ক্যাম্পাস কিংবা বিদ্যাপীঠ হলো জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের জন্য তীর্থস্থান। শিক্ষার্থীরা আনন্দে ক্যাম্পাসে যান, জ্ঞান অর্জন করেন, নিশ্চিন্ত মনে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য তার ক্যাম্পাস একটি স্বপ্নের জায়গা। কিন্তু কিছু কিছু ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীরা ইভটিজিংসহ নানা হয়রানির শিকার হন। যা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার! হাল সময়ের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি এবং কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী
আমাদের সমাজে নারীরা বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। তা ছোটবেলায় গৃহশিক্ষক হোক বা বড় হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দ্বারা। শুধু শিক্ষকই নয়, সহপাঠী কিংবা বহিরাগতদের দ্বারাও হয়রানির শিকার হন তারা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সর্বত্র এই যৌন হয়রানির ছড়াছড়ি। সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে, তত এসব হ্রাস পাওয়ার কথা। অথচ এ দেশে চিত্র তার বিপরীত। ক্যাম্পাসগুলোয় নানাভাবে নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করার ঘটনা বেশ পুরোনো। যত দিন যাচ্ছে, তা চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েই যাচ্ছে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অনৈতিক প্রস্তাব দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা রাজি না হলে অনুপস্থিতি দেখিয়ে জরিমানা আদায়, নম্বর কম দেওয়া, ফেল করিয়ে দেওয়া কিংবা থিসিস পেপার আটকে রেখে তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি নিয়ে একটি গবেষণায় দেখতে পান, ৫৬ শতাংশ যৌন নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানির শিকার। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে। ৯০ শতাংশ জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসমাগমস্থলে ৮১ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ।
২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত এসব নিয়ে কোনো আইন ছিল না। ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ২০০৯ সালের ১৪ মে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য লিখিত নির্দেশনা দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যৌন হয়রানির বিচার ৬০ কর্মদিবসের ভেতর নিষ্পত্তি করতে বলা হয় তাতে। যদি তারা অপারগ হয়, সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ১০(ক) ধারায় যৌন হয়রানির ভেতর নারীকে অশালীন মন্তব্য, নেতিবাচক অঙ্গভঙ্গি, সাংকেতিক চিহ্ন প্রদর্শন এবং মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট হয়রানিকেও আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
২০০৯ সালের এ আইনের পর থেকে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘যৌন নিপীড়ন ও নিরোধ সেল’ নামে কমিটি গঠন করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হলে যেখানে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করতে পারবেন।
নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ তলিয়ে দেখতে গেলে আমরা বুঝতে পারি, এর পেছনের জালের মতো ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো কারণ। প্রথমত ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের শিকার। কোনো নারীকে নির্যাতন করা হলে সে যদি অভিযোগ জানাতে যান, উল্টো তাকে ব্লেম দেওয়ার এবং কটু কথা বলে অপদস্থ করার নোংরা সংস্কৃতি আমাদের সমাজে রয়েছে। হয়রানি বা নির্যাতনের জন্য যে নারী নিজেই দায়ী, তা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে সবাই। এতে করে কোনো নারী শিক্ষার্থী যখন বুঝতে পারেন অভিযোগ জানাতে গেলে বিচার তো পাবেনই না, বরং তাকে আরও অপদস্থ হতে হবে, তখন তিনি অভিযোগ জানানোর চেয়ে চুপচাপ মেনে নেওয়া কিংবা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়াকেই তুলনামূলক ভালো সিদ্ধান্ত মনে করেন। এই সুযোগে যৌন নির্যাতনকারীরা আরও সুযোগ পেয়ে যায়। তারা জানে, যা-ই করুক না কেন ঠিক পার পেয়ে যাবে, কোনো সমস্যা হবে না।
এসবের পেছনে অনেক বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্যাম্পাসের বড় বড় পদে বসার জন্য একেকজন রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের কাছে ধরনা দেয়। এরপর তারা যখন সেসব পদে বসে, ওই রাজনৈতিক দলের দাস হয়ে যায়। তাদের অঙ্গুলি নির্দেশেই তারা চলে। যৌন হয়রানির পেছনে যারা জড়িত, খোঁজ নিলে দেখা যায়, তারা বেশির ভাগই রাজনৈতিক দলের কেউ কিংবা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা। তারা যখন এসব অন্যায় করে, খুব ভালোভাবেই জানে ক্ষমতাবলে বড় বড় পদে যাদের বসিয়েছেন, তারাই তাদের বাঁচাবেন। ক্যাম্পাসের এই অসুস্থ রাজনীতি এসব নির্যাতনের অন্যতম কারণ।
যৌন হয়রানির পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে কমিটির অকার্যকারিতা। সারা বিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়েই শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হয় কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে হবে। এমনকি সেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিটির মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার নারীদের সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক সহায়তা দেওয়া হয়। তারা ছোট-বড় প্রতিটি যৌন হয়রানির ঘটনাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। আর আমাদের দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি তো নেই-ই, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি আছে তা নামমাত্র। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরির পেছনে সেসব কমিটিই সবচেয়ে বেশি দায়ী। কমিটির দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকেন, তাদের না আছে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ, না আছে মেরুদণ্ড। তাদের ভেতর যেমন সচেতনতার অভাব, তেমনই সততা, সাহস ও দায়িত্বশীলতারও অভাব। তারা শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো জানানই না যে, তাদের ক্যাম্পাসে ‘যৌন নিপীড়ন ও নিরোধ সেল’ নামে একটি কমিটি আছে, যেখানে তারা অভিযোগ জানাতে পারবেন। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা যেহেতু জানেন, যারা যৌন নিপীড়ন করে তারা রাজনৈতিকভাবে হোক কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী তাদের রক্ষা করার জন্য বড় হাত আছে। তাই তারা আর এসব ঝামেলায় যেতে চান না। কেউ কেউ যদি ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েও থাকেন, তাহলে দিনের পর দিন মাসের পর মাস তদন্ত প্রক্রিয়া চলার নামে তার অভিযোগ ঝুলিয়ে রাখা হয়। অপেক্ষা করতে করতে তিনি হয়তো পড়াশোনা শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলেও যান, কিন্তু বিচার আর হয় না। কমিটির দায়িত্বরত ব্যক্তিরাও অপেক্ষায় থাকেন, কবে ভিক্টিম পড়াশোনা শেষ করে চলে যাবেন আর তার অভিযোগের ফাইলটিও ক্লোজ হয়ে যাবে। কমিটির এই অকার্যকারিতা ও দায়িত্বহীনতার জন্য দিন দিন এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বেড়েই চলছে।
শিক্ষকদের অসহযোগিতা, চক্ষুলজ্জা, সামাজিক ও পারিবারিক চাপ সবকিছু মিলিয়ে একজন যৌন হয়রানির শিকার হওয়া শিক্ষার্থী মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন। অনেকে বেছে নেন আত্মহননের পথ। অথচ যৌন নিপীড়করা ঘুরে বেড়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে, তাদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলে।
এর আরেকটি কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার অভাব। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খুব কম বিভাগেই নারী-পুরুষের সমতাবিষয়ক কোর্স রয়েছে। অথচ এ বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই সবাইকে সচেতন করা উচিত। নাহলে লিঙ্গবৈষম্য যেমন প্রকট হবে, তেমনই এসব নির্যাতনের হার কমানো কঠিন হয়ে যাবে।
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আমাদের আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। যেন তারা নারীদেরও মানুষ ভাবতে শিখে, নারী বিদ্বেষী হিসেবে বেড়ে না ওঠে। কমিটির কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে জানাতে হবে ‘যৌন নিপীড়ন ও নিরোধ সেল’-এর ব্যাপারে। তাদের সাহস দিতে হবে, যেন তারা নির্ভয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন। প্রতিটা অভিযোগের পর প্রমাণের ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লোক দেখানো বিচারের নামে সাময়িক বরখাস্ত করে পরে তা তুলে ফেলা হয়। এতে দিনশেষে কোনো লাভ হয় না। যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা ২০১০ অনুযায়ী, অপরাধের মাত্রা অনুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মৌখিক বা লিখিতভাবে সতর্ক করা, ১-২ বছরের বহিষ্কার (শিক্ষার্থী), চাকরিচ্যুত, প্রশাসনিক কাজ থেকে বিরত রাখা, অর্থদণ্ড দেওয়া (শিক্ষক ও কর্মচারী) এবং ক্যাম্পাসে চলাচল নিষিদ্ধ (বহিরাগত) করার বিধান রয়েছে। এসব নীতিমালা অনুযায়ী বিচার করা উচিত তো বটেই, প্রয়োজনে আরও কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। নাহলে যৌন হয়রানি যেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা সমূলে উৎপাটন করা কখনোই সম্ভব হবে না।
জাহ্নবী