নারীরা ঘরের চার দেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে পা রেখেছে বহু আগেই। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলছে। এই অংশগ্রহণ কখনোই মসৃণ ছিল না। সময়ের সঙ্গে প্রতিনিয়তই আমাদের জীবন হচ্ছে জটিল। জটিল হচ্ছে আমাদের পেশাগত জীবনও। আর জটিলতা বাড়ছে আমাদের মনের ঘরেও। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের কারণও দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে কর্মজীবী নারীরা একটু বেশিই ঝুঁকিতে আছেন কর্মজীবী পুরুষের তুলনায়। কর্মজীবী নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি নিয়ে আজকের বিশেষ ফিচার। লিখেছেন ফাতেমা ইয়াসমিন
এক. নুসরাত দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যোগ দিয়েছেন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। থাইরয়েডের কিছু সমস্যাজনিত কারণে স্থূলতার সমস্যায় ভুগছেন তিনি। নুসরাতের স্বামীও বেশ ভালো চাকরি করছেন। বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু চাকরিতে যোগদান করার কিছুদিন পর থেকেই নুসরাত সেই আগের মতো আর প্রফুল্ল থাকছেন না। বাসায় এসেও চুপচাপ থাকেন এবং প্রায়ই শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকছেন। অনেক জিজ্ঞাসা করার পর নুসরাত জানান, অফিসের সিনিয়র নারী সহকর্মী তাকে প্রায়ই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আক্রমণ করেন। যেমন- তুমি এত মোটা কেন? সন্তান হচ্ছে না কেন? স্বামী কি তোমাকে এখনো ভালোবাসে? এমন স্বাস্থ্য থাকলে তো স্বামী চলে যাবে- এ ধরনের আরও নানা কুরুচিপূর্ণ কথা। আরও কিছু সহকর্মী কিছু না বললেও এ বিষয়ে ঠাট্টা করে। ধীরে ধীরে নুসরাত কাজে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। মাঝে মধ্যে স্বামীর সঙ্গেও অল্পতে রেগে যাচ্ছেন। কাজে মনোযোগ না দেওয়ার কারণে অতি মেধাবী নুসরাত অফিসে তার পারদর্শিতা দেখাতে পারছেন না। দিন দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন তিনি।
দুই. আফরোজা আক্তার চাকরিতে আছেন বহুদিন ধরেই। অবিবাহিত আফরোজা থাকেন মা-বাবার সঙ্গেই। ছোট ভাইও চাকরি করছেন। যখন দুই ভাইবোন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছেন, মা ছেলের আরামের নানা আয়োজনই করে দিচ্ছেন। পানি এগিয়ে দেওয়া, খাবারসহ নানা সুবিধা ভোগ করেন ছোট ভাই। কিন্তু আফরোজা নারী বলেই তার দিকে তেমন বাড়তি যত্ন নেয় না পরিবার। যদিও আফরোজার বেতন ভাইয়ের চেয়ে বেশি এবং সে বাড়িতে টাকাও দিচ্ছেন বেশি। বরং মাঝে মধ্যে বাড়ি ফিরে রান্নার কাজটাও তাকে করতে হয়, মা বাড়ি না থাকলে। তার যোগ্যতা ও সাফল্য খুব একটা দাম পাচ্ছে না নিজ ঘরেই। মনে মনে এক ধরনের ক্ষোভ তার আছে। মানসিকভাবেও হতাশ ও বিষণ্নতা কাজ করে তার মধ্যে।
ওপরের দুটি ঘটনা থেকেই আমরা দেখি দুজন কর্মজীবী নারী তার কর্মক্ষেত্র ও ঘর দুই জায়গাতেই কোনো না কোনোভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। দেশের কোটি কোটি নারীর একই অবস্থা অথবা আরও বাজেভাবে মানসিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন।
গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে তার দায়িত্বটুকু পালন করতে পারেন না। এই বিষণ্নভাব গড়ে প্রায় ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট করছে। কিন্তু দেখা গেছে বিষণ্নতায় আক্রান্ত ৫০ শতাংশ কর্মী চিকিৎসাসেবা নেন না। কারণ মানসিক সুস্থতার বিষয়টিকে মানুষ এখনো তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও ভয়াবহ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১৮ দশমিক ৭ ভাগ লোক কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন এবং যেখানে নারীদের আক্রান্তের হার ২১ শতাংশ, সেখানে পুরুষরা ১৫ ভাগ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। দিন দিন নারীদের মানসিক সমস্যাগুলো আরও প্রবল হচ্ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশের কর্মক্ষেত্র এখনো শতভাগ নারীবান্ধব আমরা করতে পারিনি। লিঙ্গবৈষম্য, পক্ষপাত, যৌন হয়রানি, নিরাপত্তার অভাব, অবকাঠামোগত সমস্যা, যাতায়াতের অব্যবস্থাপনা এসব তো রয়েছেই। অনেক অফিসে কাজ করার জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকে না। এ রকম বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে নারীকে কাজ করতে হয়। ফলে নারী মানসিক চাপ, হতাশা, অতিরিক্ত ও অহেতুক চিন্তা, বিষণ্নতায় ভুগেন। তিনি আরও বলেন, এই অবস্থার উত্তরণ তখনই সম্ভব যখন কর্মক্ষেত্রগুলো নারীবান্ধব হবে। কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করা কর্তৃপক্ষের কাজ। নারীর শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সময়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে স্বচ্ছ ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। কারও মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা আচরণজনিত সমস্যা দেখা দিলে সেটি নিয়ে তার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেঘলা সরকার বলেন, আমাদের দেশে এখনো মনে করা হয় যে নারী চাকরি করছে তার পুরো কৃতিত্বই হলো পুরুষের, কারণ পুরুষ কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। আর নারীদের মনে এমন একটা ধারণা যে, যেহেতু আমি কাজ করছি তাই ঘরের কাজের কোনো ভুলের দায়ভার মূলত নারীকেই নিতে হবে। ফলে ঘরে-বাইরে দশভুজা হতে গিয়ে নারী দিন দিন মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন।
আমাদের সমাজটা পিতৃতান্ত্রিক, তাই কোনো মেয়ে ভালো কিছু করছে বা করতে পারবে- এই ব্যাপারটা সহজে মেনে নিতে পারে না সমাজ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, অব্যবস্থাপনা সবকিছুই এখনো নারীর জীবনকে কঠিন করছে। নারী চাকরি করবে, এটা হয়তো অনেক পরিবারে এখন সহজ বিষয়। অনেক পরিবার হয়তো গর্বও বোধ করছে। কিন্তু অফিস থেকে ফিরে আবার পরিবারের সব দায়িত্ব নারী একাই নেবে, এই মানসিকতাও এখনো রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ঘরে বাইরে ছুটে নারীর অবসর আর কোথাও নেই।
তিনি আরও বলেন, এই অবস্থা থেকে নারীকেই বের হয়ে আসতে হবে। প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। শুধু টাকা উপার্জন করলেই স্বাধীনতা আসে না। স্বাধীনতাবোধ থাকতে হবে নিজের ভেতর। নিজেকে শক্ত করে তৈরি করতে হবে। নিজের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, সেসব বিষয়কে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা, একমাত্র নারীর নিজের মানসিক শক্তিই পারবে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। নিজের শরীর ও মনের যত্ন নিতে হবে। বাইরে ঘুরতে যেতে হবে। অবসরে একটু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে। এগুলো নিজেকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। আর কর্মক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
দেশের যেখানে অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, সেখানে তাদের ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার তাদের মানসিকভাবে সমস্যায় রেখেও কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই কোনো কর্মজীবী নারীকে বিষণ্ন দেখলে শরীর ভালো আছে কি না জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে মনের অবস্থার খবরও নেওয়া উচিত। মনের শরীর ভালো আছে তো?
জাহ্নবী