![নৃত্যগীতে গারোদের ওয়ানগালা](uploads/2023/11/24/1700848187.wangalakk24.jpg)
নবান্নে গারোদের গোলায় উঠেছে পাকা ফসল। অগ্রহায়ণের ভোরে সেই ফসল সূর্যদেবতা ‘মিসি সালজংকে’ উৎসর্গ করেছে গারো বা মান্দি সম্প্রদায়। সমবেত কণ্ঠে ‘মিসি সালজংয়ের’ বন্দনার পর নৃত্যগীতে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীটি ওয়ানগালা উৎসব উদযাপন করে।
বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) বর্ণাঢ্য আয়োজনে রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুলে উৎসবটির আয়োজন করেন ঢাকায় বসবাসরত গারোরা।
গারোদের এই ফসল তোলার উৎসবটি ‘ওয়ান্না’, ‘ওয়ানগালা’, ‘ওয়ানমা রংচুয়া’, ‘দ্রুয়া ওয়ানবলা’ নানা নামে পরিচিত। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের নানা প্রান্তে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়ের পাড়াগুলোতে এখন চলছে এ উৎসবের ধুম। ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষে শুক্রবার সকাল থেকে বনানী বিদ্যানিকেতনে নানা স্টল সাজিয়ে বসেন গারোরা। নতুন ধানের পিঠাপুলি ছাড়াও বিভিন্ন পদের মাছ, শুঁটকি, মেটে আলু, শাকসবজির পসরাও দেখা যায় স্টলগুলোতে। গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের স্টলও ছিল এই আয়োজনে।
গারোদের বিশ্বাস মতে, সূর্যদেবতা ‘মিসি সালজংকে’ স্মরণ করে বর্ষার যে ধান রোপণ করেন তারা, সেই ফসলটি নবান্নে তার উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। এরপরই নতুন ফসলের অন্ন মুখে তোলেন তারা। গারোদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। উৎসর্গ পর্বটি ধর্মীয় দিক আর ভোজ, নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও সম্মিলনের দিকটি সামাজিক দিক।
বনানী বিদ্যানিকেতনে ওয়ানগালার প্রতীকী আয়োজনে ‘নকমা’র দায়িত্ব পালন করেন জনন্ত চিসিম। তিনি খবরের কাগজকে জানান, ওয়ানগালা উৎসবের নিয়ম অনুসারে জুমখেতের মাঝখানের কিছু অংশের ধান কাটা হয় সব শেষে। ওই স্থানটিকে গারোরা বলেন আসিরকার স্থান। ধান কাটা হয় দেবতার উদ্দেশে ধূপ উৎসর্গ করে। অতঃপর গোড়া থেকে কেটে আঁটি বেঁধে এরা ধান নিয়ে আসেন বাড়িতে। এ সময় সবাই মিলে আনন্দধ্বনি করেন। তাদের বিশ্বাস, শেষ ফসলের সঙ্গে তারা খেতের দেবতাদেরও এভাবে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তারা মনে করেন, দেবদেবীরা পৃথিবীতে সব সময় থাকেন না। ওয়ানগালার সময় তারা ভক্তদের আশীর্বাদ করে চলে যান নিজ আবাসে।
ওয়ানগালার উৎসবের জন্য বাজার থেকে কিনে আনা হয় গরু, শূকর, ছাগল, মোরগ। বাড়ির লোকদের জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক ও অলংকারাদি। উৎসবে ব্যবহারের জন্য জোগাড় করা হয় মোরগ ও ডুকুয়া পাখির পালক।
বনানী বিদ্যানিকেতনে ‘মিসি সালজংয়ের’ বন্দনার যে প্রতীকী আয়োজনে নকমা জনন্ত চিসিম প্রথমে লাল রঙের পাগড়ি ও মোরগের পালকগুচ্ছ মাথায় পরে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি চাল রাখার মটকা বা পাত্রে ভাণ্ডারদেবী ও খাদ্যশস্যের জননী রক্ষিমের পূজা অর্চনা করেন মন্ত্র পড়ে। অতঃপর একটি মুরগি জবাই করে তার রক্ত সুতার মালায় বাঁধা তিনটি পিণ্ডে মাখিয়ে মটকা বা পাত্রের গায়ে রক্ত ছিটান এবং ভেজা রক্তে মুরগির লোমগুলো লাগিয়ে দেন। এ সময় নতুন মদ ভাণ্ডার দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়।
পরে নকমা মিসি সালজংকে উদ্দেশ করে মন্ত্র পড়েন। তিনি একটি পাত্রে সাজানো দ্রব্যসামগ্রী-ভাত-তরকারি, কৃষিজাত ফলমূল, শাকসবজি প্রভৃতির ওপর এক এক করে ঢালতে থাকেন। এরপর তিনি ডান ও বাম পাশে রাখা তরবারি ও ঢাল হাতে নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে নাচতে আরম্ভ করেন। এ সময় সবাই সাজিয়ে রাখা বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাতে শুরু করেন।
এমএ/