সুর ভালোবাসলেও যিনি গানকে কণ্ঠে ধারণ না করে বরং বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন, যার পরিবারের ১০ ভাইবোনের প্রত্যেকেরই ছিল গানের সঙ্গে সখ্য। পরবর্তী সময়ে নিজের অদম্য ইচ্ছায় হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার।
জর্জিনা হক। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার শান্তিনগরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তার বাবা ফরমাজুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ।
ড্রাম বাজানোর প্রতি তার ভীষণ আগ্রহ ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ষাট-সত্তরের দশকে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কাজকে ভাবা হতো পুরুষদের কাজ। কোনো নারী ড্রাম বাজাবে, এটা যেন ভাবনারও অতীত। যে কাজটা দেশের কোনো নারী তখন অবধি করেনি বা করার কথা চিন্তাও করেনি, সে সময় তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ের ড্রাম বাজাতেন। তার আগ্রহের পারদ এতটাই ওপরে ছিল যে, ইটভাটায় গিয়ে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে বসে তাদের ইট ভাঙার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ড্রাম বাজানো অনুশীলন করতেন।
তার বড় ভাই আলমগীরের ব্যান্ড ছিল ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’। এ ব্যান্ডের ড্রামার সাব্বির কাদেরের ড্রাম বাজানো দেখে তিনি খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে, যেভাবেই হোক তিনি ড্রাম বাজাবেন এবং খুব ভালো ড্রামার হবেন। তাই তখন থেকেই নানা উপায়ে ড্রাম বাজানোর অনুশীলন করতে থাকেন। রান্নাঘরের বিভিন্ন বাসনপত্রেও অনুশীলন করতেন ড্রাম বাজানোর। এজন্য অবশ্য তাকে সমাজের মানুষ কম কটু কথা শোনাননি। তবে তিনি সেসব তোয়াক্কা না করে নিজের মতো করে ড্রাম বাজানোর চর্চা চালিয়ে গেছেন।
শান্তিনগরে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সে বাড়ি থেকে তখনকার সময় চারটি ব্যান্ড দল তৈরি হয়েছিল। বিখ্যাত গিটারিস্ট নয়ন মুন্সী, যিনি পপ সম্রাট আজম খানের সঙ্গে গিটার বাজাতেন, তিনি ওই বাড়িরই একজন সদস্য ছিলেন। গানবাজনার এমন আবহ দেখে বড় হওয়ার সুবাদেই হয়তো তারও এ ব্যাপারে তীব্র আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
বিএএফ শাহীন স্কুলে পড়ার সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে উঠেছিল শেখ পরিবারের সন্তানদের। তার আগ্রহে মুগ্ধ হয়ে শেখ কামাল তাকে স্পন্দন ব্যান্ডের সঙ্গে অনুশীলন করার পরামর্শ দেন। তারপর তিনি স্পন্দন ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এ কাজে শেখ কামাল তাকে উৎসাহ জোগাতেন সব সময়। ১৯৭২ সালে টিএসসিতে ড্রাম বাজিয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার হিসেবে জনসম্মুখে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার।
তারপর তারা তিন বোন মিলে একটি ব্যান্ড গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। ‘থ্রি হাগস সিস্টারস’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করে ফেলেন। সে সময় বেশ কিছু অনুষ্ঠানে ড্রাম বাজিয়ে প্রশংসা কুড়ান তিনি। হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বেইলি রোডে ড্রাম বাজান তিনি। এ ছাড়া রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কয়েকটি অনুষ্ঠানে ড্রাম বাজিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন তিনি।
একসময় তিনি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখেন। বিয়ে করে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে পাড়ি জমান বিদেশে। স্বামী-সন্তানসহ অনেক বছর দেশের বাইরে কাটে তার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গেলেও নিজের স্বপ্ন আর শখের কাজটাকে তিনি ভুলে যাননি। ড্রাম বাজানোর অনুশীলন চালিয়ে গেছেন সব সময়। কোনো ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করা না হলেও নিজের আগ্রহে তিনি অনুশীলন করেছেন এবং বিশেষ অনুরোধে কিছু কিছু প্রোগ্রামে ড্রাম বাজিয়েছেন। ৪৪ বছর পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি আবার জনসম্মুখে ড্রাম বাজিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। প্রতি বছর ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে টিএসসি-কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে একটি কনসার্টের আয়োজন করে থাকেন ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ শিরোনামে। যেই টিএসসিতে ১৯৭২ সালে ড্রাম বাজিয়ে শুরু হয়েছিল তার নতুন পথচলা, সেই টিএসসিতেই ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ কনসার্টে গিটার বাজিয়ে, ড্রাম বাজিয়ে গান শোনান তিনি। অনেক দর্শক সেদিন মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন তার পারফরম্যান্স। টিএসসির সামনে পায়রা চত্বরে বিজয় দিবসের সেই ওপেন এয়ার কনসার্টের মূল আকর্ষণ যেন তিনিই ছিলেন। দেশের প্রথম নারী ড্রামার বলে কথা।
নারীরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, বয়সের ভারে তিনি তার কাজটা ঠিকভাবে করতে পারবেন কি না। অথচ শরীরে বয়স্ক হলেও মানসিকতার জোরে তিনি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কঠোর অনুশীলন থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব, বয়স সেখানে খুব বেশি বাধা হতে পারে না। সেদিন তিনি ৪৪ বছর আগে টিএসসিতে ড্রাম বাজানোর স্মৃতি এবং প্রথম নারী ড্রামার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অনুভূতির কথাও আবেগাপ্লুত হয়ে শুনিয়েছিলেন সবাইকে। তার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এখনো সেই দিনটার কথা মনে পড়ে। কামাল ভাই (শেখ কামাল) আমাকে স্পন্দন ব্যান্ডের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আর আমি মাথা নিচু করে ড্রাম টিউন করছিলাম। কামাল ভাই আমাকে বলেছিলেন, জর্জিনা মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। কামাল ভাই আজ নেই। সাহস দেওয়ারও কেউ নেই।’ তবে সাহস দেওয়ার কেউ না থাকলেও এবং যথেষ্ট বয়স হলেও তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি কখনো। নিজের স্বপ্নকে লালন করে গেছেন সব সময়। অনুশীলন চালিয়ে গেছেন নিয়মিত। তার একাগ্রতার জন্যই হয়তো এখনো তিনি সমানভাবে দর্শকদের মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন।
জাহ্নবী