সন্তান লালন-পালন করা খুব কঠিন কাজ। তার ওপর মা যদি কর্মজীবী হন, তাহলে তা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। তাকে একই সঙ্গে সংসার, সন্তান এবং কর্মক্ষেত্র সামলাতে হয়। স্বাবলম্বী হতে ও বর্তমান ব্যয়বহুল জীবনব্যবস্থার জন্য মায়েরা কাজ করেন। কর্মজীবী মায়েদের সেই সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন ইসরাত জাহান চৈতী
শায়লা জামান (ছদ্মনাম) দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে যোগ দেন বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে যোগদান করেন কর্মক্ষেত্রে। সন্তানের জন্য অসীম মমতাকে একপাশে ফেলে শুরু হয় আট ঘণ্টার কর্মজীবন। একই সঙ্গে শুরু হয় জীবনের অন্যতম কঠিন যুদ্ধ। সন্তান সামলে অফিস করার পথে শুধু সন্তানের প্রতি মায়া নয়, আস্তে আস্তে বাধা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে পরিবারের পাহাড়সম কাজের দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করতে না পারার আক্ষেপ কিংবা অফিসের কাজের বিশাল চাপ। স্বামী, সংসার, সন্তান একত্রে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে খেতে শেষমেশ নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয় শায়লা জামানকে। বর্তমানে তিনি চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী।
শুধু শায়লা নন, আমাদের দেশের বহু নারী একসঙ্গে সন্তান-সংসার-চাকরি সামলিয়ে উঠতে পারেন না। যদিও অনেকে আবার নানা প্রতিকূলতার মাঝেই চালিয়ে যাচ্ছেন সবকিছু। তবে তাদের অনেককেই মাঝে মধ্যে বলতে শোনা যায় ‘আর ভাল্লাগে না! এত চাপ নিতে পারি না, চাকরি ছেড়ে দেব।’
বাস্তবতা আসলেই কঠিন। একজন মায়ের জন্য সংসার, সন্তান, কর্মক্ষেত্র একসঙ্গে সামাল দেওয়া মোটেও সহজ কোনো বিষয় নয়। আমাদের দেশে কর্মজীবী মায়েদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূলতা।
‘আমি নারী, আমি সব পারি’ আমাদের বিদ্যমান সমাজ কাঠামোতে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত এ স্লোগানের সবসময় বাস্তবায়ন ঘটাতে হয় নারীদের। আর বিজ্ঞাপনের এই স্লোগানের ব্যতিক্রম কেউ ঘটালে সমাজ, পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে বিন্দু পরিমাণ ভুল করে না। আর সে ভুল শুধরাতে অনেককে আবার শায়লা জামানের মতো নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিতেও দেখা যায়।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পরিবারে শিশুর দেখাশোনার বিষয়টি এখনো মা-বাবা উভয়ের কাজ বলে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই শিশুর নিরাপত্তা আর দেখভালের প্রশ্নে বারবার মাকেই সমঝোতায় আসতে হয়। সন্তান লালন-পালনের জন্য চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে মাকেই আপস করতে হয়। ফলে অনেক নারীই স্বাবলম্বী হতে পারছেন না। পর্যাপ্ত শিক্ষা অর্জন করা সত্ত্বেও তাদের শুধু সংসার আর সন্তানই সামলাতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখতে পারছেন না।
এরপরও নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা তাদের আসন পাকাপোক্ত করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। সময় বদলে গেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। ফলে শুধু পরিবার নয়, কর্মক্ষেত্রেও নারীর উপস্থিতি এখন অনেকটা ধ্রুবতারার মতোই সত্য। মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, চিকিৎসা, প্রকৌশল, গার্মেন্টস, কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, ক্রীড়াঙ্গন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন কিংবা সাংবাদিকতা- এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর পদচারণা নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩-এর চতুর্থ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ৭ কোটি ১১ লাখ। এর মধ্যে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৪ লাখ। অন্যদিকে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ।
তবে বাস্তবতা হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেভাবে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল অবকাঠামো। নানা ধরনের প্রতিকূলতা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতা। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় দেশের কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মায়ের শিশুদের জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ছয়টি।
অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর সংশোধনীর ৯৮ ধারায় শিশুকক্ষ বিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। এতে উল্লেখ রয়েছে, কোনো অফিসে ৪০ জন বা এর বেশি নারী কর্মরত থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী সন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশুকক্ষ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ৪০ বা এর বেশি নারীকর্মী থাকলেই ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে?
অন্যদিকে যেসব অফিসে ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে, সেখানেও রয়েছে নানা ধরনের জটিলতা। মায়েদের অভিযোগ পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় তাদের সন্তানদের দেখভাল নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়। খাবারের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে শিশুরা নানা ধরনের জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়।
বর্তমানে রাজধানীতে বেসরকারিভাবে মানসম্মত বেশকিছু ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলোয় ব্যয় বহন করার সামর্থ্য অধিকাংশের নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদন মতে, মধ্যম মানের বেসরকারি কেন্দ্রে ভর্তি বাবদ লাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং মাসে ফি হিসেবে গুনতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। যদিও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন-২০২১-এর খসড়া বিধিমালায় বেসরকারি ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক ফি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ডে-কেয়ার সেন্টারেই নির্ধারিত ফির বাইরেও সরবরাহ করতে হয় শিশুর খাবার, ডায়াপারসহ নানা সামগ্রী। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহন করতে পারেন না ডে-কেয়ারের বাড়তি খরচ।
এ ছাড়া রয়েছে সন্তান নিয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারে যাতায়াতের অসুবিধা। আমাদের দেশে অফিস থেকে পরিবহন সেবা পান এমন কর্মীর সংখ্যা বলা চলে হাতেগোনা। তাই যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই কিংবা অফিস থেকে পরিবহন সেবা পান না, তাদের সন্তানের জন্য দূরবর্তী ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা চিন্তা করা প্রায় অকল্পনীয়।
এ ছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরিচালিত ডে-কেয়ার সেন্টারের সুযোগ আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। ফলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মায়ের ক্ষেত্রে চাকরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
ডে-কেয়ার সুবিধা না পাওয়া কর্মজীবী মায়েদের একমাত্র ভরসা পরিবার। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরের ফলে সেখানেও দেখা দিয়েছে নানা সংকট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের দেখাশোনার ভার পড়ে গৃহপরিচারিকার ওপর। যদিও গৃহপরিচারিকার কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করা মায়েদের জন্য প্রায় অসম্ভব। কেননা, শিশু মায়ের কোল ছাড়া হওয়া মানেই অনিরাপদ। এ ছাড়া শিশুর যথাযথভাবে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রেও তৈরি হয় নানা সংকট। অনেক ক্ষেত্রে গৃহপরিচারিকার কাছে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হয় শিশুরা। এর জন্যও আবার দায়ী করা হয় সেই কর্মজীবী মাকেই।
অন্যদিকে, মায়েরা চিন্তা করেন সন্তান একটু বড় হলে হয়তো তাদের কষ্টের অবসান হবে। কিন্তু না, সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভালো স্কুলে পড়ানো, ভালো পরিবেশে রাখা, সন্তানের সুস্থতা, শারীরিক-মানসিক বিকাশ ইত্যাদি অধিকাংশই দেখতে হয় মাকে। যদিও এর ব্যতিক্রমও আছে। কিছু পরিবারে মায়ের পাশাপাশি দায়িত্ব ভাগ করে নেন বাবা বা পরিবারের অন্য সদস্য। তবে এ সংখ্যা নিতান্তই কম। অনেক বাবা মনে করেন অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া পর্যন্তই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। কিন্তু একজন মা তা মনে করতে পারেন না। অফিস শেষে নিতে হয় সন্তান, পরিবারকে ভালো রাখার দায়িত্ব। ফলে একজন বাবার দায়িত্ব কিছু সময়ের জন্য শেষ হলেও মায়ের দায়িত্ব কখনো শেষ হয় না।
ফলে শুধু যে ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরির মাধ্যমেই কর্মজীবী মায়েদের চলার পথ মসৃণ হবে, তা কিন্তু নয়। অনেক কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় ইচ্ছাকৃতভাবে কর্মজীবী মায়েদের বাড়তি চাপে রাখা হয়। যদিও উন্নত বিশ্বে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া রয়েছে পর্যাপ্ত যানবাহনের অভাব, কর্মক্ষেত্রে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরিবারে যথাযথ সহযোগিতার অভাব, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের অভাব। সন্তান দেখভালের দায়িত্ব শুধু মায়ের, হোক সে কর্মজীবী বা গৃহিণী। আবার সন্তানের কোনো সমস্যা হলে মাকেই দোষারোপ করা হয়।
এই সংকটগুলো প্রতিকার এবং প্রতিরোধ করা না গেলে বাংলাদেশ যতই উন্নয়নের রোড মডেল হোক না কেন, অর্থনীতিতে কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণ তেমন মসৃণ হবে না। ফলে তাদের চলার এই বন্ধুর পথকে সুন্দর করতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। সর্বোপরি সন্তান লালন-পালন শুধু মায়ের দায়িত্ব এমন ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে কমে আসবে কর্মজীবী মায়ের সংকট।
জাহ্নবী