![মেয়েরা আগে আগে ছেলেরা পিছে, তাতে হলোটা কী?](uploads/2024/05/19/Tofayel-1716092582.jpg)
প্রসঙ্গ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। প্রতিবছরই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর অনেক রকমের বিশ্লেষণ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব বিশ্লেষণ কোনো নীতিকাঠামোয় কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হয় না। বিশ্লেষণগুলো বুদ্বুদের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। কোন বছর বিশ্লেষণে কোন বিষয়টা প্রাধান্য পাবে তা আগে থেকে বলা যায় না। যেমন এ বছরের বিশ্লেষণে প্রাধান্য পাচ্ছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা পিছিয়ে পড়েছে। এখানে কেন এত মনোযোগ ও এত বিস্ময়! কারণ পুরুষশাসিত সমাজের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে, ছেলেরাই সামনে থাকবে এবং মেয়েরা সব সময় ছেলেদের পেছনে থাকবে। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল- সাত বছরের মাধ্যমিকের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা প্রতিবছর পাসের হারে ছেলেদের চেয়ে ২-৩% এগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। ছেলে এবং মেয়ে একই ক্লাসে পড়েছে এবং একই সমাজের বাসিন্দা। ছেলে ও মেয়ে যারাই পাস করল, তারা এ দেশেরই ছেলে বা মেয়ে।
এখানে আলোচনার বিষয় হতে পারে, যারা পাস করল তাদের সবাই কলেজে যাবে কি না। একটা বড় অংশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে যাবে। গ্রামের মেয়েদের অনেকের বিয়ে হয়ে যাবে। অনেক গরিব ঘরের ছেলে বেকার থাকলেও কলেজে যাওয়ার সুযোগ পাবে না পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার করণে। অনেকে ভর্তি হওয়ার মতো কলেজে স্থান পাবে না। সম্মিলিতভাবে ৮৩.০৪% মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল হলো, বাকিদের ভাগ্যে কী আছে? তাদের স্থান কোথায় হবে? শতকরা হারে ১৭ হলেও মোট সংখ্যা কয়েক লাখ। প্রতিবছরই এই একই ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের বিষয় আলোচিত হয় না। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এভাবে প্রতিবছর হারিয়ে যায়!
শুধু পাসের শতকরা হার শেষ কথা নয়। যারা ফেল করল, তারা কোন কোন বিয়য়ে ফেল করল। সাধারণভাবে ফেলের হার গণিত এবং ইংরেজিতেই বেশি। ওই সব ফেল করা শিক্ষার্থীর স্কুলগুলোতে গণিত এবং ইংরেজির শিক্ষক আছে কি না; ভালো ফল করা বিদ্যায়তনগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান কোথায়- প্রায় সব ভালো ফলের স্কুলগুলো শহরে। আবার শহরেরও সব স্কুল নয়, সারা দেশের বড়জোর ৫০০টা স্কুল গড়পড়তা ফলকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। মোট কথা, সারা দেশের গড়পড়তা ফলাফল শিক্ষার মান ও বৈষম্যকে আড়াল করে রাখে।
এখানে শহর-গ্রামের শিক্ষার গুণমানে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, তার আলোচনা মাঝেমধ্যে হলেও কার্যকর কোনো প্রতিকার হয় না। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার মূল কাঠামোতে বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রাধান্য। দেশের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা বিস্তর। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য এখানে অধিকতর বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়েগের কোনো বিকল্প নেই। বেসরকারি মাধ্যমিকে সরকারি বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যদি হয় প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক তার মেরুদণ্ড তথা দেহপিঞ্জরের মূল কাঠামো। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা এ দেশে সবচেয়ে অবহেলিত।
মেয়েদের ভালো ফলে সরকারের একটি সহায়তার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তা হচ্ছে উপবৃত্তি। মেয়েদের বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ ও স্কুলে ধরে রাখতে উপবৃত্তির সহায়ক ভূমিকা রয়েছে। গ্রাম ও শহরের দরিদ্র পরিবারগুলোতে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের নানা কাজে প্রচুর সময় দিয়ে থাকে। তাদের অনেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনায় সময় দিতে পারে না। স্কুলগুলোতে শিক্ষকসংকট না থাকলে এসব শিক্ষার্থী বিশেষ মনোযোগ পেতে পারত। ধনী বা শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা শুধু পড়াশোনাই করে। আবার স্কুলের পাঠের অতিরিক্ত হিসেবে প্রাইভেট টিউটরের কাছেও পড়ার সুযোগ পায়। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে দরিদ্র ছেলেদের জন্যও উপবৃত্তি দেওয়া যায় কি না, বিষয়টি ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
কয়েক বছর ধরে কারিকুলাম, প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি ও মূল্যায়নব্যবস্থায় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। গ্রামের অনুন্নত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের অনেকে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পুরোপুরি সক্ষম হননি। বেসরকারি বিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পরিচালনা প্রক্রিয়ায় নানা অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি তো রয়েছেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে বলতে হয়, বিজ্ঞান শিক্ষার সক্ষমতা বেশির ভাগ স্কুল ও কলেজে নেই। কোনো ব্যবহারিক ক্লাস ও পরীক্ষা সঠিকভাবে হয় না। ব্যবহারিকে ইচ্ছামতো নম্বর দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করার পর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান আর পড়ে না। এভাবে এ দেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে না। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ল্যাব সুবিধা এত অপ্রতুল, কল্পনাও করা যায় না। হালে অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব হয়েছে, কিন্তু চর্চা খুবই সীমিত।
মেয়েদের আগে যাওয়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মেয়েদের ‘আগে দেওয়া’র একটি পুরোনো গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করি। এক নৃতত্ত্ববিদ বার্মায় দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি পুনরায় বার্মায় গিয়ে অভিভূত। সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাঠে-ঘাটে, শহরে-গ্রামে সর্বত্র মেয়েরা পুরুষদের বেশ তফাতে রেখে সামনে হাঁটে। পুরুষরা ত্রস্তপায়ে ধীরলয়ে বেশ তফাতে মেয়েদের পেছন পেছন হাটে। মেয়েদের এ উন্নতি ও সামনে আসার এ পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধানে নৃতত্ত্ববিদ যা দেখতে পেলেন তাতে তার আক্কেলগুড়ুম! জাপানিরা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে মাইন পুঁতে গেছে। তাদের কাছে মাইন অপসারণের কোনো প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ নেই। শেষে দেশের পুরুষরা একটা কৌশল অবলম্বন করল। এখন থেকে কিছুদিন নারীরা পুরুষের সামনে থাকবে। নারীদের মাইন বিস্ফোরণের সম্ভাব্য বিপদের ঢাল হিসেবে পুরুষের সামনে হাঁটতে হবে। পুরুষরা আত্মরক্ষার জন্য এভাবে নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশপ্রেমিক নারীরা হাসিমুখে এ মহান দায়িত্ব কিছুদিন পালন করে যাবেন।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া সে রকম নয়। এটি তাদের সত্যিকারের অর্জন। এ অর্জনের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। এ অর্জন টেকসই এবং আরও উজ্জ্বল হোক।
লেখক: গবেষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]