ঢাকা ১৮ বৈশাখ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

ফিলিস্তিন, বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমাদের বুদ্ধি-নেতৃত্ব

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১১:৩৫ এএম
ফিলিস্তিন, বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমাদের বুদ্ধি-নেতৃত্ব
শাহ নিসতার জাহান

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যু নিয়ে বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের অবস্থান দেখলে আমি  বেশ অবাক হই। অবাক তাদের শব্দচয়নে, তাদের সাহসে। আরও হই এ কারণে, ওরা কী করছে আর আমরা কী করছি, সেটি ভেবে। বিশ্বের তাবৎ বড় বিশ্ববিদ্যালয় যখন ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার দাবিতে উত্তাল, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, মানে শিক্ষক, ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষার্থী সবাই সাংঘাতিক রকমের নীরবতা পালন করতে পারছে। বিশেষত, আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল (আহারে জাতির থিংকট্যাংক!)। অথচ এদের উচিত ছিল সত্যের পক্ষে থাকা। মানবতার পক্ষে কণ্ঠ তোলা। কিন্তু সেটি আমাদের দেশে দেখা গেল না। আমাদের শিক্ষক, রাজনীতিক, শিক্ষার্থী এবং তাদের নেতৃত্ব মোটামুটি ডিম পাড়তে থাকল। আমাদের গণমাধ্যমও বিস্ময়কর রকমে পশ্চিমা গণমাধ্যমকে অনুসরণ করল। সেটি অবশ্য নতুন ঘটনা নয়।

পশ্চিমা ইসরায়েল-মিত্র-গণমাধ্যম অবশ্যই খুব চালাক। প্রথমত তারা ফিলিস্তিন ইস্যুতে খুব কভারেজ দিচ্ছিল। অবশ্যই তাদের টার্গেট ছিল বিশ্বকে বোঝানো, ইসরায়েল কত মারাত্মকভাবে অসহায়। আর ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যে আক্রমণ করেছে, এটি নিতান্তই তার অধিকার। এটি এক চিরাচরিত চিত্র। এ নিয়ে বহু কথা লেখা হয়েছে বিশ্বদরবারে। এবার এ কাজে খুব সুবিধা যে করতে পারেনি তা নয়। তবে এবার পশ্চিমা কিছু দেশ শুরু থেকেই ইসরায়েলের সমালোচনা শুরু করে। বিশেষত, তার গণহত্যার পরিকল্পনা। অবশ্য জরজেন হেবারমাস একজন মার্কসবাদী হয়ে তার আদর্শ ডুবিয়ে দিলেন। তিনি শোষিতের পক্ষে থাকলেন না। তিনি ইসরায়েলি গণহত্যাকে ‘গণহত্যা’ বলতে চাইলেন না। তিনি তার অবস্থানের জন্য সমালোচিত হলেন। অন্য বুদ্ধিজীবীরা তাকে উদ্দেশ করে বললেন, পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক যে ব্যাংক, তা আজ মারাত্মকভাবে শূন্য। আমাদের দেশে কিন্তু সেটি বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। ইসরায়েলের মিত্র পত্রিকাগুলো বাহবা দিল হেবারমাসকে। তবে ইসরায়েলের মিত্র পত্রিকাগুলো যেন অপেক্ষায় ছিল, সুযোগ খুঁজছিল যাতে কভারেজের ধরন বদলান যায়। ছোট্ট একটি সুযোগ এসেও গেল। লোহিত সাগর এলাকার হুতি আর ইরানের অবস্থান ধরে আমেরিকার জাহাজ ইত্যাদি নামিয়ে দিয়ে তারা বিশ্ব কভারেজে একটু মোড় নিতে চাইল। কিন্তু খুব একটি জুতসই হলো না। তাদের সুবিধাটি এসে গেল সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলের আক্রমণের পর। এবার পশ্চিমারা, মানে যারা ইসরায়েল-আমেরিকার বন্ধু, তারা যেন ধরেই নিয়েছিল এবার ইরান একটি আক্রমণ চালাবে। এ অবস্থায় ইরানের জন্যও পাল্টা আক্রমণ, যেকোনো মূল্যে ফরজ হয়ে যায়। বিশ্ব নীতিমালা কিংবা কূটনৈতিক শিষ্টাচার নিয়ে চিন্তা করলে ইসরায়েলের এই আক্রমণ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। পত্রিকাগুলো সেটি বেমালুম চেপে গেল। ইসরায়েলের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো মুখ টিপে হাসল। মানে, যারা অন্যকে শিষ্টাচারের ছবক দেয় তারা। তারা ইরানের ধৈর্য পরীক্ষা করল। ইরান শক্তি দেখানোর জন্য হোক, মুখ রক্ষার জন্য হোক, কিংবা বিশ্ব রাজনীতি, আঞ্চলিক রাজনীতির কাঠামোয় নিজের অবস্থান জানানোর জন্য হোক, ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বুঝিয়ে দিল সেও খুব কম যায় না।

এ ঘটনা পশ্চিমা গণমাধ্যমকে, বিশেষত যারা ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়, তাদের একটি বড় সুযোগ দিল। তারা রাতারাতি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আক্রমণের খবর চেপে যেতে থাকল। ইসরায়েলে ইরানের আক্রমণ তাদের জন্য বড় প্রতিপাদ্য হয়ে উঠল। ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, সেটি আর তাদের কভারেজ বা খবরে থাকল না। বিশেষত ইরান যে কত বড় ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে, সেটি জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তারা। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও তার প্রভাব দেখা গেল। তারা কভারেজে ইসরায়েলের বন্ধু হয়ে গেল। ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের পত্রিকা, মানে ওখানে যেসব পত্রিকা ইসরায়েলের বন্ধু তারা, গলা বাড়িয়ে বলতে থাকল, ‘ইরানের ধৃষ্টতা’ প্রকাশে। এখন পশ্চিমা কিছু পত্রিকা লিখছে, রাস্তার কুকুরে খাচ্ছে ফিলিস্তিনের মানুষের লাশ। মানে, এদের মাটি দেওয়ার মানুষও নেই। ঠিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু ফটোগ্রাফ দেখলে যেমন চিত্র মনে হয়। কিন্তু এই বিষয়টি কিছু পশ্চিমা পত্রিকা প্রকাশ করল ইসরায়েলের সাহসের চিত্র হিসেবে। মানে তোমরা ইসরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করো, নয়তো পুরো দেশ এমন হবে! ইসরায়েলের গণহত্যা থেমে নেই।

কিন্তু বাদ সাধল একটি জায়গায়। পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের শিক্ষার্থীরা সাংঘাতিক বেঁকে বসল এবং এটি কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। তারা যেন নিজের জীবন কোরবান করতে প্রস্তুত। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (লস অ্যাঞ্জেলেস) এবং কলাম্বিয়া, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, মিশিগান, লিডস ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ বাকি রইল না। জেগে উঠল। ইসরায়েলের বন্ধু পত্রিকার সবারই একটি স্লোগান খুব অপছন্দ- ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, ফিলিস্তিন উইল বি ফ্রি- এই স্লোগানে মুখরিত হলো এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শহরের রাস্তা। শিক্ষার্থীরা গান গাইলেন রাস্তায়, মিছিল করলেন, প্রতিবাদ জানালেন। ক্যাম্পাসে অবস্থান নিলেন। তারা থামলেন না। তারা বন্দি হলেন, বহিষ্কারের হুমকি পেলেন, তাদের শিক্ষকরা এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগ দিলেন। হেনস্তা তাদেরও হলো খুব। কিন্তু সেটি তারা বরণ করলেন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রটি ভিন্ন। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছেন। সন্তানদের লালন-পালন করতে পারছেন। না, ছাত্রনেতাদের কথা বললাম না। তারা নাকি দেশের উন্নয়নে সময় ব্যয় করছেন। তা না হলে তাদের ব্যাংক ব্যালান্স এত বড় হবে কী করে! এদের আবার সমর্থন দেয় এ দেশের কিছু আগাছা বুদ্ধিজীবী।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আলোচনায় ছিল। এখন নেই। সেখানে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। সেখানে যাতে রাজনীতি থাকে, সে জন্য আমাদের সামাজিক গণমাধ্যমের শোরগোলে মাথা গরম হওয়ার জোগাড়। আমাদের ছাত্ররাজনীতির অবদানের বয়ান শুনে ভিরমি খাই যেন। খুব আবেগ, খুব উদ্ধত তাদের বয়ান। আট-দশবার ফেল করা ছাত্রের নেতৃতে তারা আস্থা রাখলেন। ভারি মজার স্কুল! এবং এই তথাকথিত নেতাদের যাবতীয় অপকর্ম সমর্থন করেন এ দেশের যত আগাছাসম বুদ্ধিজীবী। এরা সবাই দল করেন, দলের স্বার্থে কথা বলেন, নানাভাবে দলের ভাগে ভাগ বসান। ফলে অসংখ্য ফুলপরী খাতুন সম্ভ্রম হারালে এদের অসুবিধা হয় না। এদের ইন্ধনে ওই চাঁদাবাজ ছাত্রনেতা ভরসা পান। শত অন্যায়ে কোনো সমস্যা দেখে না সে। ফলে বিশ্বমানবতা ভূলুণ্ঠিত হলে তার আসবে যাবে কেন? আচ্ছা, গত এক-দুই দশকে আমাদের ছাত্ররাজনীতির অর্জন কী? ফলে বিশ্বমানবতা দিয়ে এনারা কী করবেন?

মূলত রাজনীতির এখন আকাল চলছে এ দেশে। আবার চলছেও না। আতি নেতা, পাতি নেতা, চেঙ্গা নেতা, টুনটি নেতা, নেংটু নেতার অভাব নেই। অথচ একজন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও একসময় ইসরায়েলের নৃশংসতা নিয়ে লিখতেন, মিছিলে যেতেন। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটলে ভয় লাগে। শ্রেণিকক্ষে লেকচার দিতে ভয় লাগে। আমি না আবার কারও অপছন্দের কাজ করে ফেললাম। তারা রীতিমতো অভিযোগ করেন, শ্রেণিকক্ষে তার মতের বিরোধী কথা হচ্ছে বলে। অথচ সেই আলাপ খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। এবং তারা শিক্ষককে তুলে ধরেন ভিন্নভাবে। অনেকটা অর্ধসত্য কিংবা অর্ধমিথ্যা বলা লোকদের মতো। যেটুকু বললে তার কাজ হবে সেটুকু বলে। মুখে জপে আল্লাহর নাম। অন্তরে অন্যের জমি দখলের চিন্তা। মনভূমি দখল করে আছে তার নর্দমার জল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিক, শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা ও তাদের সংগঠনের অবস্থা এখন তেমন। ফিলিস্তিনে নির্বিচার গণহত্যা তাদের চিন্তিত করে না। করার কথা নয়। তারা বরং মানবতার বিপক্ষে এক বিশুদ্ধ ভয়ের পৃথিবী বিনির্মাণে সময় ব্যয় করেন।      

লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

পাকিস্তানে নেতৃত্বের বড়ই ঘাটতি

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫৮ পিএম
আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০২:০৫ পিএম
পাকিস্তানে নেতৃত্বের বড়ই ঘাটতি
মালিহা লোধি
পাকিস্তানের সমস্যাগুলো যেন দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। দেশ ধীরে ধীরে নতুন মেরুকরণ এবং অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। জনসাধারণের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, জঙ্গিসহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, কেন্দ্র-প্রদেশের কলহ, পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ এবং সরকারবিরোধী সংঘর্ষ একই সঙ্গে ঘটে যাচ্ছে। এটি এমন এক সময়ে ঘটে যাচ্ছে; যখন একটি ভঙ্গুর অর্থনীতিকে অস্থিতিশীলতা থেকে টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হবে। 
 
দেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থা এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে কী বলা যায়? সংবাদমাধ্যমে আত্ম-প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়লেও মৌলিক সমস্যাগুলো এখনো সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে। শাসনব্যবস্থা জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। পাঞ্জাব এবং অন্যান্য জায়গায় উন্নয়নসংক্রান্ত যে বিলবোর্ডগুলো লাগানো হয়েছে তা নেতৃত্বের সঙ্গে যায় না। টেলিভিশনে প্রচারিত জনসংযোগ প্রচারণা; যেখানে ক্ষমতাধরদের নিয়মিত কাজ সম্পাদন করতে দেখানো হয়, তাতেও অনেক মানুষ আশ্বস্ত হয় না। জনসাধারণের দিকে ইতিবাচক ভাবমূর্তি অর্জনের জন্য অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন থাকলে তার প্রভাব বিপরীত হয়। কর্মক্ষমতার মাধ্যমে প্রশংসা অর্জন করতে হয়। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে বা সংবাদপত্রে প্রচার করে কোনো লাভ হয় না।
 
আজ পাকিস্তানের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এই মুহূর্তে যোগ্য এবং সাহসী নেতৃত্বের দরকার, যিনি পাকিস্তানের গভীরে বসে থাকা সমস্যাগুলো বোঝেন এবং সেগুলো সমাধান করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা রাখেন। সুসংগত পরিকল্পনা বা কৌশল ছাড়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এমন না হলে ভবিষ্যতের জন্য জনগণ আস্থা ফিরে পাবে না। তবে ধারাবাহিক জনমত জরিপগুলো থেকে উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে, জাতি ভবিষ্যতের জন্য আশাহীন। গত মাসে প্রকাশিত ইপসোস সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশ ভুল পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
 
পাকিস্তান এর আগেও নেতৃত্বহীন ছিল। দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সামর্থ্য বা কোনো ধারণা ছাড়াই অতীতে ব্যক্তিরা দেশের সর্বোচ্চ পদে আরোহণ করেছেন। জোর করে ক্ষমতায় আসায় কখনো নেতৃত্ব আসে না। এ কারণেই ভালো প্রশাসন তৈরি করা সম্ভব হয়নি। চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান তৈরি হয়েছে। রাজনীতি জনসাধারণের কল্যাণ্যের চাইতে ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত। বর্তমান সমস্যাগুলো এত বেশি প্রকট হওয়ার কারণে নেতৃত্বের বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে বর্তমানে যে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তানের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কার্যকর ও দূরদর্শী নেতা প্রয়োজন।
 
পাকিস্তানে কী ধরনের নেতৃত্বের প্রয়োজন? যোগ্য নেতৃত্ব কী? কার্যকর নেতা তৈরির গুণাবলি কী? সর্বোপরি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা যা জনসাধারণের কল্পনাশক্তিকে কাছে টানে। এমন একটি পথ তৈরি করবে যা মুহূর্তের মধ্যে বাইরে গিয়ে ভবিষ্যতে কী করা সম্ভব তা নির্ধারণ করবে। কার্যকর নেতৃত্বের জন্য শুধু দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করাই যথেষ্ঠ নয় বরং এটি বাস্তবায়নের জন্য কৌশল এবং সমর্থন করতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করাও প্রয়োজন। নেতৃত্বের অর্থ হলো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করা, দৃঢ়ভাবে রূপান্তরমূলক পথে যাত্রা করা, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, ইচ্ছা প্রদর্শন করা, স্বার্থান্বেষী এবং অভিজাতশ্রেণির কাছ থেকে দূরে থাকা। কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে এরকম গুণাবলি পাওয়া গিয়েছিল। কীভাবে প্রভাবশালী নেতারা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারেন তার বড় উদাহরণ হিসেবে কাজ করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। তার পরে যারা এসেছেন, তাদের বেশির ভাগই যার মধ্যে বর্তমান নেতারাও রয়েছেন, তাদের আদর্শ অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো নয়। 
 
নেতৃত্বের মধ্যে সততার সর্বোচ্চ মান থাকতে হবে। সততার জন্য তার মধ্যে খ্যাতি থাকাও দরকার। এর অর্থ হলো এমন একটি দল নির্বাচন করা যার যোগ্যতা এবং সততা উভয় গুণাবলি মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, যোগ্য লোকদের সঠিক কাজে নিযুক্ত করা একজন বুদ্ধিমান নেতার অপরিহার্য গুণ। একটি দল ‘সংযোগ’, ব্যক্তিগত আনুগত্য বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিবেচনার ভিত্তিতে নয়, বরং যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া উচিত। নেতৃত্বের আরেকটি বড় গুণ হলো নাগরিকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, তাদের উদ্বেগের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন, তাদের আকাঙ্ক্ষা বোঝা এবং তাদের প্রতি সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। এর অর্থ হলো তাদের আস্থা অর্জন করা এবং নেতার রূপান্তরমূলক এজেন্ডাকে সমর্থন করার জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করা।
 
এই মানদণ্ডের ক্ষেত্রে বিচার করলে দেখা যায়, দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতারা বেশির ভাগই এ পরীক্ষায় কতটা ব্যর্থ। দূরদৃষ্টির অভাব স্পষ্ট। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সুসংগত পরিকল্পনার অভাবও স্পষ্ট। বেলুচিস্তানকে মোকাবিলা করার জন্য কোনো বিশ্বাসযোগ্য কৌশল তৈরি করা হয়নি, যেখানে অস্থিরতা এবং জনসাধারণের অসন্তোষ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু সরকারের মধ্যে পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ফেডারেল সরকারের নেতারা খাল সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।
 
বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কোনো দূরদৃষ্টিই এখনো দেখা যায়নি। দেশকে বহুবর্ষজীবী আর্থিকসংকটে ফেলে দেওয়া কাঠামোগত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় কোনো গুরুতর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। সরকারি নেতারা সংকট ব্যবস্থাপনার চক্রে আটকা পড়েছেন। তারা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি সমাধানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। অকার্যকর স্থিতাবস্থা ভেঙে দেশের প্রবৃদ্ধির দ্বার উন্মোচন এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় সাহসী সংস্কার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
 
সরকারি নেতাদের দুর্বলতা তাদের বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। কারণ তারা কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক এখনো দূর হয়নি। শাসনব্যবস্থা ছিল অস্থায়ী এবং স্বল্পমেয়াদি চিন্তাভাবনার। দেশ পরিচালনার জন্য যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে। এর সামগ্রিক চরিত্র যোগ্যতার চেয়ে অন্যান্য বিষয় দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। শীর্ষ পদগুলো ঘনিষ্ঠ ও পারিবারিক সম্পর্কযুক্ত লোকদের দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে। 
 
নেতৃত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো জনগণকে অনুপ্রাণিত করা এবং নাগরিকদের সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ ও আস্থা তৈরি করা। এর অনুপস্থিতি এখনো স্পষ্ট। বরং আমাদের নেতারা ক্রমশই বাস্তবতা ও সাধারণ মানুষের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। দেশকে উৎসাহিত ও ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোনো দক্ষতা নেই। আজকের বিশ্বে নাগরিকদের কাছে পৌঁছানোর এবং তাদের প্রভাবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ দক্ষতারও যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে।
 
হেনরি কিসিঞ্জার তার গুরুত্বপূর্ণ বই ‘লিডারশিপ: সিক্স স্টাডিজ ইন ওয়ার্ল্ড স্ট্র্যাটেজি’-তে লিখেছেন, ‘সাধারণ নেতারা তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চান। মহান ব্যক্তিরা তাদের সমাজকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নীত করার চেষ্টা করেন’। তিনি বলেন, নেতারা যখন তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পরিস্থিতি অতিক্রম করেন এবং তাদের সমাজকে সম্ভাব্যতার সীমানায় নিয়ে যান, তখন তারা ইতিহাস গঠন করেন। পাকিস্তান এখন এমন নেতৃত্বের জন্য আকুল হয়ে আছে, যার দৃষ্টিভঙ্গি অবিচ্ছেদ্য অতীত থেকে বেরিয়ে দেশের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ তৈরি করবে। নাগরিকদের কল্যাণার্থে এবং উন্নত নেতৃত্বের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার সময় এসেছে এখন।
 
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘের 
সাবেক রাষ্ট্রদূত।
ডন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বজ্রপাতের ঝুঁকি: সবুজায়নেই সমাধান

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫১ পিএম
বজ্রপাতের ঝুঁকি: সবুজায়নেই সমাধান
আলম শাইন

ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও মরুকরণ-প্রক্রিয়া বাংলাদেশের নিত্যদিনের সঙ্গী। এর সঙ্গে বর্তমানে যোগ হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত বজ্রপাত। যদিও বজ্রপাত দেশে সব সময়ই ঘটছে, তবে সম্প্রতি সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।

আগে আমরা বজ্রপাত ঘটতে দেখেছি মৌসুমভিত্তিক; বিশেষ করে বর্ষা ও কালবৈশাখী মৌসুমে একটু বেশি লক্ষ করেছি। সম্প্রতি বজ্রপাতের হার সে তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের যেকোনো সময় সামান্য মেঘ জমলেই কিংবা ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দিলেই বজ্রপাত হচ্ছে। তাতে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি  হচ্ছে ওই মুহূর্তে। এতে বিপুল প্রাণনাশের সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে।

গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে তিন মাসে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫টি বজ্রপাত আঘাত হানে। মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে বেশি বজ্রপাত ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

তারা জানিয়েছেন, ভারতের খাসিয়া পাহাড় ও মেঘালয়ে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত মেঘ জমতে থাকে। জমাকৃত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে অত্র এলাকায় অর্থাৎ সুনামগঞ্জে বজ্রপাত বেশি ঘটছে। তাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সর্বসাধারণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আকাশে সামান্য মেঘ দেখলেই কৃষক অথবা খেটে খাওয়া মানুষ ঘরমুখী হতে চেষ্টা করেন। আর যারা দূর হাওর-বাঁওড়ে কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা তখন ভীষণ বিপাকে পড়ে যান। ফলে তারা যখন তখন দুর্ঘটনার শিকারে পরিণত হন। তেমনি দেশের বিভিন্ন জেলায় গত ২৮ এপ্রিল বজ্রপাতের শিকারে পরিণত হয়েছেন ১৩ জন। এভাবে দেশে প্রায় প্রতিনিয়তই আমরা বজ্রপাতে মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারছি, যা সত্যিই দুঃখজনক।

বিষয়টি মাথায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন অধ্যাপক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরের পরেই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর্দ্র বাতাস বাংলাদেশের ওপরে ভেসে আসছে। অন্যদিকে উত্তর থেকে হিমালয়ের ঠাণ্ডা বাতাস ধেয়ে আসছে। এ দুই ধরনের বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল হওয়ায় বাংলাদেশে ব্যাপক বজ্রপাত ঘটছে।
যেভাবেই বজ্রপাত হোক না কেন, তাতে জানমালের প্রচুর ক্ষতি সাধিত হচ্ছে- এটিই সত্যি কথা। বিশেষ করে বজ্রপাতে পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, মাঠ-প্রান্তরে, জলাশয়ে কিংবা রাস্তাঘাটে পুরুষের অবস্থান নারীদের তুলনায় বেশি হওয়ায় দুর্যোগের কবলে তারাই বেশি পড়ছেন। ফলে সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে অকালে প্রাণ হারাতে হচ্ছে, তাতে পরিবারটিকে পড়তে হচ্ছে ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে।

দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক জানা যায়, ২০১১-২০২৪ সালের মধ্যে দেশে বজ্রপাতে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা বিশ্বের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে পঞ্চম। ফলে ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই এপ্রিল-জুন মাসে সংঘটিত হয়। মৌসুম ছাড়াও যখন তখন দেশে বজ্রপাত হচ্ছে। যেমন, ২০১২ সালে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৩ জনের মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পেরেছিলাম। সেই বজ্রপাতটি ঘটেছে তা-ও কি না আগস্ট মাসে। তাতে প্রতীয়মান হয়, বজ্রপাত এখন আর মৌসুমভিত্তিতে হচ্ছে না। বছরের যেকোনো সময় আঘাত হেনে প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। 

অতিরিক্ত বজ্রপাত ঘটার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকেও দায়ী করা হচ্ছে। যে হারে বৃক্ষনিধন ও কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বাড়ছে, তাতে বায়ুমণ্ডলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

এই বৈরী আবহাওয়াকে এখন বজ্রপাতের অনুকূলে নয়, মানুষের অনুকূলে আনতে হবে বনায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে। বড় বড় গাছগাছালি লাগিয়ে বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে, তাতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ, বজ্রপাত ঘটার সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত; বিশেষ করে মাঠ-প্রান্তরসহ রাস্তার দুই ধারে তালগাছ লাগাতে হবে বেশি বেশি।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, তালগাছ হচ্ছে প্রকৃতির বজ্রনিরোধক। তাই কাজটি করতে হবে আমাদের এখনই। কারণ, একটি তালের চারা রোপণের ১৪-১৫ বছর পর সেটি বজ্রনিরোধক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হয়। শুধু তালগাছ রোপণই নয়, পাশাপাশি বজ্রনিরোধক লাইটপোস্টে সিমেন্ট ব্যবহার করে টানিয়ে দিতে হবে। যেটি নেপালেও করা হয়েছে। আমাদের দেশেও বিজিবি ক্যাম্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোকে বলা হয় ‘লাইট মিনার স্টার’; যা ব্যবহার করা যেতে পারে মাঠ-প্রান্তরেও।

এর ব্যবহার খুব সহজ, অর্থকড়িও তেমন খরচ হয় না। আশার কথা হচ্ছে, হাওর এলাকায় কংক্রিটের শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শেল্টারে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্রও স্থাপন করা হবে। আবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কৃষকদের সতর্ক বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ এটি।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, ব্রিটিশ শাসনামলে একধরনের চৌম্বকীয় পিলার পুঁতে রাখা হয়েছিল দেশের মাঠ-প্রান্তরে কিংবা রাস্তার পাশে। সেগুলোর গায়ে খোদাই করে লেখা ছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বেশি পুঁতে রাখার কারণে অনেকের কাছে এগুলো ‘সীমান্ত পিলার’ নামে পরিচিত। বোতল আকৃতির ওজনদার সেই পিলার বজ্রনিরোধকের কাজে ব্যবহৃত হতো; কয়েক বর্গকিলোমিটার সুরক্ষাও দিত। পিলারের আশপাশে বজ্রপাত ঘটলেও মানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। অথচ অসাধুরা লোভের বশবর্তী হয়ে সেই পিলারগুলো তুলে সীমান্তবর্তী দেশে পাচার করে দিচ্ছে।

শেষ কথা হচ্ছে, চৌম্বকীয় পিলার হারিয়ে আমাদের চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে সবাইকে সাহসের সঙ্গে, ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে। দেশের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এর থেকে উত্তরণের জন্য; বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যুবসম্প্রদায় ও শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করতে। সোজা কথা, দেশের আনাচকানাচে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে।

একযোগে লাখ লাখ তালের চারা রোপণ করতে হবে দেশে। তবেই বজ্রপাত থেকে অনেকটা মুক্তি মিলবে; অর্থাৎ বনায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে ছায়াশীতল রাখতে হবে দেশটাকে। 

লেখক: কথাসাহিত্যক, পরিবেশ ও 
জলবায়ুবিষয়ক লেখক
[email protected]

মেধাবীদের দেশ ছাড়ার কারণ সম্পর্কে যা বললেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম
মেধাবীদের দেশ ছাড়ার কারণ সম্পর্কে যা বললেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একটা সময় মাস্টার্স করতে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার চিন্তা করলেও এখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করতেই বিদেশমুখী হচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। নানা কারণে তারা দেশে থাকার বিষয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য বছরে ৫০ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী দেশ ছাড়ছেন, যা ১০ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ। 

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই প্রবণতার জন্য দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম কমে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে দেশপ্রেমের নিম্নগতি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করলাম, দেশ স্বাধীন করলাম, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা শাসনক্ষমতায় গেছেন তারা ধনী লোক। বুর্জোয়া শ্রেণি। দেশপ্রেম দেখা গেল না। তারা ধনী হওয়ার জন্য অসৎ উপায় দুর্নীতি, লুটপাট- এগুলো করতে থাকলেন।’

তিনি বলেন, ‘তিন ধারার শিক্ষা তো এক ধারায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং তিন ধারা আরও বিভক্ত হলো। তার কারণ হলো ইংরেজি মাধ্যমে যারা ধনী তাদের ছেলেমেয়েরা পড়বে, মধ্যবিত্তরা বাংলা মাধ্যমে এবং গরিবরা মাদ্রাসায় পড়বে এ রকম একটা শ্রেণি বিভাজন দাঁড়িয়ে গেল। যারা উচ্চবিত্ত তারা কিন্তু দেশের শিক্ষার মান উন্নত করার ব্যাপারে আগ্রহী না। কেননা, তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। এই মাধ্যমে পড়ার পরে তারা আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এটা দেশের সম্পদ পাচারের মতো ব্যাপার। ধনীরা বিদেশে বাড়িঘর করছেন। দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই। কাজেই তাদের সব বিনিয়োগ এই অর্থে সন্তানের ভবিষ্যৎ, নিজেদের বাড়িঘর এগুলো তারা বিদেশে করতে থাকবেন।’ 

বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘যারা মধ্যবিত্ত তারাও এই উচ্চবিত্তদের দেখে এই রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করল। যেহেতু বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা বাংলা মাধ্যমে পড়বে না। ফলে মূলধারাকে উন্নত করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ দেখা যাবে না। যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের ছেলেমেয়েরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। ধনীদের সন্তানরা প্রাইভেটে যাবে বা বাইরে যাবে। এখন যারা প্রাইভেটে ভালো পড়ালেখা হচ্ছে না বলে মনে করছেন তারাই সন্তানদের বিদেশে পাঠাচ্ছেন। এটা রাজনৈতিক সমস্যা। রাষ্ট্র যেভাবে সম্পদ পাচারে বাধা দিচ্ছে না, একইভাবে তারা ছেলেমেয়েদের বিদেশ পাঠাতে বাধা দিচ্ছে না।’ 

মেধাবীদের এই বিদেশমুখী প্রবণতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে উপযুক্ত চাকরির অনিশ্চয়তা এবং অত্যধিক প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইদানীং আরও অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপর থাকেন ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু ক্ষমতা বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সেটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে আবার গুম-খুন বা মামলার ঝুঁকি থাকে। সব মিলিয়ে অভিভাবক মহল তাদের সন্তানদের নিয়ে থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। এ কারণে মধ্যবিত্তরা তাদের সর্বস্ব বিক্রি করে হলেও সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে শুধু রাজধানী ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৯৬ জন শিক্ষার্থী নিহত হন। এর আগে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ‘ফেসবুকে সন্তান কী লিখছে,’ ‘জঙ্গিবাদের অভিযোগ উঠল কি না’, এমন আতঙ্কের পাশাপাশি গুম-খুনের আতঙ্কে থাকতে হতো অভিভাবক মহলকে। 

রাখাইনে মানবিক করিডর উদ্বেগের বিষয়: মুনীরুজ্জামান

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৩ পিএম
রাখাইনে মানবিক করিডর উদ্বেগের বিষয়: মুনীরুজ্জামান
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান

মায়ানমারের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল রাখাইনে জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশের শর্তসাপেক্ষে ‘মানবিক করিডর’ সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান।

এ প্রসঙ্গে আ ন ম মুনীরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘শর্তসাপেক্ষে মানবিক করিডর নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। প্রথমত, এ ব্যাপারে আমাদের কারও কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কী সেই শর্তগুলো? সেটা প্রকাশ করতে হবে, জনগণকে জানাতে হবে। কী বিষয়ে এবং কোন রুটে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের (বাংলাদেশের) জাতীয় স্বার্থ কী? এ বিষয়ে আমরা যারা এসব নিয়ে কাজ করি তারাও পরিষ্কার না। তা ছাড়া মায়ানমারের এই রাখাইন কোনো সাধারণ এলাকা নয়। এখানে চীন, রাশিয়া, আমেরিকাসহ বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা আছে। পাশাপাশি রাখাইনে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ-সংঘাত চলছে। তাহলে এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেখানে কেন যুক্ত হবে? এটা উদ্বেগের বিষয়।’

এ নিয়ে জাতীয় স্বার্থ পরিষ্কার করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

মানবিক বিষয়ের নামে করিডর সুবিধা দিতে গিয়ে নতুন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় কি না, সেটির ব্যাপারেও সতর্কতামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

এদিকে রাজনীতিকরা বলেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উচিত ছিল দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মানবিক সহায়তার কথা বলে যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেটিই এখন দেশের জন্য সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হয়ে আছে। তার মাঝে আবারও ‘মানবিক করিডরের’ সুযোগ দিয়ে যদি নতুন সংকট তৈরি হয়, সেটা দেশের জন্য আরও বড় ক্ষতি হবে। তাই শর্ত সাপেক্ষে মানবিক করিডরের বিষয়গুলো জনগণের সামনে স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিষ্কারের আহ্বান জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছরের শুরুর দিকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এ জন্য গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ ‘করিডর’ দেওয়ার অনুরোধ করে। সেই প্রেক্ষাপটে গত রবিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে মায়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত বলছি না। সেই শর্তাবলি যদি পূরণ হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ করিডর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ হবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা, অস্ত্র নেওয়া হচ্ছে না।’

সড়ক অবরোধ ও জনভোগান্তি

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২১ পিএম
সড়ক অবরোধ ও জনভোগান্তি

আধুনিক বিশ্বে, উন্নত রাষ্ট্রে ‘অবরোধ’ একটি অস্বাভাবিক শব্দ! তবে, বাংলাদেশে এটি এখন নিত্যনৈমিত্তিক একটি ব্যাপার হয়ে গেছে! ন্যায্য হোক কিংবা অন্যায্য, যেকোনো দাবি-দাওয়া আদায়ে ‘অবরোধ’ এখন মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে! 

মানছি, অবরোধ হলো প্রতিবাদের ভাষা এবং রাজনৈতিকভাবে হয়তো এর বৈধতাও রয়েছে। গতি-প্রকৃতি আর পরিণতি বিচার করে আন্দোলনের শেষ অস্ত্র হিসেবে এটি আরোপ করা হয়। কিন্তু এই শেষ অস্ত্রটি আজকাল আন্দোলনের একদম প্রারম্ভেই প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে! 
‘অবরোধ’ বর্তমানে চরম অস্থিরতা আর অরাজকতার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে! যখন-তখন, যেখানে-সেখানে প্রয়োগের দরুন এটি এখন ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার হয়ে গেছে! আন্দোলনকারী কিংবা বিক্ষোভকারীদের ভাষায় দাবি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র হলেও, জনসাধারণের জন্য তা অস্বাভাবিক দুর্ভোগের সৃষ্টি করছে! 

অবরোধ আইনগতভাবে অবৈধ হলেও, অকারণ নয়। বস্তুত, এর এত অপব্যবহার হয়েছে যে এটি প্রায়োগিক নৈতিকতা হারিয়েছে! অবরোধের এই অভিশাপ নাগরিক জীবনে প্রতিনিয়তই চূড়ান্ত অসন্তোষ আর দুর্দশার জন্ম দিচ্ছে! এবং একে কোনোভাবেই ‘বৈধতা’ দেওয়া যাবে না! অবরোধের অনিষ্ট সম্পর্কে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। জনগণকে অবশ্যই বোঝাতে হবে যে অবরোধ জনদুর্দশার কারণ, মোটেও প্রতিকার নয়! 

সব কথার শেষ কথা হলো- দেশে সুশাসন কায়েম হলে এবং সৎ ও সুযোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে, রাষ্ট্রের সর্বত্র বিরাজমান সব ধরনের অন্যায্যতা ও অন্যায়ের অবসান একযোগে না ঘটলেও, ধীরে ধীরে ঘটবে। সর্বোপরি, এ সমস্যা থেকে আশু উত্তরণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। 

আসিফ আল মাহমুদ 
আকবরশাহ মাজার, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম ৪২০২ 
[email protected]