রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টন সমাদ্দারের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রমে যারা রয়েছেন তাদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন একজন সহকারী ম্যানেজারসহ ৫ জন। স্বাভাবিক নিয়মে চলছে থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা।
গত বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় প্রতারণার মাধ্যমে জালিয়াতি, মানব পাচার এবং মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তিনটি মামলা করে পুলিশ। মিল্টন গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তার আশ্রমে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানে দায়িত্বরতরা আতঙ্কে রয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) খবরের কাগজকে এসব তথ্য জানান আশ্রমের সহকারী ম্যানেজার সোহেল খান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আশ্রমে এখন যারা আছেন তাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা স্বাভাবিকভাবেই চলছে। কোনো সমস্যা নেই। এ ছাড়া থানা থেকে পুলিশ এসেও আশ্রমে থাকা অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। পুলিশ সব সময়ই তাদের খোঁজ রাখছেন।’
মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের পর থেকে আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এটা চিন্তার কথা। কারণ তিনিই তো প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন এত দিন। এখানে খাবার থেকে শুরু করে চিকিৎসা, সব কিছুর ব্যয় বহন করেছেন। এখন কীভাবে প্রতিষ্ঠান চলবে, তা নিয়ে এখানে যারা কর্মরত রয়েছেন তারা টেনশনে রয়েছেন।
সরেজমিনে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়া চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে গিয়ে দেখা যায়, মূল সড়ক থেকে দক্ষিণ পাইকপাড়া সড়ক দিয়ে রিকশায় গেলে প্রায় ২০ মিনিটের রাস্তা। একটি সরু গলির পাশে তিনতলা একটি ছোট ভবনে এই আশ্রম। আশ্রমের গেট দিয়ে ঢুকতেই প্রচণ্ড উটকো দুর্গন্ধ। মাস্ক ছাড়া এখানে প্রবেশ করা যায় না। তবে অফিসে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ভবনে নিচতলার একটি রুমে চারজন অসুস্থ মানুষ। কেউ ভালোভাবে কথা বলতে পারছেন না। কারও কথাই স্পষ্ট না। বেশির ভাগ বৃদ্ধ নারী-পুরুষের ক্যাথেটার লাগানো। অনেকে ঘুমিয়ে আছেন।
এর পাশে রয়েছে শিশুদের থাকার জন্য একটি রুম। যেখানে ৫টি শিশু রয়েছে। একটি শিশু ঘুমিয়ে ছিল। অন্য শিশুরা খেলছিল।
এরপর দোতলা গিয়ে চোখে পড়ে একটি ফার্মেসি ও রোগী রাখার দুটি রুম। সেখানে বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে শুয়ে-বসে সময় কাটাতে। সব রুমেই দুর্গন্ধ, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এখানে যারা রয়েছেন তারা বেশির ভাগই মানসিক ভারসাম্যহীন।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী ম্যানেজার সোহেল খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমে এখানে তাদের আনা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরে সাভারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে কাজ করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ওয়ার্ডবয় নেই।’
প্রায় ৬ মাস হলো চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে মা কলির সঙ্গে থাকছেন অ্যাঞ্জেল। আগে মায়ের সঙ্গে রাজধানীর গোলাপশাহ মাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও এখন এখানে তাদের বর্তমান ঠিকানা। বাবা সুমন ভবঘুরে। তার কোনো খোঁজ তারা জানেন না। এ ছাড়া কোনো স্বজনও তাদের নিতে বা খোঁজ করতে আসেন না।
এখানে অ্যাঞ্জেলের মতো আরও আছে আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান, ফারিয়া ও মরিয়ম। এসব শিশুর প্রত্যেকের বয়স ৮ মাসের বেশি নয়। এদের মধ্যে শিশু মরিয়মের মা নেই। এখানে একজন নারী তার দেখভাল করেন।
এই শিশু ও তাদের মায়ের থাকার কোনো জায়গা না থাকায় তারা এখানেই থাকছেন। তবে কেন থাকছেন, কে তাদের দায়িত্ব নিলেন, কেনই বা নিলেন তা তারা কেউ বলতে পারছেন না।
মিল্টনের গ্রেপ্তারের বিষয়টি তারাও জানেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এখানে থাকা শিশুদের মায়েরা জানান, মিল্টনের গ্রেপ্তারের পর থেকে তারা চিন্তায় আছেন। এতদিন রাস্তায় ছিলেন। একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল। এই আশ্রম বন্ধ হয়ে গেলে তারা কোথায় যাবেন?
এসব শিশু মায়েরাসহ এখানে মোট ২২ জন অসুস্থ নারী ও পুরুষ রয়েছেন। এখানে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছেন নাহার নামের এক নারী। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। তিনি খবরের কাগজকে জানান, রংপুর থেকে কারা তাকে ট্রেনে তুলে দিয়েছেন বলতে পারেন না। এরপর তিনি ঢাকায় আসেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকে দিন। এরপর এই আশ্রমে কীভাবে এলেন তাও জানেন না। তার দুই মেয়ে থাকলেও কেউ তার খোঁজ নেয় না।
এই আশ্রমে থাকা আনোয়ার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। তার স্ত্রী ও সন্তানরা তাকে রাতের অন্ধকারে রাস্তায় ফেলে যান। সেখানে থেকে তিনি এই আশ্রমে আসেন। তা কে বা কারা তাকে নিয়ে এল বলতে পারেন না। তার একটি পায়ে পচন ধরেছে। ডায়াবেটিস থাকার কারণে সারছে না।’
এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সী সাব্বির আহমেদ খবরের কাগজকে জানান, আশ্রমে গোয়েন্দা ও পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নারী-শিশুসহ যারা রয়েছেন তাদের খোঁজ রাখছেন। এ ছাড়া আশ্রমের বর্তমানে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। সব ধরনের সেবা দিতে তারা প্রস্তুত।