একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে ধরতে হয়নি বটে; কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য জোগান দিয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন সেদিনের ১৬ বছর বয়সী এক তরুণ। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম মুক্তির অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা কাওসার চৌধুরীর সে লড়াই এখনো অব্যাহত। প্রামাণ্যচিত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা সংরক্ষণ করে তা রেখে যেতে চান নতুন প্রজন্মের জন্য, যে প্রজন্ম শতবর্ষ পর এ ইতিহাস পাঠে ব্রতী হবে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীজন কাওসার চৌধুরী এসেছিলেন খবরের কাগজ কার্যালয়ে। আলাপচারিতায় তার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হয়ে ওঠা আর অভিনয় জীবন নিয়ে বিস্তারিত উঠে আসে।
তার বয়ানে প্রথমে উঠে আসে একাত্তরের স্মৃতিকথা। একাত্তরে ছিলেন আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রামের মোগলটুলীর নবী কলোনিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সাড়ে ৮টা। জানা গেল, যুদ্ধজাহাজ ‘বাবর’ থেকে চট্টগ্রামে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সে রাতে ঘরহারা মানুষের আর্তনাদ শুনলেন রাতভর। আগ্রাবাদ হোটেলের কাছে তৎকালীন জিন্নাহ রোডে রাত দেড়টার দিকে বেবিট্যাক্সি করে কে যেন বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে শুরু করলেন। ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম আক্রমণ করে পাকিস্তানি আর্মি, শুরু হয় গণহত্যার নৃশংসতম অধ্যায়।
কাওসার চৌধুরীর পরিবারসহ আরও অনেক পরিবার তখন কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে প্রথমে শিকলবাহা, পরে আনোয়ারা হয়ে চলে যান মাতারবাড়ী, নিজ বাড়িতে। বড় ভাই মাহবুব কামাল চৌধুরী তখন নন-কমিশনড র্যাংকে ফ্লাইট সার্জেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। মার্চের শেষভাগে বাড়ি ফিরে আসেন। গ্রামের তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন তিনি। কাওসার বয়েজ স্কাউটের সদস্য ছিলেন, তা ছাড়া বাবার টু-টু বোর রাইফেলও নিয়মিত চালাতেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে তাকে অস্ত্র ধরতে হয়নি।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা আক্রান্ত হয় ১৯৭১ সালের ৬ মে। প্রথমে আক্রমণ হয় মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে। সেখানে আশ্রিত অনেক হিন্দু পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়, লুণ্ঠিত হয় ধনসম্পদ। সেদিন মাতারবাড়ীর উল্টো দিকে ঝাপুয়া এলাকা থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয় মাতারবাড়ীর দিকে। আতঙ্কে দ্বীপ ছেড়ে পালাতে হয় অনেক গ্রামবাসীকে।
চট্টগ্রামে ফিরে এসে কাওসার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয় চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি তোহা গাজীর সঙ্গে। তার সঙ্গে খাগড়াছড়ির রামগড় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের সাব্রুম এলাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রামগড়ে পৌঁছানোর পর আমাদের কাজ হলো শরণার্থীদের পথ চিনিয়ে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু আমি যেদিন পার হব সীমান্ত, সেদিন প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হলো। আমাকে আবার চট্টগ্রামে ফিরে যেতে হলো।’
চট্টগ্রামে ফিরে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ইনফরমার হিসেবে যুক্ত হলেন। পাশাপাশি নানা অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে গোলাবারুদও বহন করেছেন। কোনো যোদ্ধার ম্যাগজিনে গুলি ফুরিয়ে গেলে তা আবার লোড করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তার। অস্ত্র হাতে না নিয়েও রণাঙ্গনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা লড়াই করে গেছেন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেদিন মুক্ত হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কাওসার চৌধুরী নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যুক্ত হন। নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। আলোকচিত্রের প্রতি ছিল তার দারুণ দুর্বলতা। তিনি তখন অত্যাধুনিক সব ক্যামেরা ব্যবহার শুরু করেন। তবে তার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের হাতেখড়ি হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবীরের হাত ধরে। তার প্রতিষ্ঠান থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে ঘটে যায় নাটকীয় পটপরিবর্তন।
সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা দখল করে নিলেন, তখন গণতন্ত্র মুক্তির দাবিতে উত্তাল জনতার নানা অধ্যায় কাওসার চৌধুরীকে আকৃষ্ট করল। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন নিউজ এজেন্সির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ মিলেছিল তখন। পরে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ক্যামেরাপারসন হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি।
বিবিসির হয়ে কাজের মাঝেই কাওসার চৌধুরী একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, বীরাঙ্গনাদের স্মৃতিকথা নিয়ে তিনি একে একে নির্মাণ করলেন ‘সেদিনের কথা বলতে এসেছি’, ‘বধ্যভূমিতে একদিন’। নব্বইয়ের দশকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল সময়ের গল্প নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘গণ আদালত’। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও আর্কাইভিংয়ের জন্য তিনি এ বছর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক উৎস আর বধ্যভূমি খুঁজে বেড়ানোর কাজটি এখনো করে চলেছেন ৬৯ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাওসার চৌধুরী। এখনো ক্যামেরা, সহকারী, প্রোডাকশন ইউনিট নিয়ে তিনি ছুটে বেড়ান দেশের নানা প্রান্তে।
একাত্তরের বধ্যভূমিগুলো যখন একে একে আবাসন প্রকল্পের ভিড়ে হারিয়ে যায়, তা ভীষণ পীড়া দেয় তাকে। আলাপচারিতায় বললেন, ‘বাহাত্তরে যে বধ্যভূমিগুলো শনাক্ত করা হয়েছিল, তার অধিকাংশ এখন ভরাট হয়ে গেছে। রায়েরবাজার বধ্যভূমির পাশে ছিল ডিম্বাকৃতির ইটভাটা। তার পাশে খাল, পরে বসিলা গ্রাম। সেই ইটভাটার একটি পিলার তো অন্তত রাখা যেত। তাহলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারত, তখন কেমন ছিল রায়েরবাজার।’
বেশ কিছু বধ্যভূমি দখলের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ধর্মীয় অনুভূতির কারণে সেখানে সাংঘাতিক কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। ঢাকার মুসলিম বাজারে যে বধ্যভূমি পাওয়া গিয়েছিল, তার ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল মসজিদ। পরে তার পাশে একটি কুয়া খুঁড়তে গিয়ে সেখানে কঙ্কাল আর হাড়গোড় পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিরা সেদিন সোচ্চার হয়েছিলেন বলে এ বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্মারক নির্মাণ করা গেছে। জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম রংপুরের ঘাঘট নদীর তিরে যে স্থানে গণহত্যা করেছিলেন, সেখানে বাড়িঘর হয়ে গেছে। অনেক বধ্যভূমি শনাক্ত করার পর জমির মালিকানা দাবি করে কেউ কেউ এসে বলে এ জমি তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। যেহেতু এই মামলাগুলো ফৌজদারি মামলা না, তাই এসব মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলতেই থাকে।’