![ঘটনাগুলো নজরুল-জীবনের](uploads/2024/05/24/a1-1716531597.jpg)
একবার এক ইংরেজ পরিবারকে ইংরেজিতে ঠিকানা বুঝিয়ে বলতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল নজরুলের। সঙ্গে ছিলেন বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ। তখনই প্রতিজ্ঞা করলেন ইংরেজিতে কথা বলা শিখতে হবে। দুই বন্ধু মিলে শুরু করলেন ইংরেজি খবরের কাগজ পড়া। লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি গল্পের বই এনে পড়া। সঙ্গে নিয়ে বসলেন ডিকশনারি। কয়েক দিন খুব চেষ্টা-টেষ্টা চলল। ডিকশনারি খুঁজে খুঁজে অর্থ বের করতে করতেই হাঁপিয়ে গেলেন তারা। এটা নয় ওটা। ওটা নয় সেটা। এমনি করে করে লাইব্রেরি থেকে মোটা মোটা ইংরেজি বই এনে লাইব্রেরি প্রায় ফাঁকা করে ফেললেন দুই বন্ধু। বন্ধু শৈল তো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এদিকে নজরুল কিন্তু লাইব্রেরি থেকে বই এনে পাতা উল্টিয়েও দেখলেন না। মোটা বইগুলো তার ডুগিতবলা বাজানোর জন্যই বেশি কাজে লাগতে থাকল। শেষে বই পড়ে ইংরেজি শেখার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন। তাই বলে ইংরেজিতে কথা বলা শেখার ভূত কিন্তু মাথা থেকে গেল না। নতুন বুদ্ধি আঁটলেন। ইংরেজিতে কথা বলতে হলে তাদের চাই একজন ইংরেজ। ইংরেজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তারাও ইংরেজের মতো ঝরঝরে ইংরেজি বলবেন। খুঁজতে খুঁজতে মিস্টার শেকার নামে এক ইংরেজকে পেয়েও গেলেন। এত সহজে ইংরেজি শেখার সুযোগ থাকতে বই পড়ার কষ্ট করতে যাবেনই বা কেন? ব্যাস, ইংরেজ তো পাওয়া গেল। এবার শুধু খাতির করার পালা। খাতির করতে গিয়ে দুই বন্ধু ইংরেজিতে কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ইংরেজ কিন্তু সমানে বাংলায় কথা বলে চললেন। বাংলায় কথা বলতে পেরে ইংরেজ মোটেও ইংরেজি বলছেন না। মহা মুশকিলে পড়লেন দুই বন্ধু। ইংরেজ যখন, ইংরেজি তো বলবেই। এই ভেবে দুজনে তার সঙ্গে খাতির করে বেশ ক’দিন খুব ঘন ঘন তাদের বাড়ি গেলেন। সাহেবের পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপ-সালাপও হলো অনেক। আলাপ পরিচয় খাতির সবই হলো, কিন্তু তারা যে সব কথাই বাংলায় বলে! ইংরেজিতে কথাই বলে না। নজরুল বললেন, এরা নিশ্চয় অন্য জাত। আর তা না হলে এরা বাংলাদেশে থেকে বাংলা শিখে ইংরেজি ভুলে গেছে।
নজরুল আর মুজফফর আহমেদ এক সময় বাড়ি ভাড়া নিলেন ৮/এ, টার্নার স্ট্রিটে। এটি ছিল নবযুগ অফিসের খুব কাছে। মাত্র দু-মিনিটের পথ। বাড়ির মাসিক ভাড়া ছিল দশ টাকার কিছু কম। মুসলমানদের বস্তি এলাকার মধ্যে তাদের বাড়িটিই ছিল একতলা পাকা বাড়ি। সেখানে নজরুল এলাকার বয়স্কা মহিলাদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেললেন। নানান রকমের খালা জুটে গেল নজরুলের। যাদের গায়ের রং ফর্সা, তারা আবার তার রাঙা খালা হয়ে উঠল। এই খালারা কিন্তু তাকে বেশ ভালোবাসত। প্রায়ই তারা রান্না করা তরকারি দিয়ে যেত।
কাজী নজরুলের অনেক গানই তখন আব্বাসউদ্দীনের গলায় রেকর্ড করা হয়েছিল। তিনি নজরুলকে ইসলামি গান লেখার জন্য রাজি করাতে চেষ্টা করলেন এভাবে- “একদিন কাজিদাকে বললাম, ‘কাজিদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন কীভাবে কাফের কুফর ইত্যাদি বলে বাংলায় মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে আপাঙক্তেয় করে রাখবার জন্য আদা-জল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন তা হলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’ কথাটা তার মনে লাগল।” নজরুল সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেও রাজি হলেন না গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল ইন-চার্জ ভগবতী বাবু। তাকে রাজি করাতে অবশ্য ছয় মাস সময় লেগেছিল। ভগবতী বাবু রাজি হতেই শিল্পী আব্বাসউদ্দীন গান লেখানোর ব্যবস্থা করে ফেললেন। পাশের ঘরে কাজিদা আছেন- শুনেই আব্বাসউদ্দীন গিয়ে বললেন, ‘ভগবতী বাবু রাজি হয়েছেন।’ তখন সেখানে ইন্দুবালা গান শিখছিলেন নজরুলের কাছে। নজরুল বলে উঠলেন, ‘ইন্দু তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আব্বাসউদ্দীন এক ঠোংগা পান আর চা আনতে পাঠালেন। পান আর চা নিয়ে দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই নজরুল লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ সঙ্গে সঙ্গেই সুরসংযোগ করে আব্বাসউদ্দীনকে শিখিয়েও দিলেন গানটি। পরের দিন ঠিক একই সময় আব্বাসউদ্দীনকে আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।’ তারপর থেকেই নজরুল একের পর এক ইসলামি গান লিখে চলেছেন। গান শুনলে যারা কানে আঙুল দিয়ে রাখত, তাদের কানেও গেল ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমেদ বোল,’ ‘আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়,’ ‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি,’ ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।’ এ রকম আরও অনেক ইসলামি গান মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুরু করল কান থেকে হাত নামিয়ে বাংলার মুসলমানরা। বাংলার মুসলমানের ঘরে ঘরে জেগে উঠল নতুন এক উন্মাদনা।
একদিন স্টুডিওতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন শিল্পী ও কবি। আড্ডার বিষয় ছিল, টাকা থাকলে প্রিয়ার জন্য কে কী করতেন? কেমন উপহার দিতেন? কত দামি অলংকার কিনতেন? আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় কাজী নজরুল এলেন। আড্ডার গল্পসল্প শুনলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছুই বললেন না। হঠাৎ হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন। আর বাজাতে বাজাতে সুর তুলে নতুন এক গান গাইতে শুরু করলেন-
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির
চৈতী চাঁদের দুল।
কণ্ঠে তোমার পরাবো বালিকা,
হংস-সারির দুলানো মালিকা।
বিজলী জরির ফিতায় বাঁধিব
মেঘ-রং এলা চুল।
জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রং ছানি
আলতা পরাব পায়।
আমার গানের সাত-সুর দিয়া,
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া।
তোমারে ঘেরিয়া গাহিব আমার
কবিতার বুলবুল।।
গান শেষে নজরুল সবার উদ্দেশে বললেন, কী? কয় টাকা লাগল বধূকে সাজাতে।
জাহ্নবী