ছয় বছর আগে মারাত্মক এক দুর্ঘটনায় অমানিশা নেমে আসে ঝুমা আক্তারের জীবনে। লিচু গাছ থেকে পড়ে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে যায় তার। সবে তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তিনি। কিন্তু সেই দুর্ঘটনা দমাতে পারেনি নরসিংদীর এই মেয়েকে। খেলাধুলায় জীবনের আনন্দ খুঁজে নেন তিনি। প্রথমে বাস্কেটবল খেললেও পরে আর্চারি শুরু করেন। তির-ধনুকের এই খেলায় ইতিহাসই রচনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি প্যারা অলিম্পিকের টিকিট কেটেছেন। মার্চের শুরুর দিকে আরব আমিরাতের দুবাইতে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম ফাজ্জা ইন্টারন্যাশনাল প্যারা আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ। এই টুর্নামেন্ট ছিল প্যারিস প্যারা অলিম্পিকের ফাইনাল কোটা টুর্নামেন্ট। এখানেই মেয়েদের কম্পাউন্ড ব্যক্তিগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জয়ের মধ্য দিয়ে প্যারা অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত করেন ঝুমা। একান্ত আলাপচারিতায় এই সাফল্য ও জীবন যুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ
বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে প্যারা অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কেমন লাগছে?
আলহামদুলিল্লাহ, অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করেছি এটা অবশ্যই ভালো লাগার। খুব ভালো লাগছে। এতদিন যে কষ্ট করেছি, তার ফল হিসেবে অন্তত কিছু একটা সাফল্য তো পেয়েছি। এজন্য খেলায় এখন আরও বেশি উৎসাহ পাচ্ছি, ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করার সাহস পাচ্ছি। এখন অলিম্পিকেও ভালো কিছু করার জন্য প্র্যাকটিস করে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু করব।
দুবাই যাওয়ার আগেই অলিম্পিকে খেলার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। নিজের মধ্যে কি এ নিয়ে বিশ্বাস কাজ করছিল?
অনুশীলনে আমার যে স্কোর হচ্ছিল, সেটা দেখেই মূলত আশাবাদী ছিলাম যে কোয়ালিফাই করতে পারব। গেমেও ভালো স্কোরই হয়েছে। অন্য বড় আর্চারদের স্কোর ও আমার স্কোর প্রায় একই ছিল। এই ধারাটা যদি ধরে রাখতে পারি, আশা করা যায় অলিম্পিকেও ভালো কিছু হবে।
বাংলাদেশে প্যারা আর্চারির পথচলা বেশি দিনের না। মাত্র এক বছর হলো। সেখানে এত অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেলেন। বলতেই হয় অনেক বড় এক অর্জন। ভাবতে কেমন লাগে?
আলহামদুলিল্লাহ। অনেকে ছয় বছরে যেটা করতে পারে না, সেটা আমি বলতে গেলে মাত্র ছয় মাসে করেছি। আপনারা দোয়া করবেন, ইনশাআল্লাহ আমি আরও ভালো কিছু করতে পারব। সেই আশা আমার আছে।
আপনি আর্চারির সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
আমি খেলাধুলা শুরু করেছি বেশি দিন হয়নি। ২০১৮ সালে আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এরপর প্রায় দুই বছর আমার হাসপাতালেই কেটে গেছে। এর মধ্যে আমি বাস্কেটবল শুরু করি। ভালো স্কিল ছিল। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি মূল দলে ঢুকে পড়ি। সেখান থেকে আবার আর্চারিতে আসা। বাংলাদেশে প্যারা আর্চারির পথচলা শুরু হয় ২০২৩ সালে। আমি শুরু থেকেই ছিলাম। আমার বাস্কেটবল কোচই আর্চারিতে আমার নাম দিয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, আমার জন্য বাস্কেটবল খেলার চেয়ে আর্চারি খেলাই ভালো হবে। এভাবেই আমার আর্চারি শুরু। এর আগে প্যারা বাস্কেটবল জাতীয় দলের অংশ ছিলাম আমি। থাইল্যান্ডে জাতীয় দলের হয়ে একটি ক্যাম্পও করেছি।
আর্চারিতে আসার আগে খেলাটা সম্পর্কে কতটা জানতেন?
আর্চারি কী সেটাই জানতাম না। কীভাবে খেলে সেটা তো আরও না। আমার বাস্কেটল কোচই আমাকে খেলাটা নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেন। তিনি বলেছিলেন, এখন শুরু করো। ধীরে ধীরে আয়ত্তে এসে যাবে।
আপনার সেই কোচ সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত বলবেন?
তার নাম মোস্তাফিজুর রহমান বুলবুল। তিনি সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)-এর অধীনে কাজ করেন। প্যারা বাস্কেটবল দল নিয়ে কাজ করেন। আমার এত দূর আসায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা তারই।
আর্চারি সম্পর্কে তো শুরুতে কিছুই জানতেন না। যখন শুরু করলেন কেমন লাগত খেলতে?
প্রথম যখন ধনুক ধরি, তখন তো উঁচুই করতে পারতাম না ঠিকমতো। ভাবতাম বাস্কেটবল খেলাই বোধহয় ভালো ছিল (হাসি)। আমাদের কোচ নিশিত দাস অনেক কঠোর অনুশীলন করাতেন। কঠোর পরিশ্রম করেছি, ফলে সবকিছু সহজ হয়ে গেছে। দুই-তিন মাস অনুশীলনের পর থেকেই আমি ভালো স্কোর করতে পেরেছি।
আরেকটু পেছন ফিরে যাই। আপনার দুর্ঘটনার বিষয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন...। কীভাবে হলো?
২০১৮ সালের জুন মাসের ঘটনা। আমি তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমার বাসায় লিচু গাছ ছিল। কয়েকটা লিচু একদম লাল হয়েছিল। ওগুলো পাড়ার জন্য গাছে উঠি। শুকনো ডাল ধরার কারণে ভেঙে নিচে পড়ে যাই। এরপর থেকে তো অনেক স্ট্রাগল ছিল। কোমর থেকে পা পর্যন্ত পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে সিআরপির খোঁজ পাই। সেখানে ভর্তি হই। ৪ মাস ১৭ দিন ভর্তি ছিলাম। যারা প্যারালাইজড রোগী, সিআরপিতে তাদের নতুনভাবে বাঁচার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়। অনেক কাজ শিখিয়ে দেওয়া হয়। যে যে কাজে ভালো করবে, তাকে সেদিকেই অনুপ্রাণিত করা হয়। আমার যে বাস্কেটবল কোচের কথা বললাম, আমাকে খুব সাপোর্ট করতেন তিনি। বলতেন তুমি পারবে। আমি তো গ্রামের মেয়ে। প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগত। দুই-তিনটি ক্যাম্প করার পর দেখি আমি অনেক ভালো খেলছি। যারা পুরোনো খেলোয়াড়, তাদের মতোই পারছি। এরপর তো মূল দলে ঢুকেছি। দেশের বাইরেও খেলেছি। প্রতিবন্ধী হওয়াটা বাধার কিছু না, কেউ যদি চায় সেই বাধা কাটানো যায়। আমি চেষ্টা করেছি এগিয়ে যেতে। সামনে আরও ভালো কিছু করার ইচ্ছা।
সেই দুর্ঘটনার আগে কি খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? খেলোয়াড় হবেন, এমন কোনো ইচ্ছা মনে জাগত?
এ রকম কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে আমি অনেক খেলাধুলা করতাম। সব খেলাই পারতাম। সবার মধ্যে এগিয়ে থাকতাম। আমাকে কেউ বলতে পারত না তুমি পারো না বা আমি পারি না এরকম কিছু ছিল না। সবকিছুতেই চেষ্টা করতাম, ভালোই পারতাম।
আপনার বেড়ে ওঠা নিয়ে একটু বলুন।
আমার দেশের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায়। আমার বাবার নাম রতন মিয়া। তিনি একজন কৃষক। মা সোফিয়া বেগম, তিনি গৃহিণী। আমরা তিন বোন। আমি সবার ছোট।
২১ বছরের ছোট্ট জীবনে তো কত কিছুই দেখা হয়ে গেল আপনার। জীবন নিয়ে আপনার বোধ কী?
আমি যখন লিচু গাছ থেকে পড়ে যাই, সবাই বলেছিল তোমার জীবন শেষ। তুমি কিছুই করতে পারবে না, প্রতিবন্ধী হয়ে গেছ তুমি। প্রতিবন্ধীর জীবন মানে তো অনেক কিছু। সমাজের বোঝা, পরিবারের বোঝা। বিয়ে-শাদিরও ব্যাপার আছে। এ অবস্থায় আমাকে বিয়ে করবে কে- এ ধরনের অনেক কিছুই শুনতে হয়েছে। আর এগুলো শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আত্মবিশ্বাস একদমই ছিল না। ধীরে ধীরে এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি। অনেক কিছুই দেখেছি এ পর্যন্ত। সংগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছা আছে। আত্মবিশ্বাস যদি ধরে রাখতে পারি, ইনশাআল্লাহ দেশকেও কিছু দিতে পারব, নিজেও সফলতা পাব।
এই অনেক কিছু দিতে চাওয়ার বিষয়টি আরেকটু সুনির্দিষ্ট করে বলবেন?
অনেক কিছু বলতে খেলাটা তো মাত্র শুরু করেছি। এরই মধ্যে কিছু ফল পেয়েছি। ভবিষ্যতে আরও কিছু করার ইচ্ছা আছে। দেশের জন্য করব, নিজের জন্যও করব।
যেটা বললেন, দুর্ঘটনার পর সবাই বলত তুমি প্রতিবন্ধী হয়ে গেছ। এখন তো অনেক বড় অর্জন এল আপনার হাত ধরে। সবাই কী বলছে?
সবাই খুব খুশি। সবাই বলে এগিয়ে যাও, তুমি পারবে। এখন সবার দোয়া আছে আমার সঙ্গে। সবাই তো এখন বাহবা দিবেই। কিন্তু যখন কেউ অসহায় হয়ে যায়, তখন কেউ পাশে থাকে না। তবে এখানে আমি আমার বাবা-মা ও বোনদের কথা বলতে চাই। তারা সবাই আমাকে সব সময় সাপোর্ট করতেন। বলতেন, ‘তুমি মন খারাপ করো না, তুমি পারবে’। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও সাপোর্ট দিয়েছে, খেলাধুলার ক্ষেত্রেও সাপোর্ট দিয়েছে। সব সময় তারা বলতেন, ‘তুমি চেষ্টা করো, দেখবে তুমি পারবে। আমরা আছি তোমার পাশে।’ এজন্যই আমি এত দূর এগোতে পেরেছি।
পড়াশোনার বিষয়ে একটু বলুন। দুর্ঘটনার পর পড়াশোনা এগিয়ে নিলেন কীভাবে?
২০১৮ সালে দুর্ঘটনার সময়টায় দশম শ্রেণিতে ছিলাম। ২০১৯ সালে তো আর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ২০২০ সালে এসএসসি ও ২০২২ সালে এইচএসসি পাস করি। এখন অনার্স পড়ছি সাভার সরকারি কলেজে। খেলাধুলার সঙ্গে পড়াশোনা, দুটি একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি দুটিই করতে চাই। খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনাও শেষ করতে চাই।
এখন আপনার শারীরিক যে অবস্থা, এটার কি আরও উন্নতি সম্ভব? ডাক্তাররা কী বলছেন?
আরও উন্নতির তো অবশ্যই সম্ভাবনা আছে। ডাক্তার বলছেন নিয়মিত থেরাপির মধ্যে থাকতে। তাহলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব না হলেও অনেকটা সম্ভব। কিন্তু রেগুলার থেপারি নেওয়াটা আসলে কঠিন। আর্থিক দিক একটা বড় কারণ। থেরাপির চার্জ তো অনেক বেশি। প্রথম দুই-তিন বছর আমার নিয়মিতই থেরাপি দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন খেলাধুলা, পড়াশোনা, সবকিছু সামলে নিয়মিত থেরাপিটা নেওয়া হয় না।
এই জায়গায় সরকার বা কোনো সংস্থা এগিয়ে এলে নিশ্চয়ই উপকৃত হতেন?
এগিয়ে আসলে তো অবশ্যই ভালো হবে। অনেক উপকার হবে।
সবকিছু আগের মতো যদি ঠিকঠাক হয়ে যেত, এমন স্বপ্নও নিশ্চয়ই খেলে যায় মনে?
সেই স্বপ্নই তো দেখবই। একসময় তো নিয়মিত দৌড়াতাম। এখন তো আর দৌড়াতে পারছি না। সেই স্মৃতি তো আর মুছে ফেলা যাচ্ছে না। দৌড়ানোর স্বপ্নটা এখনো রয়ে গেছে।
মানুষের জীবনে অনেক দুর্ঘটনাই তো ঘটে। অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। তাদের প্রতি কী বার্তা থাকবে আপনার?
তাদের প্রতি বার্তা থাকবে- নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। কে পাশে থাকল বা না থাকল, এটা দেখার বিষয় না। নিজে কিছু করতে হবে, এটাই হচ্ছে আসল। আমরা যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
জাহ্নবী