‘নগর বন’ কার্যক্রমের উদ্যোগ বুশরার । খবরের কাগজ
ঢাকা ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

‘নগর বন’ কার্যক্রমের উদ্যোগ বুশরার

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ০২:২০ পিএম
‘নগর বন’ কার্যক্রমের উদ্যোগ বুশরার
বুশরা আফরিন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকাতে তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আধুনিকায়নের নামে শুধু কংক্রিটের বড় বড় বিল্ডিং তোলা হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে প্রাণহীন নগর। গাছপালার অভাবে তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এশিয়ার প্রথম চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেলেন বুশরা আফরিন। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দায়িত্বরত।

চিফ হিট অফিসার পদটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার। তাদের লক্ষ্য, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষকে অসহনীয় তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করা। চিফ হিট অফিসারের প্রধান দায়িত্ব মানুষের ভেতর তাপমাত্রা নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। এ ছাড়া তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন উদ্ভাবনী সমাধানের প্রতি ওই শহরের মেয়র ও স্থানীয় সরকারের আগ্রহের বিষয়টাও তারা গুরুত্ব সহকারে দেখে থাকেন।

বুশরা বলেন, ‘সবাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সবার জন্য শীতল ও আরও সমতার একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চাই।’ কাজে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। এবার তিনি রাজধানীর চরম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ‘নগর বন’ কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছেন। শহরে সবুজায়ন বাড়ানোর এ উদ্যোগে তিনি নগরবাসীকে যুক্ত করতে চান।

তিনি বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো হচ্ছে না, পানি ব্যবস্থারও ঠিকঠিকানা নেই। জলাধার ভরাট করে ফেলার ফলে গরম বেশি। নতুন ভরাট করা অঞ্চলে কোনো গাছপালা নেই। বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ হওয়া নানা বিষাক্ত পদার্থ তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে ফেলছে। যেখানে গাছ কম, অনেক বিল্ডিং, খোলা জায়গা নেই, প্রচুর মানুষের বসতি, সেখানেই প্রচণ্ড গরম। এসব স্থানের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা নীতি পরিবর্তন দরকার, কিছু নিয়ম তৈরি দরকার, নগরায়ণ নিয়ে আমাদের যে ধারণা রয়েছে, তার পরিবর্তন দরকার।’

আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং আরও কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেশকিছু কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এর মধ্যে ‘নগর বন’ একটি পাইলট প্রজেক্ট। কল্যাণপুর ও বনানীতে নগর বন তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি; যা পরিবেশ শীতল করার পাশাপাশি বায়ুদূষণ রোধ ও মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করবে। তিনি আরও জানান, ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে দেশি প্রজাতির গাছ বাড়ানো হচ্ছে এবং এ বছর নতুন করে আরও পাঁচ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।’

নগর বনের কাজে তিন নগরের দায়িত্বশীল মানুষ ছাড়াও শিশুদেরও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছেন। কারণ, শিশুরা পরিবেশের গুরুত্ব বোঝে না, তাদের দ্বারাই গাছপালা বেশি নষ্ট হয়। তাই শিশুরা যদি এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারে, তাহলে নগর বন প্রজেক্ট সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি থাকবে। তাছাড়া আজকের শিশুরাই তো আগামী দিনের শহরকে বাসের উপযোগী করে তোলার দায়িত্ব নেবে।

জাহ্নবী

 

ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয় কর্মজীবী নারীকে

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ০১:০৭ পিএম
ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয় কর্মজীবী নারীকে
মডেল: আতিয়া সুলতানা ও আইমান কৃতী। ছবি: শরিফ মাহমুদ

সন্তান লালন-পালন করা খুব কঠিন কাজ। তার ওপর মা যদি কর্মজীবী হন, তাহলে তা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। তাকে একই সঙ্গে সংসার, সন্তান এবং  কর্মক্ষেত্র সামলাতে হয়। স্বাবলম্বী হতে ও বর্তমান ব্যয়বহুল জীবনব্যবস্থার জন্য মায়েরা কাজ করেন। কর্মজীবী মায়েদের সেই সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন ইসরাত জাহান চৈতী

শায়লা জামান (ছদ্মনাম) দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে যোগ দেন বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে যোগদান করেন কর্মক্ষেত্রে। সন্তানের জন্য অসীম মমতাকে একপাশে ফেলে শুরু হয় আট ঘণ্টার কর্মজীবন। একই সঙ্গে শুরু হয় জীবনের অন্যতম কঠিন যুদ্ধ। সন্তান সামলে অফিস করার পথে শুধু সন্তানের প্রতি মায়া নয়, আস্তে আস্তে বাধা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে পরিবারের পাহাড়সম কাজের দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করতে না পারার আক্ষেপ কিংবা অফিসের কাজের বিশাল চাপ। স্বামী, সংসার, সন্তান একত্রে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে খেতে শেষমেশ নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয় শায়লা জামানকে। বর্তমানে তিনি চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী।

শুধু শায়লা নন, আমাদের দেশের বহু  নারী একসঙ্গে সন্তান-সংসার-চাকরি সামলিয়ে উঠতে পারেন না। যদিও অনেকে আবার নানা প্রতিকূলতার মাঝেই চালিয়ে যাচ্ছেন সবকিছু। তবে তাদের অনেককেই মাঝে মধ্যে বলতে শোনা যায় ‘আর ভাল্লাগে না! এত চাপ নিতে পারি না, চাকরি ছেড়ে দেব।’

বাস্তবতা আসলেই কঠিন। একজন মায়ের জন্য সংসার, সন্তান, কর্মক্ষেত্র একসঙ্গে সামাল দেওয়া মোটেও সহজ কোনো বিষয় নয়। আমাদের দেশে কর্মজীবী মায়েদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূলতা।

‘আমি নারী, আমি সব পারি’ আমাদের বিদ্যমান সমাজ কাঠামোতে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত এ স্লোগানের সবসময় বাস্তবায়ন ঘটাতে হয় নারীদের। আর বিজ্ঞাপনের এই স্লোগানের ব্যতিক্রম কেউ ঘটালে সমাজ, পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে বিন্দু পরিমাণ ভুল করে না। আর সে ভুল শুধরাতে অনেককে আবার শায়লা জামানের মতো নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিতেও দেখা যায়।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পরিবারে শিশুর দেখাশোনার বিষয়টি এখনো মা-বাবা উভয়ের কাজ বলে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই শিশুর নিরাপত্তা আর দেখভালের প্রশ্নে বারবার মাকেই সমঝোতায় আসতে হয়। সন্তান লালন-পালনের জন্য চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে মাকেই আপস করতে হয়। ফলে অনেক নারীই স্বাবলম্বী হতে পারছেন না। পর্যাপ্ত শিক্ষা অর্জন করা সত্ত্বেও তাদের শুধু সংসার আর সন্তানই সামলাতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখতে পারছেন না।

এরপরও নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা তাদের আসন পাকাপোক্ত করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। সময় বদলে গেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। ফলে শুধু পরিবার নয়, কর্মক্ষেত্রেও নারীর উপস্থিতি এখন অনেকটা ধ্রুবতারার মতোই সত্য। মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, চিকিৎসা, প্রকৌশল, গার্মেন্টস, কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, ক্রীড়াঙ্গন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন কিংবা সাংবাদিকতা- এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর পদচারণা নেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর  (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩-এর চতুর্থ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ৭ কোটি ১১ লাখ। এর মধ্যে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৪ লাখ। অন্যদিকে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ।

তবে বাস্তবতা হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেভাবে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল অবকাঠামো। নানা ধরনের প্রতিকূলতা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতা। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় দেশের কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মায়ের শিশুদের জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ছয়টি।

অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর সংশোধনীর ৯৮ ধারায় শিশুকক্ষ বিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। এতে উল্লেখ রয়েছে, কোনো অফিসে ৪০ জন বা এর বেশি নারী কর্মরত থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী সন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশুকক্ষ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ৪০ বা এর বেশি নারীকর্মী থাকলেই ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে?

অন্যদিকে যেসব অফিসে ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে, সেখানেও রয়েছে নানা ধরনের জটিলতা। মায়েদের অভিযোগ পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় তাদের সন্তানদের দেখভাল নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়। খাবারের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে শিশুরা নানা ধরনের জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়।

বর্তমানে রাজধানীতে বেসরকারিভাবে মানসম্মত বেশকিছু ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলোয় ব্যয় বহন করার সামর্থ্য অধিকাংশের নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদন মতে, মধ্যম মানের বেসরকারি কেন্দ্রে ভর্তি বাবদ লাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং মাসে ফি হিসেবে গুনতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। যদিও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন-২০২১-এর খসড়া বিধিমালায় বেসরকারি ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক ফি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ডে-কেয়ার সেন্টারেই নির্ধারিত ফির বাইরেও সরবরাহ করতে হয় শিশুর খাবার, ডায়াপারসহ নানা সামগ্রী। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহন করতে পারেন না ডে-কেয়ারের বাড়তি খরচ।

এ ছাড়া রয়েছে সন্তান নিয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারে যাতায়াতের অসুবিধা। আমাদের দেশে অফিস থেকে পরিবহন সেবা পান এমন কর্মীর সংখ্যা বলা চলে হাতেগোনা। তাই যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই কিংবা অফিস থেকে পরিবহন সেবা পান না, তাদের সন্তানের জন্য দূরবর্তী ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা চিন্তা করা প্রায় অকল্পনীয়।

এ ছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরিচালিত ডে-কেয়ার সেন্টারের সুযোগ আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। ফলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মায়ের ক্ষেত্রে চাকরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

ডে-কেয়ার সুবিধা না পাওয়া কর্মজীবী মায়েদের একমাত্র ভরসা পরিবার। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরের ফলে সেখানেও দেখা দিয়েছে নানা সংকট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের দেখাশোনার ভার পড়ে গৃহপরিচারিকার ওপর। যদিও গৃহপরিচারিকার কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করা মায়েদের জন্য প্রায় অসম্ভব। কেননা, শিশু মায়ের কোল ছাড়া হওয়া মানেই অনিরাপদ। এ ছাড়া শিশুর যথাযথভাবে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রেও তৈরি হয় নানা সংকট। অনেক ক্ষেত্রে গৃহপরিচারিকার কাছে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হয় শিশুরা। এর জন্যও আবার দায়ী করা হয় সেই কর্মজীবী মাকেই।

অন্যদিকে, মায়েরা চিন্তা করেন সন্তান একটু বড় হলে হয়তো তাদের কষ্টের অবসান হবে। কিন্তু না, সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভালো স্কুলে পড়ানো, ভালো পরিবেশে রাখা, সন্তানের সুস্থতা, শারীরিক-মানসিক বিকাশ ইত্যাদি অধিকাংশই দেখতে হয় মাকে। যদিও এর ব্যতিক্রমও আছে। কিছু পরিবারে মায়ের পাশাপাশি দায়িত্ব ভাগ করে নেন বাবা বা পরিবারের অন্য সদস্য। তবে এ সংখ্যা নিতান্তই কম। অনেক বাবা মনে করেন অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া পর্যন্তই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। কিন্তু একজন মা তা মনে করতে পারেন না। অফিস শেষে নিতে হয় সন্তান, পরিবারকে ভালো রাখার দায়িত্ব। ফলে একজন বাবার দায়িত্ব কিছু সময়ের জন্য শেষ হলেও মায়ের দায়িত্ব কখনো শেষ হয় না।

ফলে শুধু যে ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরির মাধ্যমেই কর্মজীবী মায়েদের চলার পথ মসৃণ হবে, তা কিন্তু নয়। অনেক কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় ইচ্ছাকৃতভাবে কর্মজীবী মায়েদের বাড়তি চাপে রাখা হয়। যদিও উন্নত বিশ্বে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া রয়েছে পর্যাপ্ত যানবাহনের অভাব, কর্মক্ষেত্রে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরিবারে যথাযথ সহযোগিতার অভাব, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের অভাব। সন্তান দেখভালের দায়িত্ব শুধু মায়ের, হোক সে কর্মজীবী বা গৃহিণী। আবার সন্তানের কোনো সমস্যা হলে মাকেই দোষারোপ করা হয়।

এই সংকটগুলো প্রতিকার এবং প্রতিরোধ করা না গেলে বাংলাদেশ যতই উন্নয়নের রোড মডেল হোক না কেন, অর্থনীতিতে কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণ তেমন মসৃণ হবে না। ফলে তাদের চলার এই বন্ধুর পথকে সুন্দর করতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। সর্বোপরি সন্তান লালন-পালন শুধু মায়ের দায়িত্ব এমন ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে কমে আসবে কর্মজীবী মায়ের সংকট।

জাহ্নবী

ল্যুভর মিউজিয়ামের প্রথম নারী পরিচালক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
ল্যুভর মিউজিয়ামের প্রথম নারী পরিচালক
লরেন্স দেজ কার্স

১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রতিষ্ঠিত হয় ল্যুভর মিউজিয়াম। জাদুঘরটি মোনালিসার চিত্রকর্মের জন্য বহুল পরিচিত। এ ছাড়া আরও হাজারো চিত্রকর্ম রয়েছে সেখানে। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক আসে জাদুঘর পরিদর্শন করতে। কিন্তু এই জগৎবিখ্যাত জাদুঘরে প্রতিষ্ঠার ২২৮ বছরেও কোনো নারী পরিচালক আসেননি। ২০২১ সালের ২৬ মে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ লরেন্স দেজ কার্সকে ল্যুভের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ফ্রান্সের শীর্ষ সব রাষ্ট্রীয় জাদুঘর যেমন- ল্যুভ, মুজি দোর্সে, শ্যাতু দে ভ্যার্সাই ও পম্পিদু মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম ইত্যাদির প্রধানদের নিয়োগে সরাসরি যুক্ত থাকেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।

লরেন্স উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলাবিষয়ক ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞ। জাদুঘরে যোগদানের সময় তার বয়স ছিল ৫৪ বছর। ল্যুভর মিউজিয়ামে যোগদানের আগে প্যারিসের আরেক বিখ্যাত জাদুঘর ‘মুজি দোর্সে’তে প্রধান হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ওই জাদুঘরেরও প্রথম নারী প্রধান ছিলেন লরেন্স, যা ল্যুভর মিউজিয়ামের কাছেই অবস্থিত। মুজি দোর্সে জাদুঘরের পরিবর্তন ও বৈচিত্র্যে বড় ধরনের ভূমিকা রাখার কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাকে।

২০১৯ সালে লরেন্সের নেতৃত্বে জাদুঘরটির ‘ব্ল্যাক মডেলস: ফ্রম জেরিকোল্ট টু ম্যাটিস’ নামে একটি প্রদর্শনী সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছিল ফ্রান্সে শিল্পকলার পুরোধাখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ মডেলদের, আধুনিক বিশ্ব যাদের নাম ভুলতে বসেছে। প্রদর্শনীটি লরেন্সের সময়কালে মুজি দোর্সের সবচেয়ে আলোচিত আয়োজন হিসেবেও সুনাম কুড়ায়। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীর অস্ট্রিয়ান চিত্রশিল্পী গুস্তভ ক্লিমতের আঁকা একটি ছবি ১৯৩৮ সালে নাৎসি বাহিনীর কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল একটি ইহুদি পরিবার। ছবিটি মুজি দোর্স জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল। লরেন্সের নেতৃত্বেই ছবিটি ওই পরিবারের উত্তরসূরিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

শিল্পের মাধ্যমে সামাজিক ইস্যু প্রকাশ ও প্রচারের জন্য তিনি বেশ পরিচিত। লরেন্স বলেন, ‘সামাজিক বিতর্কগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষার মাধ্যমেই কেবল নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে জাদুঘরগুলো। একটি জাদুঘরের প্রদর্শনীতে সমাজের বড় ইস্যুগুলো প্রতিফলিত হওয়া উচিত। আর এভাবেই সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বয়সের নতুন প্রজন্মের দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে হবে’।

লরেন্স আরও বলেন, ‘একটি অসাধারণ জাদুঘরকে অবশ্যই ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হবে। তার মধ্যে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর বিষয়টিও রয়েছে’। মূলত শিল্পকলার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন বলেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ তাকে ল্যুভর মিউজিয়ামের প্রধান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত মনে করেছিলেন।

জাহ্নবী

কেরানীগঞ্জের নারী মুক্তিযোদ্ধা শরিফুন্নেসা

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ০১:০২ পিএম
কেরানীগঞ্জের নারী মুক্তিযোদ্ধা শরিফুন্নেসা

‘আমাদের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। পরিবার ও যোদ্ধাদের কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন, বর্বরতার কথা শুনে রাগে-ক্ষোভে জ্বলে উঠতাম। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যুদ্ধে যাব। এসব জুলমকারীকে হয় মারব, না হয় মরব। মৃত্যুর ভয় তখন একেবারেই ছিল না। পাকিস্তানি সেনাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রবল ইচ্ছা থেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতি মনে করে এসব কথা বলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা শরিফুন্নেসা। বর্তমানে তার বসবাস কলাতিয়া ইউনিয়নের আলিনগর গ্রামে। একই ইউনিয়নের আহাদিপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে চারদিকে যখন যুদ্ধের দামামা বাজছে শরিফুন্নেসা তখন ২১ বছরের তরুণী। যুদ্ধের প্রথম দিকে তাদের বাড়িতে গিয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা চার দিন থেকে চলে যান ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে। পরে ধীরে ধীরে তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে থাকেন আরও অনেক যোদ্ধা।

শরিফুন্নেসা ছিলেন বাড়ির বড় মেয়ে। তাদের বাড়ির পাঁচটি সেমিপাকা টিনশেড ঘরের চারটিতেই থাকতেন মুক্তিযোদ্ধারা। বাকি একটি ঘরে মামা-বাবা, ছোট চার নাবালক ভাই ও আত্মীয়দের নিয়ে গাদাগাদি করে থাকতেন শরিফুন্নেসারা। রাতের আঁধারে শরিফুন্নেসাদের বাড়িতে যেতেন যোদ্ধারা। তাদের দেওয়া হতো খাবার ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। জুলাই মাস থেকে শুরু হয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে এই প্রশিক্ষণ। শরিফুন্নেসার বাবা মোবারক হোসেনও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার বাবা আগেই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। তাদের বাড়ির চারপাশ টিনের বেড়া ও গাছপালায় ঘেরা ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। ভেতরে কী হচ্ছে, তা বাইরে থেকে বোঝা যেত না। কোনো কোনো যোদ্ধা শরিফুন্নেসাদের বাড়িতে গিয়ে জানাতেন, সাত দিন ধরে ভাত খাননি তারা। তাদের খাবার দেওয়া হতো। কোনো যোদ্ধাকে খালিমুখে ফিরে যেতে হয়নি তাদের বাড়ি থেকে। যোদ্ধাদের জন্য প্রতিদিন রান্নার বিশাল আয়োজন করা হতো। তবে শরিফুন্নেসা ও তার মায়ের পক্ষে এত মানুষের রান্না করা সম্ভব হতো না বলে সহযোগিতার জন্য তাদের বাড়িতে রাখা হয়েছিল খালা, মামিসহ চার বিশ্বস্ত আত্মীয়কে। গোপনীয়তার স্বার্থে এসব আত্মীয়ও বাড়ির বাইরে যেতেন না।

এত সংখ্যক যোদ্ধার খাবারের জোগান দিতে বেগ পেতে হতো না। কারণ বেশ অর্থ-সম্পদের মালিক ছিলেন তারা। সে সময় তার বাবা মোবারক হোসেনও পেতেন মোটা অঙ্কের পেনশন। পুরান ঢাকা, নবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেন মুক্তিসেনারা। সবকয়টি ঘর অস্ত্রবোঝাই ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ও তারা মিলে সেগুলো পরিষ্কার করতেন।

তৎকালীন ঢাকা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোস্তফা মহসিন মন্টু শরিফুরন্নেসাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে মূল নেতৃত্ব দেন। এ সময় তার কাছ থেকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন শরিফুন্নেসা। এসএলআর, এসএমজি, রাইফেল, স্টেনগান- এসব অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এই বীর নারী। এক সময় বাবা-মামা ও অন্য যোদ্ধাদের পিছু নিয়ে চলে যান তুলসীখালী ঘাট এলাকায় যুদ্ধ করতে। রাতে যুদ্ধ করে রাতেই বাড়ি ফিরতেন।

গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন শরিফুন্নেসা। সাহসিকতার সঙ্গে একাধিকবার সম্মুখযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা বহুবার পিছু হটতে বাধ্য হয়। বাবা-মা কখনো যুদ্ধে যেতে বাধা দেননি তাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তারা জানতে পারেন, ধলেশ্বরী নদীতে লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসছে পাকবাহিনী। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শরিফুন্নেসাও দ্রুত অপারেশনে চলে যান। দীর্ঘ সময় ধরে পাকসেনাদের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি চলে। তারা ক্রলিং করে যাওয়ার সময় অসাবধানতায় মাথা কিছুটা উঁচু করতেই পাকসেনাদের গুলিতে শহিদ হন ওমর নামের এক মুক্তিযোদ্ধা। ওমর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা শরিফুন্নেসা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ায় এত বেশি খুশি হয়েছিলাম যে, আকাশের দিকে তাক করে অনেকগুলো গুলি ছুড়েছিলাম।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী মুক্তিযোদ্ধা শরিফুন্নেসা। বড় ছেলে দেওয়ান মাজহারুল আলম তাদের সঙ্গে বাড়িতে থাকেন ও ব্যবসা করেন। মেজো ছেলে দেওয়ান সিদরাতুল আলম আমেরিকায় থাকেন। ছোট ছেলে দেওয়ান সাব্বির আলম খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে হাতে গুরুতর আঘাত পাওয়ায় খেলাধুলা ছেড়ে তিনিও আমেরিকায় চলে যান। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই।

বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন সাহসী এই যোদ্ধা। বয়স হয়েছে ৭৪ বছর। বর্তমানে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন তিনি।

শরিফুন্নেসা বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলতে চাই, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৎ থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। মনের দীনতাই বড় দীনতা, তাই বড় করতে হবে মনটাকে। তাদের সাহসী হতে হবে। তরুণরা দেশকে ভালোবাসবে। তাদের জানতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। আমি চাই, তারা যেন সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।’

শুধু তরুণ নন, সবাই যেন দেশকে ভালোবেসে, ভালো মনের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারেন- এমনটাই প্রত্যাশা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শরিফুন্নেসা।

জাহ্নবী

সেবামূলক পেশা নার্সিংয়ে নারীরাই এগিয়ে

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ০১:০১ পিএম
সেবামূলক পেশা নার্সিংয়ে নারীরাই এগিয়ে
ছবি: শরিফ মাহমুদ

দিনের পর দিন অসীম ধৈর্য নিয়ে পাশে থেকে, সেবা করে যারা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন তারাই সেবিকা। সেবা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। জনসেবা, সমাজসেবা, মানবসেবা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। কিন্তু একজন সেবিকার সেবা মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে তা খুব ধৈর্যেরও কাজ। ডাক্তারের চেয়ে সেবিকার সেবা কোনো অংশে কম নয়। সাধারণত নারীরাই এ পেশায় যুক্ত থাকেন বেশি। বাংলাদেশে নার্সিং পেশায় থাকাদের ৯০ ভাগই নারী। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর বলছে, নারী জাতি মমতাময়ী, এজন্যই তাদের সেবার মহান এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আধুনিক নার্সিং পেশার অগ্রদূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নিজেও মনে করতেন, নার্সিংটা মেয়েদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তাই তিনি নার্সিংয়ের প্রাথমিক শিক্ষাটা শুধুমাত্র নারীদের জন্যই শুরু করেছিলেন।

জনসংখ্যা অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নার্স ঘাটতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে যে পরিমাণ সেবক বা সেবিকা দরকার, বরারবরই তার ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি ইসমত আরা পারভীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে নার্স আছেন মাত্র ৬জন; যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকমেন্ডশন ২৩ জন। সরকারি হাসপাতালে নার্সের ৪৫ হাজার ৯৬৫টি পদ (সেবা ও শিক্ষা) থাকলেও কর্মরত রয়েছেন ৪১ হাজার ৯৬১ জন (৯ম ও ১০ম গ্রেড সহ)। এখনও বাংলাদেশে ২ লক্ষ নার্স ঘাটতি রয়েছে’। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে নার্সিং খাতে অবশ্যই নজর দিতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে অব্যবস্থাপনা থাকলে কখনোই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তাই নার্সদের জন্য উপযোগী কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। অনেক সময়ই নারী নার্সরা বুলিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। রোগী কিংবা রোগীর আত্মীয়স্বজনের কটু কথার শিকার হন তারা। কর্মস্থলে নারী নার্সদের জন্য  অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি এবং তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। বেশিরভাগ হাসপাতালেই খাবার রুম, ড্রেসিং রুম, ওয়াশ রুমের পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা থাকে না। এতে নারী নার্সদের সমস্যা হয়।

জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বাইরে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না। নার্সিংয়ের কাজটি খুব ধৈর্যের সঙ্গে করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগীদের সেবা করা, সামলানোর দায়িত্ব পালন করা, তাদের মন উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করা, তাদের নানাবিধ উপদেশ দেওয়া- এসব করতে করতে নার্সরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যদি তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হন, তাহলে তাদের মন-মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে, তারা ধৈর্য হারাতে পারে; যা রোগী ও নার্স উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ইসমত আরা পারভীন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে নার্সদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবে সুযোগ সুবিধা আরও বাড়াতে হবে এবং শিক্ষকদের বিষয় অনুযায়ী পদ তৈরি করা জরুরি। এছাড়া প্রতিটি হাসপাতালে জার্নাল ক্লাব থাকা খুবই দরকার’।

আর এসবের আগে প্রয়োজন নার্সিং শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনা নির্মূল করা। নার্সিং কারিকুলামকে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল ডিজিএনএমএসের সহযোগিতায় দক্ষ নার্স ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ কারিকুলাম কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। বেতন বাড়াতে হবে। পদোন্নতি না হলে, বেতন বৃদ্ধি না পেলে তারা হতাশায় ভুগতে থাকেন। যদিও দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্স থেকে সিনিয়র স্টাফ নার্স ও সুপারিনটেনডেন্ট এবং নার্সিং ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষক হওয়ার সুযোগ আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই।  অনেক হাসপাতালেই ট্রেনিং বিহীন ভুয়া নার্স দিয়ে সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। এসব নিবন্ধনবিহীন নার্সদের জন্য রোগীদের ভুক্তভোগী হতে হয়। নার্সিং খাতে উন্নয়ন করতে চাইলে সরকারকে সরকারি, বেসরকারি সবদিকেই সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

এ ছাড়া নার্সদেরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া খুব জরুরি। না হলে এই মহান পেশা তার সৌন্দর্য হারাবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নার্সরা রোগীদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে কাগজপত্র, ফাইল লেখালেখি করে, যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র দেখাশোনা করে এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন। আর এখন তো সময় কাটানোর অনেক মাধ্যম আছে। ফেসবুক, টিকটক, ওটিটি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সময় ব্যয় করে থাকেন তারা।

রাজধানী শহরের একটি স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা এক রোগীর আত্মীয় অভিযোগ করেন, সেখানের আইসিইউতে দায়িত্বরত নার্সরা ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ ছাড়া অন্য নার্স বা সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করে সময় কাটান। অথচ তাদের উচিত সবসময় রোগীদের ওপর খেয়াল রাখা। কেননা আইসিইউতে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ রোগীরাই থাকেন, তাদের সঙ্গে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকতে পারেন না, শুধু রোজ এক থেকে দুবার ভিজিটিং আওয়ারে তারা দেখা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে একজন রোগীর সব প্রয়োজন দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়ে নার্সের ওপর। কিন্তু তারাই যদি এমন দায়িত্বহীন আচরণ করেন, তাহলে তা রোগীর জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া অনেক নার্সেরই আচরণ ভালো থাকে না। রোজ রোগীর সেবা করতে করতে হয়তো তারা বিরক্ত হয়ে যান। কিন্তু এ পেশায় তো ধৈর্য রাখতেই হবে।

নার্সিং পেশার উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে এবং নারীদের জন্য নিরাপদ ও উপযোগী কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে চাইলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ  নেওয়া যেমন দরকার, তেমনই নার্সদেরও আরও ধৈর্যশীল ও নিবেদিতপ্রাণ হওয়াটা জরুরি।

জাহ্নবী

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাচ্ছেন আঁখি

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাচ্ছেন আঁখি
স্বনির্ভর সুন্দরবন গড়ার লক্ষ্যে নোনাভূমির উঠোন বৈঠকে আঁখি সিদ্দিকা

চলতে চলতেই পথ তৈরি করেছেন তিনি। তাই কোনো বাধাই তার কাছে বাধা নয়। নিজেকেও এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে অন্যের জন্য কিছু করা যায়। তা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। একে তো তিনি ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। তার ওপর মাত্র আট মাস বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। শারীরিক অবস্থা মেনে নিয়েই ছোটবেলা থেকে আঁখি সিদ্দিকা নিজেকে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন মায়ের সহযোগিতায়। এই সংগ্রামী নারীর গল্প জানাচ্ছেন সুলতানা লাবু

নিজেকে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে তৈরি করা
পরিবারে সবার অমতে স্কুলে ভর্তি করালেও পঞ্চম শ্রেণির পর লেখাপড়া বন্ধের সিদ্ধান্ত এল। তাকে লেখাপড়া করানো মানে অহেতুক টাকা-পয়সা নষ্ট করা। অথচ রেজাল্ট তার বরাবরই ভালো। সবসময় ক্লাসে প্রথম হতেন। তবুও বন্ধ হয়ে গেল লেখাপড়ার খরচ। কিন্তু লেখাপড়া তিনি বন্ধ করলেন না। খরচ জোটাতে নেমে পড়লেন মা-মেয়ে। কাগজের খরচ বাঁচাতে প্রথমে পেনসিল দিয়ে খাতায় লিখতেন। তারপর এর ওপর কলম দিয়ে লিখতেন। খাতার ব্যবহার কিন্তু তখনো শেষ হয়নি। সেই কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করতেন। সে টাকা দিয়ে আবার নতুন খাতা কেনা হতো। ধীরে ধীরে ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকলেন। খরচও বাড়তে থাকল। যা আয় হতো তা দিয়ে লেখাপড়ার পুরো খরচ চলছিল না। তাই বাড়ির বারান্দায় তিনটা বেঞ্চ পেতে চক আর ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে একটা কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থা করলেন। সাইন বোর্ডে বড় করে লিখলেন ‘আত্মবিশ্বাস কোচিং সেন্টার’। সঙ্গে একটা স্লোগানও লিখে দিলেন। ‘মেধা তোমাদের, বিকশিত করার দায়িত্ব আমার’। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। কোচিং থেকে প্রথম আয় হলো ১০ টাকা। কোচিংয়ের আয় দিয়ে চলতে লাগল নিজের খরচ। সেই সঙ্গে ছোট বোনের খরচ, বাগান করার খরচ, এমনকি ছয়টি মুরগিও কিনে ফেললেন। দশম শ্রেণিতে উঠে মায়ের সঙ্গে সেলাই শিক্ষা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে কিনে ফেললেন সেলাই মেশিন। মাছ আর মুরগির খামারের ওপর একটা প্রশিক্ষণও নিয়ে ফেললেন তিনি। তার এগিয়ে চলার খবর জেনে গেল সিটি করপোরেশন। আর তখনই তিনটি স্কুলের দায়িত্ব পেলেন তিনি। একটি হলো বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র- ‘মুকুলিত খুলনা’, একটি হার্ড টু রিচ প্রোগ্রামের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের, আরেকটি হলো একটি এনজিওর পথশিশুদের স্কুল। বাড়িতে ঘর তুলেই স্কুলগুলো চালাতে শুরু করলেন। আর নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন।

স্বনির্ভর সুন্দরবন গড়ার লক্ষ্যে নোনাভূমির উঠোন বৈঠকে আঁখি সিদ্দিকা

 

শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করা
নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কাজটিও শুরু করেছিলেন নিজের ঘর থেকেই। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া ছোট বোনোর লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে ভর্তি করালেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাকি ভাইবোনদেরও একে একে বাংলা মিডিয়ামের সাধারণ লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনলেন। অনার্স প্রথমবর্ষেই ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) যোগদান করেন। চাকরির পাশাপাশি নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে গেছেন। তারপর ধীরে ধীরে কাজ শুরু করলেন সমাজের অসহায় অন্য নারীদের নিয়ে।

গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা
সুন্দরবনের ঢাংমারি গ্রামের নারীরা মাছ ধরার কাজ করত। কিন্তু মাছ ধরতে গিয়ে লবণ পানিতে নারীদের জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি ভাবলেন জীবিকার জন্য যেহেতু তাদের কাজ করতেই হচ্ছে, সেহেতু মাছ ধরার বাইরে তাদের অন্য কাজে যুক্ত করতে হবে। ‘গ্রিন ভয়েস’ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামের নারীদের জন্য সেলাই মেশিন কেনার ব্যবস্থা করলেন। গ্রামের একটি মেয়ে সেলাই কাজ জানত। তাকে নিয়েই কাজ শুরু করলেন। তিনি তাদের জন্য একটা নিয়ম তৈরি করে দিলেন। সেলাই কাজ করে তার এবং তার সহযোগিতাকারীদের যে টাকা লাভ হবে, তা তারা সবাই ভাগ করে নেবে এবং লাভের একটা অংশ জমিয়ে তারা আরেক নারীকে সেলাই মেশিন কিনে দেবে। এভাবে গ্রামের নারীরা অন্য কাজে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে শুরু করে। এরপর সেই গ্রামে ইকো রিসোর্ট তৈরি করে নারীদের নানা কাজে যুক্ত করতে শুরু করেন। কর্মসংস্থানের নানা ক্ষেত্র তৈরি করে তিনি গ্রামের নারীদের ঝুঁকিপূর্ণ এবং অস্বাস্থ্যকর কাজ থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হন। খুলনা শহরেও যখন ‘এবং খিচুড়ি’ রেস্টুরেন্ট চালু ছিল তখন যাতে গ্রামের নারীদের কিছু উপার্জন হয়, সেজন্য দূর গ্রামের নারীদের কাছ থেকে রেস্টুরেন্টের কাঁচামাল সংগ্রহ করতেন।

সুন্দরবনে মাঘ মাসের ১ তারিখে বনবিবির উৎসব পালন করেন স্থানীয়রা। আঁখি সিদ্দিকা গোলপাতা ও কাঠ দিয়ে তৈরি করে দেন বনবিবির মন্দির।

 

দূরে থেকে জুড়ে থাকি, সংকোচ দূরে রাখি
এই স্লোগান নিয়ে করোনা মহামারি মোকাবিলায় নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আঁখি সিদ্দিকা। যেকোনো দুর্যোগে ত্রাণের তালিকায় নারীর জন্য স্যানিটারি প্যাড যুক্ত থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ক্ষুধার কথা বলা যায়। দু-মুঠো চাল চাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েদের অতি প্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাডের কথা কাউকে বলা যায় না। তখন ঘর থেকে বাইরে যাওয়া যেত না, দোকানপাটও খোলা থাকত সীমিত। আবার স্যানিটারি প্যাড কেনার জন্য ডোনেশন জোটার আশাও ছিল না। তাই তিনি বাড়িতে বাড়িতে ফোনে যোগাযোগ করে সবার কাছ থেকে দু-চারটি করে প্যাড চাইলেন। অনেকেই বাড়ির সামনে এসে তাদের প্যাড থেকে দু-চারটি প্যাড রেখে যেতেন। পাঁচটি প্যাড দিয়ে একটি করে প্যাকেট বানাতেন। তারপর প্যাকেটগুলো দিয়ে দিতেন খুলনা এলাকায় বাড়ি বাড়ি ত্রাণ বিতরণের জন্য সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কাজ করা দলগুলোর কাছে। প্রত্যেক পরিবারে নারীর সংখ্যা অনুযায়ী প্যাডের প্যাকেট দেওয়া হতো। তার এই উদ্যোগে প্রায় ১ হাজার প্যাড বিলি হয়েছিল। অফিস আদালত, সিনেমা, থিয়েটার সব জায়গায় মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাডের ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

মধু আপা
সুন্দরবনের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন ২০০৮ সাল থেকে। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ছিল না ভালো রাস্তাঘাট। তিনি ছুটতে শুরু করলেন বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা এনে প্রান্তিক মানুষগুলোর উপকারের জন্য শুরু করলেন ইকো ট্যুরিজম, ভিলেজ ট্যুরিজম এবং রিভার ট্যুরিজম। এই উদ্যোগুলোর মাধ্যমে তিনি গ্রামের মানুষগুলোকে বন ও নদীর ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন। তাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন বনকে বাঁচাতে হবে, নদী বাঁচাতে হবে। তবেই গ্রামের মানুষগুলো বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। তাই এখন তারা আর বিষ দিয়ে মাছ ধরে না। আবার তাদের আহরিত মধু, মাছ, কাঁকড়া, সজনেপাতা এগুলো বাজারজাতকরণে তিনি তাদের সাহায্য করে চলেছেন। গ্রামের মানুষ ভালোবেসে তাকে মধু আপা বলে ডাকেন।

সবুজায়ন বাংলাদেশ
সবুজ বাংলাদেশ দেখতে কার না ভালো লাগে। তিনিও বাংলাদেশকে সাজাতে নেমে পড়লেন। গাছ কিনলেন। তারপর ভ্যানে করে সেই গাছ নিয়ে ছুটে চললেন শহরে, গ্রামে, বাড়ির উঠানে, রাস্তার ধারে। ফলদ গাছ লাগানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু তাই বলে এ দেশের নতুন প্রজন্ম দেশি ঋতুভিত্তিক ফুল চিনবে না তা তো হতে পারে না। ঋতুভিত্তিক ফুলগুলোকেও তো বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখতে হবে। নইলে বাংলাদেশের পাখিরা থাকবে কোথায়, খাবে কী? তাই ফলদ গাছের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক রোপণ করতে থাকলেন কদম, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল, শিমুল, সজনে। ‘ফলদ বাংলাদেশ’ ও ‘গ্রিন ভয়েস’-এর সঙ্গে এনিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছেন আঁখি সিদ্দিকা।

সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রাম পশ্চিম ঢংমারীতে প্রথমবার পালিত হয় শিমু দিবস। শিশু দিবসে র‌্যালিতে মিশুদের সাথে আঁখি সিদ্দিকা

 

রক্তদান
মানুষের জন্য কাজ করা তার নেশা। সারাক্ষণ তিনি খুঁজতে থাকেন মানুষের জন্য আর কী করা যায়। রক্তের অভাবে কেউ প্রাণে বাঁচবে না তা তো হতে পারে না। ব্লাড ডোনার হিসেবে কাজ শুরু করলেন বিভিন্ন রক্তদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ৫৫ বার রক্তদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডোনার ক্লাব বাঁধন তাকে পুরস্কৃত করেছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা প্রচলন
খুলনা সোনাডাঙায় ‘এবং খিচুড়ি’ নামের লোক ঐতিহ্যবাহী একটি রেস্টুরেন্টের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই রেস্টুরেন্ট কিন্তু শুধুই রেস্টুরেন্ট ছিল না। এখানে সব ঋতুকে উৎসবের মাধ্যমে বরণ করা ও পালন করার একটা রেওয়াজ তিনি তৈরি করেছিলেন। ঋতুর পাশাপাশি গান-বাজনার মাধ্যমে পালন হতো পূর্ণিমা উৎসবও। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত রাখতেই তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

সুন্দরবনে প্রথমবার 'সুন্দরবন সাহিত্য ক্যাম্প' আয়োজন করেন কবি আঁখি সিদ্দিকা। ছবিতে বীরমুক্তিযোদ্ধাসহ সুন্দরবন গ্রাম সংলগ্ন অধিবাসীদের সঙ্গে আঁখি সিদ্দিকা

 

আজ ওদের দিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও শিমু দিবস পালনে মিশু কিশোররা ছবি আঁকছেন সুন্দরবন ও বাংলাদেশকে নিয়ে।

 

‘এবং খিচুড়ির’ মাধ্যমে তিনি আরও একটি রেওয়াজ চালু করেছিলেন। ‘আজ ওদের দিন’ এই নাম দিয়ে সপ্তাহে কিংবা ১৫ দিনে একদিন পথশিশুদের জন্য রেস্টুরেন্টটি খোলা থাকত। সেদিন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা (সচ্ছল পরিবারের) পথশিশুদের আপ্যায়ন করত। সেই সঙ্গে দুই পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে চলত সাংস্কৃতিক চর্চা, গল্প বলা, গল্প শোনা ইত্যাদি। এতে দুই পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে চমৎকার এক সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পথশিশুদের গল্প শুনে সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা খাবার অপচয় রোধ শিখেছিল, খাবার নিয়ে বাছবিচার করাও ছেড়ে দিয়েছিল। পথশিশুদের মধ্যেও তৈরি হয়েছিল নানান রকম সৃজনশীল কাজের আকাঙ্ক্ষা। উপকৃত হচ্ছিল উভয় সমাজের শিশুই।

সুন্দরবনের শিশুদের নিয়ে আঁখি সিদ্দিকা তৈরি করেছেন এক অভিনব প্রকৃতির স্কুল

 

ফুডব্যাংক
খুলনায় তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করলেন। আর দেখলেন প্রচুর পরিমাণে খাবার অপচয় হচ্ছে। তিনি একটা উদ্যোগ নিলেন। উদ্যোগের নাম ‘ফুডব্যাংক’। প্রতি রাতে প্রত্যেকটা রেস্টুরেন্টে যে পরিমাণ খাবার বেঁচে যায়, সব এনে এই ফুড ব্যাংকে জমা করা হবে। তারপর সেটা রাতে রাতেই পথমানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তার এই উদ্যোগ বেশ সাড়া জাগিয়েছে এবং দেশের অনেক জায়গায় এরকম ‘ফুডব্যাংক’ চালুও হয়েছে।

বাল্যবিয়ে রোধ
বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও শুরু করেছিলেন পরিবার থেকে। প্রতিবাদ করেও মেজো বোন ও সেজো বোনের বাল্যবিয়ে আটকাতে পারেননি বলে তার মধ্যে ভীষণ জেদ তৈরি হয়েছিল। তারপর থেকে তিনি কঠিনভাবে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেন। প্রথমে আত্মীয়স্বজনের মধ্যকার বাল্যবিয়েগুলো বন্ধ করতে শুরু করলেন। তারপর নিজের এলাকা খুলনার বাঘমারা, ফুলতলা গ্রাম, মহেশ্বর পাশা, খালিশপুরসহ আরও কিছু অঞ্চলে তিনি বাল্যবিয়ে রোধের জন্য কাজ করেছেন। সব জায়গাতেই তিনি বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে বোঝান। কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। যারা বুঝতে চায় না, তাদের জন্য প্রয়োজনবোধে তিনি কঠোর হয়ে ওঠেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সহযোগিতা, সাংবাদিকদের সহযোগিতা আবার কখনো পুলিশের সহযোগিতা নিয়েও বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষা এবং গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে দেখলেন সেখানেও একই সমস্যা। এখানেও শুরু করলেন বাল্যবিয়ে রোধের কাজ। প্রায় ১০-১২ বছর ধরে তিনি সুন্দরবন নিয়ে কাজ করছেন। সুন্দরবনের ঢাংমারি গ্রামে বাল্যবিয়ে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। দু-একটা বাল্যবিয়ে যদি তার অগোচরে হয়েও থাকে তা তিনি সামাল দেন অন্য কৌশলে। বিয়ে হয়ে গেলেও সেই কিশোরীর লেখাপড়া তিনি বন্ধ হতে দেন না। শর্ত জুড়ে দেন। পুলিশের ভয় দেখান। আদর করে বোঝান। কিশোরীর মনে স্বপ্ন ঢেলে দেন। নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন।

হাওরের সমস্যা ও সংকট নিয়ে কাজ
দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা সমস্যাগুলো খুঁজতে গিয়ে তিনি পেয়ে গেলেন হাওরের নানা সমস্যা। আর তাই ‘দি আর্থ সোসাইটি’র সঙ্গে শুরু করেছেন হাওরের সমস্যা ও সংকট মোকাবিলার কাজ।

লেখালেখি
লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ছোট বোনকে নিয়ে ছড়া লেখার মধ্য দিয়েই তার লেখালেখির শুরু। এরপর স্কুল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রপত্রিকা ও ভারতের পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই খুলনা বার্তা নেটওয়ার্কের শিশু সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে আরও অনেক সম্পাদনার কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। লিটল ম্যাগ ‘মলাট’ সম্পাদনা করে চলেছেন ২০০৯ সাল থেকে। এ ছাড়া তার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলে প্রায় ১৫-১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

জাহ্নবী