জাহানারা ইমাম একাত্তরের ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী, শিক্ষাবিদ এবং কথাসাহিত্যিক। সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি সবার কাছে ‘শহিদ জননী’ হিসেবেই অধিক সমাদৃত হয়েছিলেন। তার স্মরণে গড়ে তোলা হয়েছে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর। আগামী ৩ মে এই মহীয়সী নারীর ৯৫তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাদুঘরটি সম্পর্কে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী
রাজধানীর ইস্টার্ন মল্লিকা থেকে একটু সামনেই রাস্তার বিপরীতে সরু গলি। হেঁটে গেলে গলির মাথায় ডান পাশে চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ‘কণিকা’ নামের এক বাড়ি। বাড়িটি শহিদ জননী জাহানারা ইমামের। বাড়ির নামকরণও তিনিই করেছিলেন। তার বড় সন্তান শহিদ শাফী ইমাম রুমী বীর বিক্রম মুক্তিযদ্ধে অংশগ্রহণ করে সফলভাবে গেরিলা যুদ্ধ করেছিলেন। ২৯ আগস্ট রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনির হাতে তিনি ধরা পড়েন। পরবর্তী সময়ে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
১৯২৯ সালের ৩ মে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই শহিদ জননী। পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গই হয় তার স্থায়ী ঠিকানা। তার স্বামী শরীফ ইমাম দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে ১৩ ডিসেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন।
নিখোঁজ ছেলের স্মৃতি রক্ষার্থে এবং মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে তিনি লিখেছিলেন বহুল আলোচিত বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এসব স্মৃতিকে আরও জোরালোভাবে সংরক্ষণের জন্য ২০০৭ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহিদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর’। ‘কণিকা’ নামের বাড়িটি ২০০৩ সালে ভেঙে ফেলা হয়। তারপর সেখানে গড়ে ওঠে বহুতল ভবন। সেই ভবনের দোতলাতেই এই জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছে। জাদুঘর তৈরির পেছনে মূল অবদান জাহানারা ইমামের ছোট সন্তান সাইফ ইমাম জামী এবং রুবিনা হোসেন নামের এক হিতার্থীর। রুবিনা হোসেন প্রজন্ম-৭১-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দুজন মিলে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে জাদুঘরটি সাজিয়েছিলেন। বর্তমানে জাদুঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন ফরিদা ইয়াছমিন (১৩ বছর ধরে) এবং সোহান আহমেদ (ছয় বছর ধরে)। এ ছাড়া আছেন দুজন কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস সহকারী।
নিরিবিলি পরিবেশে ঘরোয়া আবহে তৈরি এ জাদুঘরে গেলে সবারই খুব ভালো লাগবে। দরজা দিয়ে প্রবেশের পর ডান পাশে চোখে পড়বে একটা বড় ছবির ফ্রেম, যেখানে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন দশকে জাহানারা ইমাম দেখতে কেমন ছিলেন সেসব ছবি। সেখানেই রাখা হয়েছে একটা সোফা সেট, যেই সোফাটি মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সাক্ষী হয়ে আছে। একটু চোখ বোলালেই দেখা যাবে, সেই সময়ে জাহানারা ইমামের সংসারে ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব, হারমোনিয়াম, ড্রেসিং টেবিল, তার ব্যবহৃত লেখার টেবিল, ডায়েরি, একাত্তরের দিনগুলি বইয়ের পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ, রিডিং ল্যাম্প, গ্রামোফোন ইত্যাদি। শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম পরিবারের তিন প্রজন্মের সম্পর্কে জানার জন্য টাঙিয়ে রাখা হয়েছে পারিবারিক পরিচিতি। শহিদ জননী যে বিছানায় ঘুমাতেন, সেই বিছানা তার স্মৃতি বুকে নিয়ে জাদুঘরের শোভা বর্ধন করছে। বিছানার পেছনের দেয়ালে বড় করে তার ছবির ফ্রেম রাখা হয়েছে। তার ব্যবহৃত ক্যাসেট প্লেয়ার ও কিছু ক্যাসেট সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। তিনি যেই দর্পণ ব্যবহার করতেন, লাল রঙের ছোট টেলিভিশন দেখতেন, সেসবও আছে।
বুকসেলফে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অমূল্য সব বই। কিছু বই তার স্বরচিত, কিছু বই রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত অনেক বইয়ের সংগ্রহও আছে সেখানে, আরও আছে তার ওপর রচিত বিভিন্ন লেখকের বই এবং পারিবারিক অ্যালবাম।
একাত্তরের ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক ছবি এবং আরও অনেক পারিবারিক ছবি রয়েছে জাদুঘরে। একটা ময়না পাখির ছবিও চোখে পড়বে, যেটি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন চলাকালীন চট্টগ্রামের এক ব্যক্তি তাকে উপহার দিয়েছিলেন। পাখিটি ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জয় বাংলা, গোলাম আজমের ফাঁসি চাইসহ আরও অনেক শব্দ বলতে পারত পাখিটি। ২০০৭-১১ সাল পর্যন্ত মমি আকারে তা জাদুঘরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মীরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্তানে জাহানারা ইমামের কবরের পাশে পাখিটিকে সমাধিস্থ করা হয়।
জাদুঘরের সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক সোহান আহমেদ জানান, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এই জাদুঘর দেখাতে নিয়ে আসা হয়। তখন তাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শোনানো হয়। তরুণ প্রজন্মের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া তাদের অন্যতম লক্ষ্য।
‘কণিকা’ নামের এ বাড়িতে শহিদ বদি, জুয়েল, আজাদ, হাবিবুল আলম আরও অনেকেই যাওয়া-আসা করতেন। জাহানারা ইমাম সর্বতোভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। স্মৃতিবিজড়িত সেই দোতলা বাড়িটি না থাকলেও, এই জাদুঘরে গেলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতির গন্ধই অনুভব করা যাবে। উল্লেখ্য, এই মহীয়সী নারী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে মৃত্যুবরণ করেন।
জাহ্নবী