![ফিলিস্তিন, বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমাদের বুদ্ধি-নেতৃত্ব](uploads/2024/05/16/Shah-Nistar-Jahan-1715837724.jpg)
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যু নিয়ে বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের অবস্থান দেখলে আমি বেশ অবাক হই। অবাক তাদের শব্দচয়নে, তাদের সাহসে। আরও হই এ কারণে, ওরা কী করছে আর আমরা কী করছি, সেটি ভেবে। বিশ্বের তাবৎ বড় বিশ্ববিদ্যালয় যখন ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার দাবিতে উত্তাল, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, মানে শিক্ষক, ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষার্থী সবাই সাংঘাতিক রকমের নীরবতা পালন করতে পারছে। বিশেষত, আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল (আহারে জাতির থিংকট্যাংক!)। অথচ এদের উচিত ছিল সত্যের পক্ষে থাকা। মানবতার পক্ষে কণ্ঠ তোলা। কিন্তু সেটি আমাদের দেশে দেখা গেল না। আমাদের শিক্ষক, রাজনীতিক, শিক্ষার্থী এবং তাদের নেতৃত্ব মোটামুটি ডিম পাড়তে থাকল। আমাদের গণমাধ্যমও বিস্ময়কর রকমে পশ্চিমা গণমাধ্যমকে অনুসরণ করল। সেটি অবশ্য নতুন ঘটনা নয়।
পশ্চিমা ইসরায়েল-মিত্র-গণমাধ্যম অবশ্যই খুব চালাক। প্রথমত তারা ফিলিস্তিন ইস্যুতে খুব কভারেজ দিচ্ছিল। অবশ্যই তাদের টার্গেট ছিল বিশ্বকে বোঝানো, ইসরায়েল কত মারাত্মকভাবে অসহায়। আর ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যে আক্রমণ করেছে, এটি নিতান্তই তার অধিকার। এটি এক চিরাচরিত চিত্র। এ নিয়ে বহু কথা লেখা হয়েছে বিশ্বদরবারে। এবার এ কাজে খুব সুবিধা যে করতে পারেনি তা নয়। তবে এবার পশ্চিমা কিছু দেশ শুরু থেকেই ইসরায়েলের সমালোচনা শুরু করে। বিশেষত, তার গণহত্যার পরিকল্পনা। অবশ্য জরজেন হেবারমাস একজন মার্কসবাদী হয়ে তার আদর্শ ডুবিয়ে দিলেন। তিনি শোষিতের পক্ষে থাকলেন না। তিনি ইসরায়েলি গণহত্যাকে ‘গণহত্যা’ বলতে চাইলেন না। তিনি তার অবস্থানের জন্য সমালোচিত হলেন। অন্য বুদ্ধিজীবীরা তাকে উদ্দেশ করে বললেন, পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক যে ব্যাংক, তা আজ মারাত্মকভাবে শূন্য। আমাদের দেশে কিন্তু সেটি বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। ইসরায়েলের মিত্র পত্রিকাগুলো বাহবা দিল হেবারমাসকে। তবে ইসরায়েলের মিত্র পত্রিকাগুলো যেন অপেক্ষায় ছিল, সুযোগ খুঁজছিল যাতে কভারেজের ধরন বদলান যায়। ছোট্ট একটি সুযোগ এসেও গেল। লোহিত সাগর এলাকার হুতি আর ইরানের অবস্থান ধরে আমেরিকার জাহাজ ইত্যাদি নামিয়ে দিয়ে তারা বিশ্ব কভারেজে একটু মোড় নিতে চাইল। কিন্তু খুব একটি জুতসই হলো না। তাদের সুবিধাটি এসে গেল সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলের আক্রমণের পর। এবার পশ্চিমারা, মানে যারা ইসরায়েল-আমেরিকার বন্ধু, তারা যেন ধরেই নিয়েছিল এবার ইরান একটি আক্রমণ চালাবে। এ অবস্থায় ইরানের জন্যও পাল্টা আক্রমণ, যেকোনো মূল্যে ফরজ হয়ে যায়। বিশ্ব নীতিমালা কিংবা কূটনৈতিক শিষ্টাচার নিয়ে চিন্তা করলে ইসরায়েলের এই আক্রমণ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। পত্রিকাগুলো সেটি বেমালুম চেপে গেল। ইসরায়েলের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো মুখ টিপে হাসল। মানে, যারা অন্যকে শিষ্টাচারের ছবক দেয় তারা। তারা ইরানের ধৈর্য পরীক্ষা করল। ইরান শক্তি দেখানোর জন্য হোক, মুখ রক্ষার জন্য হোক, কিংবা বিশ্ব রাজনীতি, আঞ্চলিক রাজনীতির কাঠামোয় নিজের অবস্থান জানানোর জন্য হোক, ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বুঝিয়ে দিল সেও খুব কম যায় না।
এ ঘটনা পশ্চিমা গণমাধ্যমকে, বিশেষত যারা ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়, তাদের একটি বড় সুযোগ দিল। তারা রাতারাতি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আক্রমণের খবর চেপে যেতে থাকল। ইসরায়েলে ইরানের আক্রমণ তাদের জন্য বড় প্রতিপাদ্য হয়ে উঠল। ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, সেটি আর তাদের কভারেজ বা খবরে থাকল না। বিশেষত ইরান যে কত বড় ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে, সেটি জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তারা। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও তার প্রভাব দেখা গেল। তারা কভারেজে ইসরায়েলের বন্ধু হয়ে গেল। ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের পত্রিকা, মানে ওখানে যেসব পত্রিকা ইসরায়েলের বন্ধু তারা, গলা বাড়িয়ে বলতে থাকল, ‘ইরানের ধৃষ্টতা’ প্রকাশে। এখন পশ্চিমা কিছু পত্রিকা লিখছে, রাস্তার কুকুরে খাচ্ছে ফিলিস্তিনের মানুষের লাশ। মানে, এদের মাটি দেওয়ার মানুষও নেই। ঠিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু ফটোগ্রাফ দেখলে যেমন চিত্র মনে হয়। কিন্তু এই বিষয়টি কিছু পশ্চিমা পত্রিকা প্রকাশ করল ইসরায়েলের সাহসের চিত্র হিসেবে। মানে তোমরা ইসরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করো, নয়তো পুরো দেশ এমন হবে! ইসরায়েলের গণহত্যা থেমে নেই।
কিন্তু বাদ সাধল একটি জায়গায়। পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের শিক্ষার্থীরা সাংঘাতিক বেঁকে বসল এবং এটি কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। তারা যেন নিজের জীবন কোরবান করতে প্রস্তুত। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (লস অ্যাঞ্জেলেস) এবং কলাম্বিয়া, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, মিশিগান, লিডস ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ বাকি রইল না। জেগে উঠল। ইসরায়েলের বন্ধু পত্রিকার সবারই একটি স্লোগান খুব অপছন্দ- ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, ফিলিস্তিন উইল বি ফ্রি- এই স্লোগানে মুখরিত হলো এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শহরের রাস্তা। শিক্ষার্থীরা গান গাইলেন রাস্তায়, মিছিল করলেন, প্রতিবাদ জানালেন। ক্যাম্পাসে অবস্থান নিলেন। তারা থামলেন না। তারা বন্দি হলেন, বহিষ্কারের হুমকি পেলেন, তাদের শিক্ষকরা এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগ দিলেন। হেনস্তা তাদেরও হলো খুব। কিন্তু সেটি তারা বরণ করলেন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রটি ভিন্ন। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছেন। সন্তানদের লালন-পালন করতে পারছেন। না, ছাত্রনেতাদের কথা বললাম না। তারা নাকি দেশের উন্নয়নে সময় ব্যয় করছেন। তা না হলে তাদের ব্যাংক ব্যালান্স এত বড় হবে কী করে! এদের আবার সমর্থন দেয় এ দেশের কিছু আগাছা বুদ্ধিজীবী।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আলোচনায় ছিল। এখন নেই। সেখানে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। সেখানে যাতে রাজনীতি থাকে, সে জন্য আমাদের সামাজিক গণমাধ্যমের শোরগোলে মাথা গরম হওয়ার জোগাড়। আমাদের ছাত্ররাজনীতির অবদানের বয়ান শুনে ভিরমি খাই যেন। খুব আবেগ, খুব উদ্ধত তাদের বয়ান। আট-দশবার ফেল করা ছাত্রের নেতৃতে তারা আস্থা রাখলেন। ভারি মজার স্কুল! এবং এই তথাকথিত নেতাদের যাবতীয় অপকর্ম সমর্থন করেন এ দেশের যত আগাছাসম বুদ্ধিজীবী। এরা সবাই দল করেন, দলের স্বার্থে কথা বলেন, নানাভাবে দলের ভাগে ভাগ বসান। ফলে অসংখ্য ফুলপরী খাতুন সম্ভ্রম হারালে এদের অসুবিধা হয় না। এদের ইন্ধনে ওই চাঁদাবাজ ছাত্রনেতা ভরসা পান। শত অন্যায়ে কোনো সমস্যা দেখে না সে। ফলে বিশ্বমানবতা ভূলুণ্ঠিত হলে তার আসবে যাবে কেন? আচ্ছা, গত এক-দুই দশকে আমাদের ছাত্ররাজনীতির অর্জন কী? ফলে বিশ্বমানবতা দিয়ে এনারা কী করবেন?
মূলত রাজনীতির এখন আকাল চলছে এ দেশে। আবার চলছেও না। আতি নেতা, পাতি নেতা, চেঙ্গা নেতা, টুনটি নেতা, নেংটু নেতার অভাব নেই। অথচ একজন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও একসময় ইসরায়েলের নৃশংসতা নিয়ে লিখতেন, মিছিলে যেতেন। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটলে ভয় লাগে। শ্রেণিকক্ষে লেকচার দিতে ভয় লাগে। আমি না আবার কারও অপছন্দের কাজ করে ফেললাম। তারা রীতিমতো অভিযোগ করেন, শ্রেণিকক্ষে তার মতের বিরোধী কথা হচ্ছে বলে। অথচ সেই আলাপ খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। এবং তারা শিক্ষককে তুলে ধরেন ভিন্নভাবে। অনেকটা অর্ধসত্য কিংবা অর্ধমিথ্যা বলা লোকদের মতো। যেটুকু বললে তার কাজ হবে সেটুকু বলে। মুখে জপে আল্লাহর নাম। অন্তরে অন্যের জমি দখলের চিন্তা। মনভূমি দখল করে আছে তার নর্দমার জল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিক, শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা ও তাদের সংগঠনের অবস্থা এখন তেমন। ফিলিস্তিনে নির্বিচার গণহত্যা তাদের চিন্তিত করে না। করার কথা নয়। তারা বরং মানবতার বিপক্ষে এক বিশুদ্ধ ভয়ের পৃথিবী বিনির্মাণে সময় ব্যয় করেন।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা