মেয়েদের মন বোঝা নাকি কঠিন। কথাটা ভুল নয়। তবে মেয়েদের এই রৌদ্র-ছায়ার অবুঝ মনের জন্য দায়ী শরীরের বেশ কিছু হরমোন। ইস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন এবং প্রোজেস্টেরনের মতো প্রজনন হরমোন নারীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন নিশাত আনজুম।
নারী কিংবা পুরুষ সবারই হরমোনসংক্রান্ত শারীরিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন বিভিন্ন কাজে যুক্ত। এই যেমন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা নারীর বয়ঃসন্ধি, ঋতুচক্র, গর্ভাবস্থা, প্রসবের পরে কিংবা মেনোপজের সময়টাতে মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে। দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে গেলে বিরক্তি, বিষণ্নতা বা উদ্বেগ সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, প্রোজেস্টেরন হচ্ছে প্রজনন হরমোন। এই হরমোনের কারণেও হঠাৎ করে তুচ্ছ কারণে মন খারাপ, রাগ বা বিষণ্নতা ভর করতে হবে। এ ছাড়াও অন্যান্য হরমোন যেমন কর্টিসল, অ্যাড্রেনালিন ও এপিনেফ্রিন হরমোন স্বাভাবিক মেজাজ ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে।
হরমোন ভারসাম্যহীনতার কারণ
নানা কারণে হরমোনের পরিবর্তন বা ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। ঋতুচক্রের সময় হরমোনের পরিবর্তন স্বাভাবিক। অন্যদিকে, ডিম্বাশয়ের দুর্বলতা বা অকাল মেনোপজ, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড রোগ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, পিটুইটারি টিউমারসহ ক্যানসার ও অটোইমিউন ব্যাধির কারণে হরমোনের মাত্রায় বড় আকারের পরিবর্তন দেখা যায়। প্রজননসংক্রান্ত নানা হরমোনের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা গেলে নানান ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। অনিদ্রা, মেজাজে অনিয়ন্ত্রণ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, ব্রণ, ওজন বৃদ্ধি, ঘুমে অসুবিধা, বিরক্তি, চুল পড়া, অনিয়মিত পিরিয়ডের মতো লক্ষণ দেখা যাবে। অ্যাড্রেনালিন আমাদের শরীরকে চাপ বা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে সাহায্য করে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ ও উদ্বেগের কারণে আমাদের শরীরে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণে সমস্যা হয়। এই হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। মাথাব্যথা থেকে শুরু করে হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। কর্টিসল হরমোনে মাত্রা ঠিক না থাকলে রক্তে শর্করা, মেটাবলিজমের পরবর্তন, প্রদাহসংক্রান্ত জটিলতা দেখা যায়। এতে বিষণ্নতা বাড়ে।
জীবনযাত্রার সংযোগ
এ ছাড়াও নোরেপাইনফ্রাইন হরমোন দুটি কাজ করে। হরমোন হিসেবে কাজের পাশাপাশি নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। এটি শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে স্নায়ুর মাধ্যমে সংকেত পাঠায়। নোরেপাইনফ্রাইন ঘুমের চক্র ও হৃদস্পন্দনসহ বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় শরীরের কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা যায়, নেরোপাইনফ্রিনের মাত্রায় সমস্যা দেখা গেলে হতাশা, উদ্বেগ, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা যায়। নারীদের জীবনযাত্রার মানের ওপরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। খারাপ ঘুমের অভ্যাস, অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ব্যায়ামের অভাব, দীর্ঘসময় ধরে দুশ্চিন্তা ও চাপের মধ্যে জীবনযাত্রার মতো বিষয়গুলো হরমোনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে। নানা ধরনের খাবার যেমন লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ক্যাফেইন, সয়া এবং দুগ্ধজাত খাবারের কারণেও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। থাইরয়েডসহ হরমোন ভারসাম্যহীনতা যেকোনো বয়সে ঘটতে পারে।
সমাধানের উপায়
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারেন। খাবারে সীমিত চিনি ও পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করতে হবে। পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড-সমৃদ্ধ খাবার হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। ডিক্যাফিনেটেড গ্রিন টি ও প্রচুর পানি পান করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। যারা ব্যায়ামের সুযোগ পান না, তারা হাঁটাচলার মাধ্যমে শরীরকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করুন। মানসিক চাপ কমানোর কৌশল হিসেবে মেডিটেশন অনুশীলন করতে পারেন। নারীদের মধ্যে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কমানোর জন্য ভিটামিনযুক্ত প্রাকৃতিক ফল ও শাকসবজি নিয়মিত খেতে হবে। অনিয়মিত পিরিয়ডসহ বিভিন্ন রোগ ও উপসর্গের জন্য আদা বেশ উপকারী। কাঁচা আদা নিয়মিত প্রক্রিয়া করে খেলে আপনার পিরিয়ডে উপকার পাবেন। আদার মধ্যে রয়েছে জিঞ্জেরল, যা শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আদা জরায়ুর পেশী সংকুচিত করতে সাহায্য করে, হরমোনের ভারসাম্যকে সহজ করে। সকালে বা সন্ধ্যায় খালি পেটে এক গ্লাস গরম আদা চা খানিকটা লেবুর রস ও এক চামচ মধু দিয়ে পান করলে মেটাবলিজম বাড়ে। স্বাভাবিক সময়ে, ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার রস আপনার শরীর নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত ওজন কমাতে একটি চমৎকার উপায় হতে পারে। এটি আপনার মেটাবলিজম উন্নত করে, আপনার অন্ত্রের অবস্থাকে সুস্থ রাখে। অ্যালোভেরা আপনার হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। সাবধানে থাকতে পিরিয়ডের সময় অ্যালোভেরা ব্যবহার করবেন না, এর মাধ্যমে জরায়ুর সংকোচন বাড়ার ঝুঁকি থাকে।
তথ্যসূত্র: ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ও হেলথ লাইন
কলি