বৈশ্বিকভাবে প্রতি বছর মে দিবস পালিত হলেও এখনো বিশ্বে পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা কম। কেননা, কর্মক্ষেত্রে একজন পুরুষ শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা পান, নারী শ্রমিক তা পান না। এমনকি নারী শ্রমিকদের জন্য কর্মক্ষেত্র যতটুকু নিরাপদ হওয়া উচিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই। শ্রমবাজারে দিনে দিনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও বৈষম্য এখনো প্রকট।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধের কারণে আধুনিককালের আগ পর্যন্ত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল খুব কম। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শ্রমবাজারে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত। সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কারখানাতেই তারা কাজ করুক না কেন, সেখানে বেতনভাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধায় পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে তাদের ব্যবধান থাকে অনেক। বাংলাদেশে শ্রম আইন থাকলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই তার কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। বেসরকারি খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা বা বেতনও ঠিকমতো নির্ধারণ করা নেই। নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বেতনভাতা এসব নিয়ে বিশ্বব্যপী কাজ হলেও এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) বলছে, বতর্মান খোলাবাজার অর্থনীতির বৈশ্বিক পরিবেশে বিশেষ করে প্রতিযোগিতাপূর্ণ রপ্তানিশিল্প ও নয়া বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার অধীনে বৈশ্বিক পুঁজি সঞ্চয়ন প্রক্রিয়া মূলত নারীর ওপর নির্ভরশীল।
মজুরি কিংবা মজুরিবহির্ভূত দুই ধরনের নারীশ্রমের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। শ্রমবাজারে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণকে কখনো কখনো ‘শ্রমের নারীকরণ’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। যদিও নারীরা অধিক সংখ্যায় এখন শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, তবে এটা লক্ষণীয়, তাদের কাজ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে, যেখানে পারিতোষিক ও পারিশ্রমিক উভয়ই কম। আইএলও আরও বলছে, ২০২৭ সালের মধ্যে নারী-পুরুষ শ্রম বিভাজন শতকরা ২৫ ভাগ হ্রাস পাবে।
নারী শ্রমিকদের ভেতর বেশির ভাগই কাজ করেন পোশাকশিল্পে। পোশাকশিল্পে মোট শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী। নারীরা স্বল্প পারিশ্রমিকে এসব জায়গায় কাজ করছেন। কিন্তু কর্মপরিবেশ তাদের অনুকূল নয়। সরকার এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ মিলে এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যেগ না নিলে কখনোই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
অ্যাডভোকেট আবিদা বিনতে আনসার বলেন, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৪৫ ধারা অনুসারে কোনো মালিক তার প্রতিষ্ঠানে সজ্ঞানে কোনো নারীকে তার সন্তান প্রসবের ৮ সপ্তাহের মধ্যে কোনো কাজ করাতে পারবেন না। এ ছাড়া এমন কোনো কাজ করার জন্য নিয়োগ করতে পারবেন না, যা তার জন্য কষ্টকর। এ ছাড়া প্রসূতি নারী শ্রমিকদের প্রসব-পূর্ব এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা ও পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪৬ ধারায় বিশেষ সুবিধার কথা বলা হয়েছে, সেখানে বলা হয় প্রত্যেক নারী শ্রমিক তার মালিকের কাছ থেকে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের আগে ৮ সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের পরে ৮ সপ্তাহের জন্য প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবেন। যা তার মালিক এই সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবেন। তবে শর্ত হলো, সন্তান প্রসবের আগে সেই মালিকের অধীনে কমপক্ষে ৬ মাস কাজ করতে হবে। ৪৮ ধারা অনুসারে, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধার পরিমাণ মজুরি সম্পূর্ণ নগদে প্রদান করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ শন উইনলে বলেন, বিশ্বে ৮ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক প্রসবকালীন পর্যাপ্ত ছুটি পান না। আফ্রিকা ও এশিয়ার নারী শ্রমিকরাই এ ক্ষেত্রে বেশি ভুক্তভোগী।
এ দেশে ৮০ ভাগের বেশি প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। আর যেহেতু সন্তানদের লালনপালনের দায়িত্ব মায়ের ওপরেই বর্তায়, তাই ডে কেয়ার না থাকার দরুণ নারী শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।
শ্রম বিধিমালা ২০১৫-এর ১০৩ ধারায় নারী শ্রমিকের কাজের সময় নির্ধারণ করা আছে। বাংলাদেশের শ্রমআইন অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করবে। নারী শ্রমিকদের রাত ১০ থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই কাজ করাতে হলে নারী শ্রমিকের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। ধারা ৬৩ অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক নারী শ্রমিক ৩০ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের কোনো দ্রব্য কারও সাহায্য ছাড়া হাতে বা মাথায় উত্তোলন, বহন, অপসারণ করার উদ্দেশ্যে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য, নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে এসব নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, ততটা সমাধানের পথে অগ্রগতি হয় না।
নারী শ্রমিকদের মজুরি খুব কম হওয়ার দরুণ, তাদের জীবনমান নিচু স্তরেই থেকে যাচ্ছে। এত স্বল্প মজুরি দিয়ে তাদের সংসার চালানোই কঠিন। ফলে তারা খুব মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এমনকি পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার কিনে খেতে না পারার কারণে তাদের অধিকাংশই অপুষ্টিতে ভুগে থাকেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর।
এইযে নারী শ্রমিকরা এত বৈষম্যের শিকার হন, বেশির ভাগ নারীই এর প্রতিবাদ করেন না। তারা ভয় পান এই ভেবে যে, প্রতিবাদ করলে যদি তাদের কাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রতিবাদ না করার দরুণ এই সমস্যাগুলো আরও বেশি দীর্ঘায়িত হয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ যে কার্যকরী ভূমিকা রাখে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীরা শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের আগে অর্থনীতির চাকা যতটা সচল ছিল, অংশগ্রহণের পর তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পোশাক খাত থেকে শুরু করে কৃষি কিংবা শিল্প খাতেও নারীর যে অবদান, তারা সে অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। যা খুবই দুঃখজনক। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বা অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য নারী শ্রমিকদের আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে তাদের সুরক্ষা দেওয়া, মজুরি বৃদ্ধি করা, সর্বোপরি পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সব বৈষম্য দূর করা সময়ের দাবি।
জাহ্নবী