একজন স্বপ্নবাজ মানুষ মৌরী নাজনীন। তিনি চাকরি ছেড়ে শুরু করেন অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘ঈহা’। বর্তমানে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে সফল। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মারজান ইমু।
ঈহার শুরু কীভাবে?
আঁকতে ভালোবাসি খুব। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত পেইন্টিং করতাম। তবে সেটা শখের বশে। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করি। কর্মজীবনের ব্যস্ততায় পেইন্টিং থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। অথচ পেইন্টিং আমার মেডিটেশন। তাই এই চর্চাটা ধরে রাখতে শুরু করলাম পোশাকে হ্যান্ড পেইন্ট করা। অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘ঈহা’-এর যাত্রাটা শুরুটা এভাবেই। ঈহা শব্দের অর্থ ‘ইচ্ছা’। নিজের ভালো লাগার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতেই ঈহার যাত্রা।
ঈহার জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?
ঈহার যাত্রা ২০১৫ সালের মে মাসে। তখন পোশাকের বাজার পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। আর দেশীয় পোশাক বলতে গুটিকয়েক ফ্যাশন হাউস। মানুষ তখন তার পছন্দের প্রিন্ট বা ডিজাইন পোশাকে ইচ্ছামতো এঁকে নিতে পারতো ঈহার মাধ্যমে। আমরাও প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছি এক ডিজাইনে খুব কমসংখ্যক পোশাক তৈরি করতে। ফলে আমাদের ডিজাইন অনেক বেশি হলেও একই নকশার পোশাক হাতেগোনা। এ কারণে ক্রেতারা আনকমন পোশাকের জন্য ঈহাকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস কীভাবে করলেন?
চাকরির পাশাপাশি ঈহা শুরু করেছিলাম। ফলে ঈহাতে খুব কম সময় দিতে পারতাম। একসময় মনে হলো শখের কাজ করেই জীবন পার করতে চাই। ততদিনে আমাদের বেশকিছু নির্ভরযোগ্য ক্রেতা তৈরি হয়েছে।
কোভিডের ঠিক আগে চাকরি ছেড়ে দিই এবং ঈহার কাজ করার জন্য আলাদা স্টুডিও তৈরি করি। এখন পর্যন্ত আমাদের বেশির ভাগ পণ্য অনলাইনেই বিক্রি হয়েছে। আর স্টুডিওতে আমার কর্মীরা ডিজাইনের ও পেইন্টিংয়ের কাজ করেন। গত বছরের ১৯ মে মাসে ঢাকার লালমাটিয়াতে ঈহার শোরুম যাত্রা শুরু করে।
অফলাইনের এই যাত্রাটা একটু ভিন্নভাবে করতে চেয়েছি। তাই গৎবাঁধা পোশাকের শোরুম না দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে আড্ডা আর যোগাযোগের পরিবেশ তৈরি করতে চেষ্টা করেছি। যেহেতু আমি কফি পাগল মানুষ। তাই ঈহার সঙ্গে কফির আড্ডা জুড়ে দিলাম।
উদ্যোগ দাঁড় করাতে কী বাধা পেরোতে হয়েছে বা হচ্ছে?
ব্যবসা করতে গেলে নানা ধরনের বাধা আসবে। এই বাধাগুলো তো ব্যবসারই অংশ। দেশের অর্থনীতি বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব ব্যবসায় খুব বেশি পড়ে। কাপড় কেনা, ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা, পোশাক তৈরি করাসহ বিভিন্ন কাজে সাপ্লায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। অনেক সময় নানা কারণে তারা সময়মতো কাপড়সহ অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারে না।
তখন সেই ক্ষতির দায় আমাদেরই নিতে হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের কিছু করাটাই তো চ্যালেঞ্জিং। আর ঈহার মতো উদ্যোগের ক্ষেত্রে সেই লড়াইটা আরও বেশি।
ঈহার বাইরে গিয়ে নতুন করে নৈ কেন শুরু করলেন?
নৈ আসলে ঈহার সাব-ব্র্যান্ড। শুরু থেকেই ঈহার প্রোডাক্ট লাইনে ছিল আনস্টিচ অর্থাৎ সেলাইবিহীন হ্যান্ড পেইন্টের ড্রেস। ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যাগ আমার খুব পছন্দ। কিন্তু নিজের জন্য কিনতে গিয়ে দেখেছি আমাদের দেশীয় ব্যাগে বৈচিত্র্য খুব কম। বৈচিত্র্য খুঁজতে গেলে বিদেশি ব্যাগ ছাড়া উপায় নেই। তাই ফ্যাশনেবল ব্যাগ নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নিই।
এই সময় আমার মনে হলো ব্যাগের সঙ্গে মিলিয়ে যদি পোশাক আনা যায় তাহলে বেশ হয়। তখন নতুন সাব-ব্র্যান্ড নৈ-এর জন্ম। নৈ মানে নতুন। নতুন ভাবনা আর নতুন পণ্য নিয়ে নৈ-এর যাত্রা শুরু।
সরকারের কাছে কী ধরনের সাহায্য চান?
এ দেশে বৈধ এবং সৎভাবে ব্যবসা করা বেশ কঠিন। বিশেষ করে ব্যবসার প্রথম ধাপ ট্রেড লাইসেন্স করাই ঝামেলার। লাইসেন্স করতে গেলে একটা ব্যবসায়িক ঠিকানা দিতে হয়।
অথচ অনলাইন উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই ঘরে বসে কাজ করেন। তাদের কোনো অফিস নেই। তারা কীভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেবে! একইভাবে ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানা জটিলতা রয়েছে। অনলাইনে ব্যবসা সহজ করার জন্য
সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে সরকার ভ্যাট ও ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যবসার নিয়মনীতি সহজ করলে দুই পক্ষেরই লাভ।
নতুনদের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ দিন
নতুনদের উদ্দেশে বলতে চাই আপনার পণ্য যা-ই হোক তার নিজস্বতা থাকতে হবে। ডিজাইনে ভিন্নতা আনতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন কিন্তু নিজস্বতা ধরে রেখে উদ্যোক্তা হওয়া আরও বেশি কঠিন। আরেকটি বিষয় হলো ব্যবসায় ভালো-খারাপ দুটোই আসবে। খারাপ সময়ে হতাশ হওয়া যাবে না। দাঁতে দাঁত চেপে লক্ষ্য অটুট থেকে খারাপ সময়টাকে পার করতে পারলে সাফল্য আসবেই।
কলি