বাংলাদেশের কোনো কিছুই এখন আর রাজনীতিমুক্ত নয়। এমন কী ক্রীড়াঙ্গনও। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তাদের অনুসারীরাই ক্রীড়াঙ্গনের হর্তাকর্তা হয়ে যান। এতে করে বিরোধী মতাদর্শের যোগ্য ও তৃণমূল পর্যায়ের ক্রীড়া সংগঠকরা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েন। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় তাদের অনুসারীরাই ক্রীড়াঙ্গনে প্রবল দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন। এভাবে সময়ের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার পালবদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনেও পালাবদল হয়েছে। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে যেভাবে উন্নতি হওয়ার প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে পিছিয়ে পড়েছে। কোনো কোনো খেলা ঝিমিয়ে পড়েছে। আবার যেসব খেলায় প্রবল সম্ভাবনা আছে বা সামাজিক মর্যাদা আছে, সেসব খেলায় নিজেদের মাঝে অন্তকলহে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও ছিল বেশি। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্রীড়াঙ্গনে আওয়ামী লীগ ঘরানার ক্রীড়া সংগঠকরা নেই। কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ বা আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ নিজেরাই সরে গিয়ে নীরব হয়ে পড়েছেন। এ সময় আবার জেগে উঠেছেন বিএনপি ঘরানার ক্রীড়া সংগঠকরা। তারা নতুন করে হাল ধরতে চান ক্রীড়াঙ্গনে। রাখতে চান দলীয় প্রভাবমুক্ত। এ লক্ষ্য নিয়ে শনিবার (৩ মে) ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। যেখানে আহ্বায়ক করা হয়েছে কিশোরগঞ্জের মো. শরিফুল আলমকে। সদস্যসচিব হয়েছেন বগুড়ার সৈয়দ আমিনুল হক দেওয়ান সজলকে। শনিবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মিলনায়তনে সারা দেশ থেকে আসা কয়েক শ ক্রীড়া সংগঠকের উপস্থিতিতে কমিটির নাম ঘোষণা করেন আগের কমিটির অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বুলবুল।
সদস্য সচিব সৈয়দ আমিনুল হক দেওয়ান (বায়ে), আহ্বায়ক মো. শরিফুল আলম (ডানে)
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক গোলরক্ষক এবং বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনিপর স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম, ক্রীড়া সংগঠক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ব্রাদার্স ইউনিয়নের আহ্বায়ক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল, জাতীয় হকি দলের সাবেক অধিনায়ক ও ক্রীড়া সংগঠক সাজেদ এ আদেল। অনুষ্ঠানটি অনেকটা ক্রীড়াঙ্গনের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, খালেদ মাসুদ পাইলট, উপস্থিত ছিলেন বিসিবির সাবেক পরিচালক মঈনউদ্দিন চৌধুরী কামরু, আসাদুজ্জামান খসরু,জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, শফিকুল ইসলাম মানিক, জাতীয় ব্যাডমিন্টন দলের সাবেক খেলোয়াড় কাজী হাসিবুর রহমান শাকিল, সাবেক সাঁতারু মাহফুজা রহমান তানিয়া, জাতীয় হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় প্রিন্স, মিতুল, শুটার শারমিন আক্তার রত্না, সাবেক অ্যাথলেট ফরহাদ জেসমিন লিটি, শামীমা সাত্তার মিমু, বিসিবির সাবেক পরিচালক মাঈন, সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শাহীন, অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহআলমসহ আরও অনেকে।
কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ানের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি আশা করব, এই সংগঠন দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। খেলাধুলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবে।’ দেশের ফুটবল ক্লাবগুলোর নাম পরিবারের নামে করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘বিদেশের প্রত্যেকটি ফুটবল দলের নাম ওই শহরের নামে। যেমন লিভারপুল, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের নাম হয়েছে ওই শহরের নামে। অথচ আমাদের দেশে ক্লাবের নাম হয়েছে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলের নামে। দেশের খেলাধুলা তাহলে কীভাবে এগুবে।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম রাজনৈতিক কারণে তামিম ইকবালকে জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র তামিম ইকবাল। কিন্তু শুধু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণেই জাতীয় দল থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যদিও বিএনপি কখনোই দলীয়করণ করেনি। আমিও ক্রিকেট বোর্ডের কাউন্সিলর ছিলাম। ওই সময় দলীয়করণ করা হয়নি। যার প্রমাণ গাজী গোলাম দস্তগীরও (বীর প্রতীক) নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। ফুটবলের কাজী সালাউদ্দিনকে আমরাই নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু সে বিদায় নেওয়ার পর আজ পর্যন্ত ফুটবলের ক্ষেত্র ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে পারেনি। সার্চ কমিটি নিজেদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের দিয়ে ফেডারেশন করছে। এদেরও এক দিন জবাব দিতে হবে। গত ৭-৮ মাসে ক্রীড়াঙ্গন আরও পিছিয়ে পড়েছে।’ ব্রাদার্স ইউনিয়নের আহ্বায়ক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের কথা, ‘বাংলাদেশের ক্রীড়াকে আপনারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। দেশের যুবসমাজকে মাদকের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করবেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের দলগুলোকে ভালো ফল বয়ে আনতে সহায়তা করবেন, এটাই আপনাদের কাছে আমার চাওয়া। বিএনপিকে বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয়ে বসে প্রতিনিধি নির্ধারণ করলে, তা বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না।’
সভাপতির বক্তব্যে আমিনুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কমিটি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বাদ পড়েছেন ত্যাগী ও দক্ষ সংগঠকরা। তাই ক্রীড়া সংগঠক অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের আহ্বান জানাচ্ছি যে, প্রত্যেকটি জেলা ও বিভাগে যে কমিটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবাই জেলা প্রশাসকের কাছে যাবেন, যাদের দিয়ে কাজ হবে তাদের নিয়ে কমিটি পাঠাবেন। জেলা-বিভাগের কমিটিতে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট-দোসর ছাড়া যে কাউকে নিয়ে কমিটি হতে পারে। ক্রীড়াঙ্গনকে আমরা রাজনীতিমুক্ত রাখতে চাই।’ আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়ে মো.শরিফুল আলম বলেন, ‘বিগত ১৭ বছরে যারা সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের অনেকেই এখনো আছেন। আবার আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনও হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা জেলা-বিভাগীয় সংগঠকরা কাজ করব। প্রশাসন এবং সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করব।’
আহ্বায়ক কমিটি
আহ্বায়ক- মো. শরীফুল আলম (কিশোরগঞ্জ), যুগ্ম আহ্বায়ক (২০ জন)- কাজি মহিউদ্দিন বুলবুল (চট্টগ্রাম), মীর শাহে আলম (বগুড়া), মোশাররফ হোসেন (বগুড়া).আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী (সিলেট), কাজী সায়েদুল আলম বাবুল (গাজীপুর), ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল (চট্টগ্রাম), মিফতা সিদ্দিকি (সিলেট), মো. ওয়াহিদ উদ্দীন চৌধুরী হ্যাপি (লক্ষ্মীপুর), আবু দাউদ শামসুজ্জোহা চৌধুরী ডন (ঠাকুরগাঁও), সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকি লাবলু (ফরিদপুর), আব্দুস সালাম (বাগেরহাট), আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ান (জামালপুর), আলী ইমাম তপন (ঢাকা), রোম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির (ঢাকা), মাহবুবুল আলম চপল (কুমিল্লা), আসাদুজ্জামান খসরু (বরিশাল), শহিদুজ্জামান শহিদ (গাইবান্ধা), জাহিদুল ইসলাম ধলু (নওগাঁ), কাজী হাসিবুর রহমান শাকিল (ঢাকা), সদস্যসচিব- সৈয়দ আমিনুল হক দেওয়ান সজল (বগুড়া), সদস্য (২২ জন)- অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম (ময়মনসিংহ), সাজেদ এ এ আদেল (ঢাকা), ফাহিমা হুসেইন জুবলী (ঢাকা), সৈয়দ জাহিদ হোসেন (খুলনা), ইসরাফিল খসরু (চট্টগ্রাম), ফয়সাল দস্তগীর (চট্টগ্রাম), জসিমউদ্দিন খসরু (গোপালগঞ্জ), রবিন চৌধুরী (ভোলা), ইকরামুল করিম মিলটন (খুলনা), এস এম আসাদুজ্জামান মুরাদ (খুলনা), মাহবুবুর রহমান শাহিন (চাঁদপুর), মো. রিয়াজ উদ্দিন (ঢাকা), সেলিম মিয়া (মুন্সীগঞ্জ), আনোয়ার হোসেন আনু (ঢাকা), হাজী ইসরাইল মিয়া (কিশোরগঞ্জ), শারমীন আক্তার রত্না (মাগুরা), মোহাম্মদ মনজুর মোরশেদ (লক্ষ্মীপুর), রেজাউর রহমান চৌধুরী সুমন (সিলেট), জাহেদ পারভেজ চৌধুরী (ঢাকা), বশির উদ্দিন আহমেদ (মুন্সীগঞ্জ), মো. সামসুজ্জামান সামু (রংপুর), শায়রুল কবীর খান (নেত্রকোনা)।