তীব্র দাবদাহে দেশে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে এবার। লবণশ্রমিকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে অসহনীয় গরম। লবণশ্রমিকরা গত বছর দৈনিক বেতন পেয়েছিলেন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। এবার পাচ্ছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। বেতন সামান্য বেশি নিলেও শ্রমিকরা অতিরিক্ত কাজ করে পুষিয়ে দিচ্ছেন। তাতে খুশি চাষিরাও।
মালিক-শ্রমিক মিলে এবারের লবণ উৎপাদনে বিগত ৬৩ বছরের রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন। তবে উৎপাদন বাড়ায় কমে গেছে লবণের দামও। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। বাড়তি দামে পরে বিক্রির আশায় চাষিরা মাটির গর্তে পলিথিন দিয়ে সংরক্ষণ করছেন লবণ।
বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজারের টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, পেকুয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। যা গত বছরের তুলনায় ২ হাজার একর বেশি।
কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ এলাকার লবণচাষি তানভীর মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, তিনি ১২০ একর জমিতে লবণ চাষ করেছেন। ৬০ হাজার মণ লবণ বিক্রি করেছেন ইতোমধ্যে । যা দিয়ে তার বিনিয়োগ উঠে গেছে। সামনে যা উৎপাদন হবে, তা বিক্রি করে লাভের আশা দেখছেন তিনি। উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও লাভ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর প্রতি একর জমিতে লবণ উৎপাদনে শ্রমিক এবং আনুষঙ্গিক খরচ ছিল দেড় লাখ টাকা। এ বছর তা বেড়ে ২ লাখ টাকা হয়েছে। উৎপাদন খরচ প্রায় ৩৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। উৎপাদন বেশি হওয়ায় শ্রমিকসংকট দেখা দিয়েছে। তাই শ্রমিকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। গত বছর শ্রমিকদের বেতন ছিল দৈনিক ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে গাড়ি ভাড়া, লোডিং-আনলোডিং খরচ, পলিথিন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য উপকরণের দামও।
তিনি জানান, মৌসুমের প্রথম দিকে তারা প্রতি মণ লবণ ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। যে কারণে শ্রমিক খরচ বাড়ার পরও তারা লাভে ছিলেন। কিন্তু উৎপাদন যতই বেড়েছে, লবণের দাম ততই কমেছে। শেষের দিকে এসে দাম উৎপাদন খরচের চেয়েও কমে গেছে। তাই তিনিসহ অন্য চাষিরা এখন লবণ বিক্রি না করে গর্তে সংরক্ষণ করছেন। মে মাসে গর্তে রাখা লবণ অক্টোবরের দিকে তুলে বিক্রি করবেন। অবশ্য এই পদ্ধতিতে লবণ সংরক্ষণে ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়।
লবণের দাম পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি গত বছরের লবণ আমদানিকে দুষছেন। গত বছর চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় ১ লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। সেই লবণ আসে এ বছরের উৎপাদন মৌসুমে।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী খবরের কাগজকে বলেন, চলতি মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। নভেম্বর মাস থেকে উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয়। অক্টোবর থেকেই যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু অক্টোবরের মাঝামাঝি ও শেষে দুটি ঘূর্ণিঝড় এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চাষিরা যথাসময়ে উৎপাদনে যেতে পারেননি। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে উৎপাদন শুরু হয়। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৩০ থেকে ৩২ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়। এবার গরমের মাত্রা বাড়ায় প্রতিদিন গড়ে ৩৮ হাজার টন উৎপাদন হচ্ছে। আশা করা যায়, আবহাওয়া এ রকম থাকলে চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে।
ইদ্রিস আলী আরও জানান, ২০২৩ সালে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন। যা ওই সময়ের জন্য সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল। এ বছর সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নভেম্বরের শুরুর দিকে প্রতি মণ লবণ ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। উৎপাদন বাড়ায় বর্তমানে মাঠে প্রতি মণ লবণ ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে শ্রমিক এবং অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মণ উৎপাদনে ৩০০ টাকার বেশি খরচ পড়ছে। তাই চাষিরা এখন লবণ বিক্রি না করে মাটির গর্তে সংরক্ষণ করছেন। বর্তমানে উৎপাদনের প্রায় ৭৫ শতাংশ লবণ মাটিতে পুঁতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ, উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশিখালী, কৈয়ারবিল, আলী আকবর ডেইল, টেকনাফের সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙিখালী, খারাংখালী, সিকদারপাড়া, কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন এলাকার চাষিরা তাদের উৎপাদিত লবণ মাঠের ওপর স্তূপ করে রেখেছেন। কেউ কেউ বাড়িঘরের আঙিনায় মজুত করে তার ওপর পলিথিন বিছিয়ে সংরক্ষণ করছেন। অনেকেই মাঠে গর্ত করে পলিথিন বিছিয়ে মজুত করছেন। একেকটি গর্তে ৬০০ থেকে ৮০০ মণ পর্যন্ত লবণ সংরক্ষণ করা হয়।
চাক্তাইয়ের মেসার্স লাল মিয়া সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মো. আসাদ আসিফ খবরের কাগজকে বলেন, আমদানি করা লবণ বাজারে প্রবেশ করায় দামে লাগাম পড়েছে। ১ লাখ টন আমদানির আগে প্রতি বস্তা (৭৪ কেজি) লবণের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা। গত মাসেও প্রতি বস্তা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে রিফাইন্ড লবণ প্রতি বস্তা ৭৪ কেজি ৯০০ টাকা, নন-রিফাইন্ড প্রতি বস্তা ৮৮ কেজি ৮২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি বস্তায় দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কমেছে।
তিনি জানান, পোশাকশিল্পে বৈদেশিক আদেশ কমে যাওয়ায় লবণের চাহিদা কমে গেছে। দেশে যে পরিমাণ লবণ ব্যবহৃত হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ যায় পোশাকশিল্পে। বাকি এক ভাগ চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কাজে এবং মানুষের ব্যবহারে লাগে।