিশালী বিশ্বস্ত নেতা না থাকার কারণে ফিলিস্তিনের এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না’- এ মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখেন? 

ইউসুফ রামাদান: ইয়াসির আরাফাত কি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত নেতা ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তো তখন এ সমস্যার সমাধান হলো না কেন? ১৯৯০ সালে মাদ্রিদ থেকে তিনি এ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং ২০০৪-এ এসে মারা যান। ১৪ বছর চেষ্টা করে তিনি কী পেয়েছেন? তখন তো হামাস ছিল না, ফাতাহও ছিল না। আমরা তখন একসঙ্গে ছিলাম। দেখুন, এটা ইসরায়েলের ছড়ানো একটি অজুহাত মাত্র। প্রোপাগান্ডা। তারা বলে বেড়ায়, ফিলিস্তিনিরা দেশ গড়তে পারবে না, কারণ তারা বিভক্ত। আমার দৃষ্টিতে, তারা (হামাস ও ফাতাহ) উভয়ই একই ভিশনে কাজ করছে। তারা উভয়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়। তবে দুই পক্ষের পন্থা ও চিন্তা আলাদা। কিন্তু ভিশন এক। স্বাধীন রাষ্ট্র চায় তারা। 

ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে বিভক্ত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং আমেরিকা তাকে এ কাজে মদদ দিচ্ছে। আশার কথা হলো, বর্তমান পৃথিবী বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে।

খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী? আপনি কি কোনো আশার আলো দেখছেন?

ইউসুফ রামাদান: অবশ্যই, সব সময় আশা ছিল, আছে এবং থাকবে। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আশাবাদী না হলে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা মুসলিম। আপনি জানেন, মুসলিম মানে কী? ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না।’ হতাশ হওয়া যাবে না। সব সময় আল্লাহর ওপর আশা-ভরসা রাখতে হবে। আপনি যদি এই আশা হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনি মানবতাকে হারিয়ে ফেলবেন। 

আমরা আশার ওপর বেঁচে থাকি, আশা নিয়েই অগ্রসর হই। আর এ কারণেই ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা বেঁচে আছে। নইলে আমরা অনেক আগেই অনেকের মতো হারিয়ে যেতাম। ফিলিস্তিনিরা ব্যতিক্রম। আল্লাহর ওপর আমাদের শক্ত বিশ্বাস আছে। আমাদের যা করার আছে, আমরা তা করছি- মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য স্বাভাবিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যা ভালো মনে করেন, তার ফয়সালা করবেন। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি দৃঢ়ভাবে এমনটা বিশ্বাস করে।

খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ। 

ইউসুফ রামাদান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।  

অবস্থা এবং ব্যবস্থার বদল ছাড়া মুক্তি নেই

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০২:১৯ পিএম
অবস্থা এবং ব্যবস্থার বদল ছাড়া মুক্তি নেই
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

উদারনীতিকরা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু সংস্কারে যে কুলাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। নাট্যকার হেনরিক ইবসেন ‘বুনো হাঁস’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সেই ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৪১ বছর আগে। নাটকটিতে ওই সময়েই পুঁজিবাদ কীভাবে কাজ করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন। নাটকে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী প্রতারণাব্যবস্থার শিকার হচ্ছে একডাল পরিবার। বৃদ্ধ একডাল ব্যবসা করতেন তার বন্ধু ওয়ারলের সঙ্গে। ওয়ারল খাঁটি পুঁজিবাদী। সে নেমেছিল কাঠকাটার অবৈধ ব্যবসায়; কাজটা ধরা পড়ে যায়। মামলা হয়। ওয়ারলের ছিল প্রচুর টাকা; টাকার জোরে সে খালাস পেয়ে যায়, কিন্তু ১০ বছরের জেল হয় একডালের। একডালরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, টাকাওয়ালা ওয়ারল লোকটা ছিল ভীষণ ভোগবাদী; সে তার গৃহপরিচারিকা জীনার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। জীনা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় একডালেরই ছেলে হেলমারের সঙ্গে। জীনা একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। জীনার স্বামী হেলমার একডাল যে কন্যাটির জৈব-বাবা নয়, এটা সে খোঁজ নিলেই জানতে পারত। কিন্তু খোঁজ হেলমার নেয়নি। তার বসবাস ছিল স্বপ্নের জগতে। জীনা এবং কন্যাটিকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। পেশা ছিল ফটোগ্রাফারের। স্বপ্ন ছিল একটি ফটোগ্রাফির যন্ত্র উদ্ভাবনের, যাতে তাদের সংসারে প্রচুর টাকা আসবে, পরিবারের জন্য আসবে সম্মান ও সুখ। কিন্তু হেলমারের বাল্যবন্ধু ওয়ারলের একমাত্র সন্তান গ্রেগারস বাবার কীর্তিগুলো ধরে ফেলেছিল। 

এই ছেলে বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করে, বন্ধু হেলমারকে সে গভীরভাবে ভালোবাসে। সে আদর্শবাদী এবং সংস্কারপন্থি। সে চাইল অন্তরের বন্ধু হেলমারকে মিথ্যার জাল থেকে উদ্ধার করবে, সত্য ধরিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ বোঝাবুঝির ওপর বন্ধুর দাম্পত্যজীবনের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। তাই একদিন সে তার বন্ধু হেলমারকে ডেকে নিয়ে জীনার সন্তান সম্পর্কে ‘সত্য’টা জানিয়ে দিল। ফল দাঁড়াল এই যে, হেলমারের কষ্ট-করে-সাজানো সংসারটা গেল ভেঙে, হেলমারের অবস্থাটা দাঁড়াল অর্ধউন্মাদের; সে তার অত্যন্ত আদরের কন্যাটিকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে দিল। স্ত্রীকে অসৎ বলে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করল। ১৪ বছর বয়সের কন্যাটি বুঝতে পারল না কী ঘটেছে, কেন ঘটছে, কিন্তু টের পেল যে তার বাবা তাকে আর ভালোবাসে না, সহ্যই করতে পারে না। মেয়েটির সন্দেহ হলো হয়তো সে তার বাবা-মায়ের সন্তান নয়, মা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছে। হঠাৎ-জাগা উপলব্ধিতে অসহায় মেয়েটি আত্মহত্যা করে বসল। বাবার অকৃত্রিম বন্ধুর সংস্কারচেষ্টার সবটা ভার গিয়ে পড়েছিল নিরুপায় কন্যাটির ওপর, যেটা বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। নষ্ট বাবা ওয়ারল টাকার জোরে যে পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, উপকার করতে গিয়ে আদর্শবাদী ছেলে তাদেরই দিল ছিন্নভিন্ন করে। 

বিখ্যাত এ নাটকটির নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে; কিন্তু এর বক্তব্যটা খুবই সুস্পষ্ট যে, নষ্ট বাবার আদর্শবাদী ছেলে গ্রেগারস বন্ধুর পরিবারে সংস্কার ঘটাতে গিয়ে যা ডেকে আনল তা ভয়াবহ বিপর্যয় ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে পরিণতিটা এর চেয়ে ভালো হওয়ার নয়। গ্রেগারস তার বন্ধু হেলমারের উপকার করতে পারত সংস্কারের পথে না গিয়ে, আর্থিকভাবে সাহায্য করে, সে সামর্থ্য তার ছিল। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রাকৃতিক জগৎকে পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করার পরে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দিতে, হস্তক্ষেপ না ঘটাতে; পুঁজিবাদীরা সে পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তারা প্রকৃতিকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করেছে, যার পরিণতি হচ্ছে বর্তমান দুরবস্থা। বিপদ বহুবিধ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা নিয়েও। খবরে জানা যাচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ওই বৃদ্ধি গড়পড়তা বৃদ্ধির তুলনায় অধিক।

মেডিকেল পড়ার জন্য বিদেশি ছাত্ররা আসত; কিন্তু তাদের সংখ্যা বর্তমানে ব্যাপকহারে নেমে এসেছে। ফলে ২ হাজার কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা আয় হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১০ মাসে গণপিটুনিতে মব ভায়োলেন্সে মৃত্যু ঘটেছে অসংখ্য মানুষের। বজ্রপাতে মৃত্যু তো আছেই; বাড়ছেই; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু। কবরের কংকালরা পর্যন্ত নিরাপদে নেই, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সশরীরে উপস্থিত না থেকে কাজ করা উপার্জনের একটি উপায় ফ্রিল্যান্সিং। বাংলাদেশিরাও ওই ফ্রিলান্সিংয়ে আগ্রহী। কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না। জানা গেছে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান এখন ২৯তম। লজ্জা ও হতাশার খবর হয়ে দাঁড়ায় যখন জানা যায় যে, বিগত সরকারের তিনবার নির্বাচিত একজন এমপি কলকাতায় গিয়ে খুন হয়েছেন তারই ঘনিষ্ঠতম ব্যবসায়ী বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় এবং ব্যবসাটা ছিল হুন্ডির এবং স্বর্ণ চোরাচালানের। আমাদের একজন সাবেক সেনাপ্রধান দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হবেন এবং পুলিশের একজন সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করতে বাধ্য হবে এ খবরও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। 

অধিকাংশ মানুষেরই আয় যে কমেছে, এ বাস্তবতাও বিষণ্নতার সৃষ্টি করে; বিশেষ করে এ কারণে যে, উন্নতি হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এ নিয়ে অভিযোগ তো আমরা করেই আসছি। স্বাধীনতার পরে দেশের শিল্পকারখানাগুলোর রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল। ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, রাষ্ট্রীয় খাতটাই প্রধান হবে। পরে সে নীতিতে পরিবর্তন ঘটেছে, ব্যক্তিমালিকানাই প্রধান হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি মালিকানার তৎপরতার ক্ষেত্রে বড় জায়গাটা হওয়ার কথা ব্যবসা। ব্যবসা এখন চলে গেছে সিন্ডিকেটের হাতে। ছোট ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারছেন না। কেউ কেউ ভীষণ বিপদে পড়েছেন। 

এমন একজনের কথা বের হয়েছে পত্রিকায়। নাম তার আরিফুল। বয়স বেশি নয়। অল্পবয়সেই সে উপার্জনে বের হয়েছিল। প্রথমে সে বাসাবাড়িতে আসবাবপত্র পরিবহনের কাজ করত। এর পরে এক বন্ধুর পরামর্শে ইট-বালু-পাথর সরবরাহের ব্যবসা শুরু করল। বিপদটা ঘটল তখনই। পুঁজি ছাড়া চলে না, তাই সে ঋণ করল। কিন্তু ব্যবসাটা জমল না। এক সময়ে দেখল সে ১৪-১৫ লাখ টাকা ঋণ করে ফেলেছে। পাওনাদারদের তাগাদায় সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাধ্য হলো আত্মগোপন করতে। নিরুপায় আরিফুল একপর্যায়ে ভেবেছিল দুটি কিডনির একটি বিক্রি করে ঋণ শোধ করবে। কিন্তু গ্রাহক খুঁজে পায়নি। শেষমেশ ঠিক করল ব্যাংকের এটিএম বুথ ভেঙে টাকা সরাবে। ইউটিউবে সে ছবি দেখেছে, ধারণা পেয়েছে কাজটা কীভাবে করা যায়। উদ্ভ্রান্ত আরিফুল যন্ত্রপাতি কিনল। বুদ্ধি খাটিয়ে নির্জন এলাকায় একটি এটিএম বুথকে সে চিহ্নিত করল এবং ঈদের আগের রাতে কাজটায় ব্রতী হলো। কিন্তু নিরাপত্তা প্রহরী তো ছিলেন। তিনি বাধা দিলেন। আরিফুল তার হাতের ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীকে আঘাত করল। তিনি মারা গেলেন। আরিফুল তখন কী করবে? ভোর হয়ে এসেছে; বাস চলাচল শুরু হয়েছে, চলমান একটি বাসে উঠে সরে পড়ল। কিন্তু সে তো ধরা পড়বেই। ধরা পড়েছেও। আরিফুল সেই কাজই করতে গিয়েছিল ঋণের নাম করে বড় বড় ব্যাংক-ডাকাতরা যা হামেশাই করে থাকে এবং নির্বিঘ্নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার একটা দিক। এটিও কোনো ছোট বিপদ নয় যে, কোটিপতির সংখ্যা যদিও অবিশ্বাস্য রকমে বেড়েছে কিন্তু লোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছে না। শেয়ার মার্কেট প্রাণহীন। লোকে সঞ্চয়পত্র যত কেনে, ভাঙায় তার চেয়ে অধিক সংখ্যায়। একটি দৈনিক সংবাদ-শিরোনাম করেছে ‘বিনিয়োগকারীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে’।

সরকারি চাকরি হচ্ছে সবচেয়ে লোভনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো এখন মনে হচ্ছে যে, পরিণত হয়েছে চাকরির জন্য প্রস্তুতির কর্মশালায়। ওদিকে আবার এমন খবরও পাওয়া যায় যে, চাকরি আছে, কিন্তু প্রার্থী নেই। যেমন এই খবরটি: ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ ৯৬ হাজার, আবেদন মাত্র ৬৪ হাজার’। আবেদন করার মতো আগ্রহী মানুষ কী দেশে নেই? সেটা তো অবিশ্বাস্য। দেশে শোনা যাচ্ছে জটিলতা এমন যে আবেদন করাই কঠিন। সে জন্য ওই শূন্যতা। 

সব মিলিয়ে ছবিটা বিষণ্নতার। জগৎজুড়েই এখন বিষণ্নতা। এর প্রধান কারণ পুঁজিবাদী উন্নয়ন ব্যবস্থাটা বদলাবার চেষ্টা নেই। অথচ পুঁজিবাদের দুর্বৃত্তপনা লম্ফঝম্প দিয়ে বাড়ছে। তাই হতাশা এবং হতাশা থেকে বিষণ্নতা। ব্যবস্থাটা বদলাবার জন্য প্রথম প্রয়োজন ব্যবস্থাটাকে ঘৃণা করা। ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই, সমষ্টিগতভাবেও। ঘৃণা দরকার ভালোবাসার প্রয়োজনে। ভালো ব্যবস্থার প্রতি ভালোবাসার কারণেই নষ্ট ব্যবস্থাটাকে প্রত্যাখ্যান করা চাই। সে জন্যই প্রশ্নটা থাকে: মানুষ কী এ ব্যবস্থাকে ক্ষমা করে দিয়েছে; যে প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথ একদা করেছিলেন। ক্ষমা করে দিলে আর যা-ই ঘটুক, মুক্তি আসবে না; এবং ব্যবস্থা ও অবস্থা দুটোই আরও খারাপ হতে থাকবে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পরিবেশ ও প্লাস্টিকের লড়াই

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
পরিবেশ ও প্লাস্টিকের লড়াই
ড. এম এ ফারুখ

রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালন করা হয়। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন ইতিহাসের প্রথম পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আলোকেই ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছরই দিবসটি বর্ণিল আকারে পৃথিবীব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত এবং ২০১০ সালে এ দিবসটি পালনের আয়োজক দেশ ছিল বাংলাদেশ।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করা’, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্লাস্টিকদূষণ একটি বৈশ্বিকসংকট, যেটি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ প্রতিপাদ্য বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকদূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। ২০২৫ সালের ৫ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে এ দিবসটি উদ্‌যাপিত হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ‘২০৪০ প্লাস্টিক জিরো দ্বীপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০৪০ সালের মধ্যে একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ, উন্নত বর্জ্যব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। জেনেভা এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে প্লাস্টিকদূষণের বৈশ্বিক চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর ৪৩০ মিলিয়ন টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার দুই-তৃতীয়াংশ স্বল্পস্থায়ী পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় ও দ্রুত বর্জ্যে পরিণত হয় এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের হার মাত্র ৯ শতাংশ, বাকি অংশ ল্যান্ডফিলে জমা হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয় বা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর প্রায় ৮ থেকে ১১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকবর্জ্য সমুদ্রে প্রবেশ করে প্রবাহমান নদীগুলো থেকে, যার বেশির ভাগই এশিয়া ও আফ্রিকার মাত্র ১০টি নদী থেকে আসে। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি মিনিটে সাগরে পতিত হওয়া প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার ৮০০টি। প্রতি বছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেলের মতো তেলের দরকার হয়। শুধু ১ কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে ২ থেকে ৩ কেজি পরিমাণ বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়; যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিকবর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে এবং বিগত ৫০ বছরে সমগ্র পৃথিবীতে জনপ্রতি এক টনের বেশি প্লাস্টিকদ্রব্য উৎপাদিত হয়েছে। পরিবেশগত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে প্লাস্টিক সমুদ্রে শত শত বছর ধরে অবিকৃত ও অবিচ্ছিন্ন থাকে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে এবং রূপান্তরিত মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে। মানবস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর প্লাস্টিকদূষণের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে ইউএস এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি বলছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহের রক্ত, যকৃত এবং প্লাসেন্টায় পাওয়া গেছে, যা ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা এবং স্নায়ুতন্ত্রের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। প্লাস্টিকদূষণ প্রতি বছর সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির কারণ হয়। 

প্লাস্টিক একটি বহুল ব্যবহৃত উপাদান হলেও এর যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপচনশীল প্রকৃতির কারণে এটি এখন একটি বৈশ্বিক দূষণসংকটে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশও এ সংকট থেকে মুক্ত নয়। নদী, শহর, গ্রাম এমনকি কৃষিজমিতেও প্লাস্টিকবর্জ্য জমে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ২০০৫ সালে যেখানে ঢাকায় একজন নাগরিক বার্ষিক গড়ে ৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করতেন, ২০২২ সালে তা বেড়ে ৯ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে উৎপাদিত প্লাস্টিকবর্জ্যের মাত্র ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়, বাকিটুকু পরিবেশে পড়ে থেকে দূষণ সৃষ্টি করে। প্লাস্টিকবর্জ্য বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ও প্যাকেজিংসামগ্রী দেশের প্রধান নদীগুলোয় পড়ে জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলছে, ড্রেন ও নর্দমা বন্ধ করে দিয়ে নগরজীবনে ব্যাপক জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের নদীর পানি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক বিদ্যমান, যা মানবদেহে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। আবার, উন্মুক্তভাবে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, যা শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার এবং শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বর্তমানে সমুদ্রে আনুমানিক ৭৫ থেকে ১৯৯ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পাওয়া যায়, যা সমুদ্রে প্লাস্টিকদূষণের মাত্রাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর মহাসাগরে কোটি কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রবেশ করছে। এ সংকট বিশ্বের প্রতিটি কোনে পৌঁছে গেছে, সবচেয়ে দূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে গভীর সমুদ্রের খাঁজ পর্যন্ত যেখানে প্লাস্টিকের আবর্জনা সামুদ্রিক জীবন, বাস্তুতন্ত্র এবং এমনকি মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এসব আবর্জনার একটি বৃহৎ অংশ জমা হচ্ছে হাওয়াই এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যে অবস্থিত প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচে, যা আয়তনে টেক্সাসের প্রায় দ্বিগুণ। প্লাস্টিক সামুদ্রিক আবর্জনার প্রায় ৮০ শতাংশ গঠন করে যা পৃষ্ঠের জল থেকে গভীর সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত পাওয়া যায়। ইকোড্রাইভ কমিউনিটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিকদূষণের কারণে মারা যায়। এ ছাড়া প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিকদূষণের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে, ১২৩টি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে ৮১টি প্লাস্টিক খাওয়া বা তাতে জড়িয়ে পড়ার জন্য পরিচিত এবং কচ্ছপ প্রজাতির সবগুলোই এতে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। সমুদ্রে বিদ্যমান প্রায় সাতটি সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রজাতির প্রতিটিই জেলিফিশ ভেবে প্লাস্টিককে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। সমুদ্রে প্লাস্টিক যোগের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে ওজনের দিক থেকে মাছের চেয়ে বেশি প্লাস্টিক থাকবে বলে অনুমান করা হয়। বর্তমানে ১১৪টি জলজ প্রজাতিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যার মধ্যে কিছু মানবখাদ্য চেইনেও বিরাজমান। বর্তমানে জীবিত প্রায় ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখির পেটে প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে, যা তারা সমুদ্রে প্লাস্টিক খাওয়ার কারণে প্রবেশ করছে। হারিয়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়া মাছ ধরার সরঞ্জামের মাধ্যমে মৎস্য আহরণশিল্প সমুদ্রের প্লাস্টিকদূষণের প্রায় ১০ শতাংশ দায়ী। বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ১ মিলিয়নেরও বেশি প্লাস্টিক বোতল কেনা হয়, যা প্লাস্টিকবর্জ্যের একটি বড় উৎস। উৎপাদিত প্লাস্টিকের প্রায় ৫০ শতাংশ শুধু একবার ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নামে পরিচিত এবং উল্লেখযোগ্য বর্জ্য উৎপাদন ও পরিবেশগত প্রভাব সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে চলেছে।  

ভয়াবহ প্লাস্টিকদূষণের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় জাতিসংঘের ইউএনইপি ২০২২ সালে একটি বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা ২০২৫ সালে চূড়ান্ত হবে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসাধারণকে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকপণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে জৈব-বিনাশযোগ্য প্লাস্টিক ও বিকল্প পণ্যের উন্নয়ন সাধন করা। এ শঙ্কাজনক পরিসংখ্যান সত্ত্বেও সমুদ্রে প্লাস্টিকসংকট মোকাবিলায় পৃথিবীব্যাপী ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দ্য ওশান ক্লিনআপ প্রকল্প বিশ্বজুড়ে সমুদ্র থেকে ১৬ মিলিয়ন কিলোগ্রামেরও বেশি প্লাস্টিক সফলভাবে অপসারণ করেছে। এ প্রচেষ্টা সমুদ্রের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথমবারের মতো পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। বর্তমানে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধে খসড়া নীতি প্রণয়নাধীন, তবে এর যথাযথ বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাব বড় চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু, প্লাস্টিক কর ও এক্সটেন্ডেড প্রডিওসার রেস্পনসিবিলিটি চালু করা, রিসাইক্লিংশিল্পে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি করা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বাড়ানো এবং প্রচারণা চালানো, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে সচেতনতামূলক শিক্ষা চালু করা, পাটের মতো পরিবেশবান্ধব বিকল্প উপকরণের ব্যবহার প্রসার করা যেতে পারে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৫ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্লাস্টিকদূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ে পর্যায়ে সচেতনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি প্লাস্টিকমুক্ত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]

প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হলে রাজস্ব বাড়বে

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:৫২ পিএম
প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হলে রাজস্ব বাড়বে

রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না, ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে।…

২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট তুলনামূলক ভালো হয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আকার বেড়েছে; যা এডিপির তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। রাজস্ব নিয়ে আমাদের আগে থেকেই আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। দেশের অর্থনীতির সংস্কারের দিকে আমাদের আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আগের সরকার নির্বাচনের নামে নানারকম প্রহসন করেছে।

 ফলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কাজেই গণতন্ত্রের নামে আমরা এখনো যদি বিভাজন করি, তাহলে কোনোভাবেই সামনে এগোনো সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, সবারই নজর আগামী নির্বাচনের দিকে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে সবার মধ্যেই একটা মতানৈক্য হয়েছে। কাজেই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন হলেই দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন।

আমরা জানি, বিগত সময়ে আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে প্রায় ধ্বংসের মধ্যে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলো লুটপাটের কারণেই আর্থিক খাতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারেও। দেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।

 ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্যসংকট, দেউলিয়া বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি- এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ব্যাংকগুলোকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে মাফিয়া গ্রুপ। এ সরকারের সময় আর সে সুযোগ নেই। এদের বিচারের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। 
এবারের বাজেটে শেয়ারবাজারকে পুনরায় চাঙা করে তুলতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মধ্যকার করপোরেট করহারের ব্যবধান বৃদ্ধি এবং ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর ধার্য কর কমানো। এসব প্রণোদনার সুবিধাভোগী শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিনিয়োগকারীরা কোনো সুবিধা পাবেন না।

 যদিও বাজেটের আগে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ আয় থেকে শুরু করে মূলধন মুনাফার ওপর থেকে কর প্রত্যাহারের জন্য দাবি জানানো হয়েছিল। আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করি, তার ৭০ শতাংশই রাজস্ব বাজেট। এর কারণ হলো, আমাদের অর্থনীতির তুলনায় বিশাল আকারের সরকার নিয়ে আমরা বসে আছি। এখন এ বিশাল আকারের সরকারকে চালাতে হলে জনগণকে কর দিতে হবে। সরকার দক্ষ না হলে দেশের অর্থনীতিকেও দক্ষ মাত্রায় আনা যাবে না। বড় অর্থনীতির দেশ অথচ সরকারের পরিধি অনেক ছোট, এমন অনেক দেশ আছে। তারা পারছে। কাজেই আমাদেরও সেটা পারতে হবে। বাজারে কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটি লোকসানি শিল্পকে কেন সরকারের মধ্যে রাখতে হবে?  আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতো না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যতটুকুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে এবং সেটা রোধ করতে হবে।

 রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না, ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে আমরা দেখছি না। সরকারের পরিধি বা আয়তনটা ছোট করতে পারলে, সেটা সবচেয়ে বড় কাজ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে, সরকারের আকার ছোট করা যাবে না। সুতরাং সরকারের আয়-ব্যয়ের সমন্বয়হীন অসম আকার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবেই।

বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজার নিয়ে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়েছে। বড় সব জুয়াড়ি সরকারের পৃষ্ঠপোষতায় স্টক মার্কেট থেকে টাকা নিয়ে গেছে। কোম্পানির লাভ নেই, কিন্তু সেগুলো বাজারে রেখে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই।  কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া- সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি কেন একটি লোকসানি শিল্পকে, যেটা দিয়ে কিছু হবে না সেটাকে কেন সরকারের মধ্যে রেখে দিয়েছি। আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। 

আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যা কিছুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে আমাদের এবং সেটা রোধ করতে হবে। পুঁজিবাজারকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা, কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি কেউ হিসাব গোপন করে কি না, এগুলো যাচাই করে দেখা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পুনরায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে। 

লেখক: অর্থনীতিবিদ

বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:৪৫ পিএম
বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া।...

বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা কমেছে। বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার যে বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শিক্ষা খাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। খরচ করা ওই টাকার পরিমাণ ছিল সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশ। অথচ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। শিক্ষামানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমার বিষয়টি কিছুটা হতাশার। কারণ যেকোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হলো ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কীভাবে আশা করব?

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে শুধু ভবিষ্যতের মানবসম্পদই গড়ে তোলা হয় না; একই সঙ্গে জাতির উন্নয়ন কাঠামোর ভিত্তিও নির্মিত হয়। আজকের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে জনশক্তিকে দক্ষ ও উপযোগী করে তুলতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে উন্নত বিশ্ব এই বিনিয়োগ শুধু জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশগুলো কীভাবে শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়ে জাতীয় উন্নয়নে ব্যবহার করছে, তা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, এ নীতি কেবল একটি খাত নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গতিশীল করার মূল হাতিয়ার। 

জার্মানি পৃথিবীর অন্যতম উদাহরণ, যারা ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম’-এর মাধ্যমে শিক্ষাকে সরাসরি কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এখানে শিক্ষার্থীরা স্কুলে পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের বাজেটে বিশাল অংশ বরাদ্দ থাকে এ কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। জার্মান সরকার প্রতি বছর শিক্ষা খাতে প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে, যার বড় অংশ পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষায়। ফলে জার্মানির যুব বেকারত্বের হার ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন ২০২৪ সালে যা ছিল মাত্র ৫.৭ শতাংশ। এখানকার শিক্ষার্থী মাত্র ১৮ বা ১৯ বছর বয়সেই চাকরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং শিল্পক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে।

ফিনল্যান্ড সরকার বিশ্বাস করে, শক্তিশালী জনশক্তি গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হলো মানসম্পন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। ফলে ফিনল্যান্ডে ১৫-২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত। এ ধারাবাহিকতা দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করেছে এবং উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় ফিনিশ যুবসমাজের অংশগ্রহণ অনেক বাড়িয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার উঠে আসার অন্যতম রহস্য শিক্ষায় অগ্রাধিকার। ১৯৬০ সালে যেখানে দেশটির সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৯৯ শতাংশে। বর্তমান বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়। সরকার শিক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। এ বিনিয়োগ সরাসরি ফল দিয়েছে: স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই-এর মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে দক্ষ কোরিয়ান কর্মীর মাধ্যমে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কোরিয়ান শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাহিদা ক্রমবর্ধমান।

কানাডা শিক্ষা খাতে প্রতি বছর গড়পড়তা ৪০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেয়। দেশটির বিশেষত্ব হলো- শিক্ষাকে তারা শুধু জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখেই না, বরং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, অভিবাসী- সবার জন্য উচ্চশিক্ষায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে।

ফলস্বরূপ, কানাডায় বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মানুষ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। এখন কানাডার অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মী।

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া। বাংলাদেশ যদি এ দিকগুলো মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করে, তাহলে কর্মসংস্থানের সংকটও কমবে এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত হবে দৃঢ়ভাবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের প্রসঙ্গটি কীভাবে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব হবে তা খুঁজে দেখার ন্যায্যতা অনেক বেশি। বেকারদের আগামীর জীবন অনিশ্চয়তা থেকে কাটিয়ে তুলতে কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক ভাবনা অধিকভাবে বাড়ানোর ন্যায্যতা অতিমাত্রায় অনুভূত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশার বাণী হলো, দেশের উন্নয়নে তরুণদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদ্যাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। 

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এমন তহবিল এবারই প্রথম।’ আমরা জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই তরুণ। যারা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশাল এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন নীতি থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি।

শুধু তরুণ উদ্যেক্তাদের জন্য নয়, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কীভাবে শিক্ষা কাঠামোকে কর্মসংস্থানমুখী করে তোলা যায়- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানোর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য বাজেটের প্রসঙ্গ নিয়ে পুনরায় ভেবে দেখার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট কাটিয়ে উঠতে কীভাবে শিক্ষাব্যস্থাকে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব করে তোলা যায়- সে বিষয়ে একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বরাদ্দের বিষয়টি বিশেষভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



নয় নম্বর নাটকীয়তা

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:১৮ পিএম
নয় নম্বর নাটকীয়তা


২০২৫-২৬ এর নয়া বাজেট প্রণয়ন ও পাঠপর্ব যখন চলছে তখন সকাল থেকে মুখ ভার করে আছে আকাশ। সাগরের পানিও অস্থিরমতি। শুকলাল বৈদ্যের ট্রলার এখন দক্ষিণ তালপট্টি থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে। পনেরো দিন হলো সে সাগরে আছে একটানা। মহাজনের টাকা তোলার মতো মাছ হলেই সে মাটিতে ফিরতে পারে। মাছের আকাল। লাভের আশা আর নেই। মহাজনের টাকা শোধ হলেই সে বেঁচে যায়। রমজাননগরের শুকলাল ও ফকিরচান আর আড়মগাছার আরজান মোড়ল- এরা সবাই একসঙ্গে পাস নিয়ে সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে সাগরে নেমেছে ভালো মাছ পাবে, এ আশায়। 

গেল খেপে তাদের লাভ হয়েছিল ভালোই। বাড়িতে মাস দুয়েকের খোরাকি আর বউয়ের হাতে নগদ ৯ হাজার করে টাকা দিয়ে এসেছে। আসার সময় কইখালীর অমেদালী মেম্বার দাবি করেছে- তারে কিছু দেওয়া লাগবে। সে টাকা তারা কোথায় পাবে? সাগরের মাছ, বাদার মধু আর কাঠ কি অমেদালী মেম্বারদের পৈতৃক সম্পত্তি? হায়রে, কার সম্পত্তিতে কে কার ভাগ বসায়! ক্ষমতা এখন তাগোর হাতে। তাদের কাছ থেকেই পারমিট নিতে হয় আর তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরতে হয়, নজরানা না দিয়ে উপায় আছে? কথা কিন্তু সেই একই থেকে গেল। আগে জমিদারকে নজরানা দিতে হতো। এখন দিতে হয় ক্ষমতা যার হাতে। যাকে সবাই ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কারণও সোজা- জোর যার মুলুক তার। একাল আর সেকালের পার্থক্য কই? কালে কালে বড় কথার ফুলঝুরি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বুলি আওড়ানো হয় কত তন্ত্রের। আসলে সবই গরল ভেল। কর্তা ভজার দেশেই তো চলে ‘বিচার-আচার যাই বলো তাল গাছ আমার’। 

আলমপুরে আজকাল রাতে ডাইল টানে যারা, তারাও সেদিন টাকা চেয়েছে- 
‘চাচা আমাদের কথা মনে রাইখেন’।
‘আচ্ছা, বাপু।’

এসব ভাতিজা নতুন আমদামি এ জগতে। পড়াশোনা থেকে অনেক দূরে তারা। তাদের মহিলা চেয়ারম্যান আর মহিলা হেডমাস্টার দুজনেরই বিদ্যার দৌড় সবার জানা। মহিলা হেডমাস্টার আসার পর থেকে বিদ্যালয়ের বারোআনা বাজতে বাকি। হেডমাস্টার প্রতিবেশী দেশে তার স্বামী-শ্বশুর-সন্তান সব রেখে এখানে বিদ্যা বিতরণ করেন আর আখের গোছান ওপারে। বলা যায়, বিদ্যালয়ে তিনি বেড়াতে আসেন মাঝে-সাজে। ওপরে হাত রেখে খাতির পাতিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। কিন্তু ভাতিজাদের বিদ্যার দৌড় বোতল পর্যন্ত গিয়ে যে ঠেকেছে, সে কথা বলার বা ভাবার যেন কেউ নেই। হেডমাস্টারেরও বা কী এসে যায় তাতে। তিনি তো এ এলাকার কেউ নন। এখানকার ছেলেমেয়েরা গোল্লায় গেলে তার লাভক্ষতি কোনোটাই নেই। কেননা, তার ছেলেমেয়েরা বশিরহাটে বিশেষ বিদ্যালয়ে বাবার বজরায়। অথচ কত সম্ভাবনাময় এ লোকালয়। সম্ভাবনা ছাড়াও মানুষের মতো মানুষ হওয়া সবার দায়িত্ব শুধু নয়, অধিকারও।

আকাশ আর সাগর আজ মিতালি পাতিয়েছে বুঝি? ট্রলারগুলো আজ মাছ ধরার কাজে নেই। আরজান রেডিও বাজাচ্ছে। মোবাইল ফোন এখানে কাজ করে না। শুকলাল সকালে সুখটান দিচ্ছিল বিড়িতে। ফকিরচান এখনো ঘুমাচ্ছে। বেলা ১০টা বাজল বলে। অন্যদিন অন্তত একবার জাল ফেলা শেষ। 

আজকার দিনটা অবশ্য অন্য দিনের মতো নয়। মাছেরাও আজ মনে হয় অন্য মুডে আছে। বাবাহকুর মৎস্য বিভাগে আজ সকালে এক কর্মশালার আয়োজন চলছে। সেখানে ডেলিগেট হয়ে গেছে কেউ কেউ। সাগরের মাছেরা আবার প্রবাসীদের মতো প্রজ্ঞায় পয়মন্ততায় সেরা। নদীর মাছের ওপর তাদের সবাই একটু আলাদা খাতির করে। সমুদ্রের মতো বিশাল খালে বা পুকুরে বংশীয় মাছের মতো তারা চলাচল করছে। মনে মনে অহংকার তাদের। তাদের কথা কেউ জানতে চাক এ ধরনের আশা-প্রত্যাশা তাদের সবার। তারা এমন যেমন দুর্বল কারও কাঁধে বন্দুক রেখে, নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে কাজ হাসিলে যারা নিজেদের পারঙ্গম ও বুদ্ধিমান ভাবে। জাপানের মতো দেশে নদীর বা মিষ্টি পানির মাছ কেউ ধরেও না, খায়ও না। তাদের পছন্দ সমুদ্রের মাছ, আয়োডিনযুক্ত মুক্ত পানির মাছ। এর একটা বড় কারণ তারা কাঁচা মাছ বিশেষ প্রক্রিয়ায় খায়। সুতরাং বদ্ধ পানির মাছে যেসব ঘাটতি, গন্ধ কিংবা সীমাবদ্ধতা আাছে তা থেকে নিজেদেরও আলাদা করে সমুদ্রের মাছে উদার উন্মুক্ততার স্বাদ ও সৌন্দর্য উপভোগে তারা পক্ষপাতি। সমুদ্রের মাছের তাই কদর বেশি। 

দুপুরের দিকে সমুদ্রের পানির রং কেমন যেন পাল্টাতে শুরু করল। শুকলাল পুরোনো মানুষ। সে আঁচ করতে পারল সমুদ্রের ভাব ভালো নয়। ‘ভাব ভালো ঠেকতেছে না বলো’- আরজানের ট্রলারের দিকে তাকিয়ে বলল সে। ‘রেডিওতে কিছু বুলতেছে নাকি?’ আরজান মাথা নাড়ল। না কিছুই বলেনি। রেডিওতে বরং বলতেছে আকাশ পরিষ্কার, আবহাওয়া চমৎকার। 

বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরার ট্রলারের সামনে মুখ কালো করে থাকা মেঘ তো আর আবহাওয়া দপ্তরের ডিসপ্লে বোর্ডে ফুটে উঠবে না। উঠলে এভাবে চমৎকার আবহাওয়ার কথা বলা যেত না। আসলে যাত্রীরা শোনে না, জানে না যাত্রাপথের আসল হাল-হকিকত কী। হঠাৎ করে আক্রমণের মতো পথে, বাইপাসে, বাঁক বা মোড় পার হওয়ার সময় পাশের খাদে খালে পড়ে যায়, নদীর মোহনায় স্রোতের তোড়ে পড়ে তলিয়ে যায়, ঈশান কোনের মেঘ এসে মুলাদীর চরে আটকিয়ে দেয় বিশাল স্টিমার। আবহাওয়া দপ্তর ‘হতে পারে’ ‘সম্ভাবনা আছে’ ধরনের কথাবার্তা বলে ঘুমাতে যায়। রাত ১টার সময় দেখা গেল টর্নেডো ভিজিট করেছে দু-চারটি গ্রাম। রাজা ডানকানের মতো ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হয় হরেক বয়সের মানুষ। আবহাওয়া দপ্তর বলুক আর নাই বলুক, এক সময় মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরার ঝোঁক চালু হয়েছিল। 
‘কেমনে?’
নাহার জানতে চায় তার বাম থেকে ডানে আসা আঁতেল স্বামী যতি চৌধুরীর কাছে।
‘এমনে...’ বর্ণচোরাদের বন্যায় ভাসে যখন দেশ সমাজ সকাল বিকাল
কপোতাক্ষীর তীরে মোরা আর জনমের হংস মিথুনেরাও দেখে অকাল 
বেহুলারা লখিন্দরের জন্য কাটায়না নির্ঘুম রাত আর 
ফেসবুকে বিছড়ানো বন্ধুর তালাসে একাকার তার
সকল সময়... নষ্ট ভ্রষ্ট সময়ের তারে বাঁধো সুর, জাগো 
বল বাহে...’
স্বরোচিত কবিতা আউড়িয়ে চৌধুরী কখনো সলিল চৌধুরী, কখনো সৌমেন চ্যাটার্জি কখনো নুরল দীনের আসাদুজ্জামান নূর হয়ে যায়।
‘‘আরে রাখো তোমার আগর গাওয়ের আবহাওয়া অফিস। গোটা দেশের ওপর দিয়ে কত কেসমের সুনামি বয়ে যাচ্ছে জান? ফরমালিন এখন মাছে নয় আঁতেলদের চিন্তার ভেতরও ঢুকে পড়েছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলার চল চালু হয়েছে মিষ্টি শোতে সরগরমকারীদের মধ্যে। রাজনীতির ভেতর যেমন ঢুকেছে পলিটিক্স, মেহনতী জনতার মধ্যে ‘অন্যরাও’ দরখাস্ত করেই ঢুকে পড়েছে। দরবেশায়িত হয়ে পড়ছে নিরপেক্ষতার রাস্তাঘাট।’’ যতিকে থামাতে পারে না নাহার। যতির মতিগতি বোঝা ভার। ডান-বাম তো কম করল না। 

বিকেল বেলা বাতাস ছাড়ল মনে হলো। আরজান রেডিও খোলে। ‘পারে নিয়ে যাও আমায়...’ বলে একটা গান সুর মিলিয়ে শেষ হয়ে গেল। মনটা তার ছ্যাৎ করে উঠল। তার মনে হলো এ গান এ সময় কেন? বউ, ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ল তার। আড়মগাছার বড় বটগাছের তলা দিয়ে এ সময় তার মেয়ে শরীফা বাড়ি ফিরছিল স্কুল থেকে। হঠাৎ গাছের একটা ছোট ডাল ভেঙে পড়ল তার সামনে। চমকিয়ে ওঠে শরীফা। ফকিরচানের মা হনুফা বিবি তার মুরগির বাচ্চা দুটো বিছড়াচ্ছে রমজাননগরের হুলোয় তার বাড়ির উঠানে। তার হঠাৎ মনে হলো ফকিরচান কেমন আছে?

দুবলার চর থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কইখালীর ফরেস্ট অফিস থেকে ৮৫ মাইল দক্ষিণে আরজান, ফকিরচান আর শুকলালের ট্রলার। সন্ধ্যায় ঝড় উঠল। ‘রেডিও ধরতিছে না। কেম্মায় কী করব?’ তিনজন তিন ট্রলারে। কেউ তাদের বলেনি, জানায়নি চার দিন ধরে একটা নিম্নচাপ ঘুরপাক খাচ্চে রায়মঙ্গল আর কালিন্দির মোহনায়। কাকদ্বীপের আবহাওয়া সংকেত দেখানো মেশিন ঠিকই ধরেছে, তারা লালবাতি দেখিয়েছে সকাল থেকে, সেখানকার রেডিও বলেছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরের ট্রলারদের তীরের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে। আর ঢাকার আবহাওয়া অফিস সঞ্চরণশীল মেঘের আনাগোনা আর মৌসুমি বৃষ্টির কথা বলেই খালাস। নিম্নচাপ দেশ ও দেশের সীমানা মেনে চলাচল করতে শেখেনি- ঢাকা তো এখান থেকে অনেক দূর...। 

বিশাল ঢেউয়ের পাহাড়। ট্রলারের বাতি নিবে গেল আরজানের। ট্রলারের দোলায়, ধাক্কায় মাথা ফেটে গেল মনে হলো, বমি হলো। দাঁড়াতে পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। বিছানাপত্তর, মাছ, চালডাল, মাল-মসলার সঙ্গে সেও মিশে গেল। তার মায়ের কথা, বাপের কথা মনে পড়ল। তার মা মারা গেছে কয়েক বছর আগে। তার মা তার নাম ধরে ডাকছে... আরজান আয় বাপজান আয়... ইদিকি আয় দিনি...।

ফকিরচানের বউ নামাজের পাটিতে। রাত ৯টা হবে। হঠাৎ মনে হলো তার মিনসে তাকে ডাকতাছে। মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। ও আল্লা এরাম ল্যাগদেছে ক্যান। হুঁশ হারিয়ে ফেলে রহিমা। ফকিরচানের নতুন বিয়ে করা দ্বিতীয় বউ। 
শুকলাল শক্ত মনের মানুষ। এ ধরনের ঝড়ের বেকায়দায় সে এর আগেও কয়েকবার পড়েছে। এ তারিখ তার ভুল হয়েছে শালার রেডিওর ওপর ভরসা করা। গত তিন-চার দিন ধরেই তো সে দেখছিল আকাশ আর সমুদ্রের ভাব ভালো না। তালপট্টির দিকে এগিয়ে থাকা উচিত ছিল। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। এখন এই অতি বাজে অবস্থায় টিকে থাকা লাগবানে। তার ট্রলারটা ওদের দুজনের চেয়ে একটু বড় আর শক্ত-সামর্থ্য। নুরনগরের নগেন ময়রার ট্রলার। নগেন মিষ্টিতে চিনি নয়ছয় করলেও ট্রলারের ব্যাপারে খুব সজাগ, যত্ন নেয়। ‘ও বাছাড়ের পো, আমার ট্রলার যেম্মায় ঠিক থাকা দরকার সেম্মায় যেন থাকে। কোনো খুঁত থাকলি পানিতি নেবা না।’ এবারও সাড়ে ৫ হাজার টাকার জিনিসপত্তর লাগিয়ে দিয়েছে। না আর পারা গেল না। শুকলাল দেখল ট্রলারে থাকলে ডুবে মরতে হবে। সে ট্রলার থেকে ঝাঁপ দিল সাগরে। সাগরের ঢেউ আর স্রোতের সঙ্গী হলো অজানার উদ্দেশে। সাগরের পানি তত ঠাণ্ডা মনে হলো না। তবে ঢেউগুলো বড্ড বেয়াড়া। নুরনগর স্কুলে বিমল বাবুর ব্যাকরণ পড়ানোর কথা তার মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য। ১৮ বৈশাখের এই রাত ১২টায় অথই জলের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার সময়। হঠাৎ শুকলাল পায়ের তলায় মাটির স্পর্শ পেল মনে হলো। হ্যাঁ, তাই তো, ভালো মাটি। ঢেউয়ের দুলুনিতে সে দেখল ছোট একটা দ্বীপ, একেক ঢেউয়ের দোলায় ডুবে যাচ্ছে আবার জেগে উঠছে। ‘এখানে দাঁড়াতি পারলি এ যাত্রায় বাঁচার একটা উপায় হতো।’ কিন্তু এখানে ধরবার মতো আঁকড়ে থাকার মতো কিছু দেখছে না সে। বিজলীর আলোয় একটু সামনে দেখল না উঁচু জায়গা আছে। সেখানে পানি উঠতেছে না। তবে বাতাস প্রচণ্ড। তা থাক, সেখানে মাটিতে সটান হয়ে শক্ত করে মাটি ধরে শুয়ে রইল শুকলাল। 

ঢাকার আবহাওয়া অফিস রাত দেড়টায় তাদের কুতখালী অফিস থেকে খবর পায়, জবর ঝড়ের খবর। তারা তাড়াতাড়ি তিন থেকে নয় নম্বর মহা বিপদসংকেত জারি করে ফেলে। জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা যা হওয়ার তাই হয়। অর্থমন্ত্রীদের মাথাব্যথা তাতে বাড়ে-কমে বৈকি। কিন্তু তিন থেকে নয়ে ব্যারোমিটার তুলেও কী হলো? আড়মগাছার আরজান আর রমজাননগরের ফকিরচানের লাশ আজও পায়নি তাদের ছেলেমেয়েরা। শুকলালের ট্রলারটা কোসটগার্ডের লোকেরা শ্যামনগর থানায় ওয়ারলেস করে জানিয়েছে। শুকলাল তখনো নিখোঁজ। 

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব