ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামীণ সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নন তারা। পরিবারের সদস্য বা স্বামীর দুর্ব্যবহার, মারধরের পাশাপাশি ঘরের বাইরে নারীদের উত্ত্যক্ত আর ধর্ষণে তৎপর ছিল অপরাধী চক্র। এরকম অন্ধকার সমাজ বদলে দিতে একা লড়াই শুরু করেন সাম্পাত পাল দেবী নামে এক গৃহবধূ। তার নজিরবিহীন এই উদ্যোগে যোগ দেয় গ্রামের মেয়েরা। সম্পাত গড়ে তোলেন ‘গুলাবি গ্যাং’ নামে নারী লাঠিয়াল বাহিনী। যেখানেই নারীর প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের খবর আসত লাঠি হাতে হাজির গুলাবি গ্যাংয়ের মেয়েরা। স্রোতের বিপরীতে রুখে দাঁড়ানো অদম্য সাহসী সেই নারীর গল্প জানাচ্ছেন শাহিনুর আলম কলি
ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত বুন্দেলখান্ডে সাম্পাত পাল দেবীর জন্ম। মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কুল ছাড়িয়ে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় এক আইসক্রিম বিক্রেতার সঙ্গে। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ থাকায় সব বাধা অতিক্রম করে গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে পড়াশোনা শিখেছেন সাম্পাত। বয়স ২০ না হতেই পাঁচ সন্তানের জননী হতে হয়। গ্রামের নারীদের প্রতি অনাচার-নির্যাতনে বরাবরই মর্মাহত হতেন তিনি। নারীদের বিরুদ্ধে এই অনাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন। তার গ্রামের এক পুরুষ প্রায় নিয়মিত স্ত্রীকে মারধর করতেন। সাম্পাত পাল দেবী সেই লোকের পরিবারের কাছে অনেক অনুরোধ করেছিলেন মারধর বন্ধ করার জন্য। কিন্তু কেউই তাকে কোনো সাহায্য করেনি। একদিন যখন লোকটা তার স্ত্রীকে অমানবিকভাবে মারধর করছিল তখন আর সহ্য করতে না পেরে লোকটাকে বাধা দিল। এতে লোকটি আরও চটে গিয়ে সাম্পাতকে অশ্রাব্য গালাগালি করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সাম্পাত দেবী তখন ফিরে এলেও গ্রামের কয়েকজন নারীর সাহায্য নিয়ে পরদিন গিয়ে লোকটিকে আচ্ছামতো পিটিয়েছিলেন এবং সেই পুরুষকে প্রতিজ্ঞা করান আর কখনো সে বউ পিটাবে না। সেই থেকেই শুরু সাম্পাত পাল দেবীর লড়াই। ওই ঘটনার পর উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। নানা জায়গা থেকে নারীরা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পারিবারিক নির্যাতন, সামাজিক অবিচার আর যৌন নির্যাতনের খবর তাকে পাঠাতে থাকেন, অনুরোধ করেন বাঁচাতে।
২০০৫-০৬ সালের দিকে নারী অধিকার রক্ষায় সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সাম্পাত। সংগঠনটি শক্তি, সাহস ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে প্রথমে ভারতে তারপর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাদের হাতে থাকত বাঁশের লাঠি। সাম্পাত দেবী চাইলেন এই সংগঠনের নারীদের যেন মানুষজন চিনতে পারে। তাই তাদের পোশাকের জন্য গোলাপি রং নির্ধারণ করেন। গোলাপি রং যেহেতু নারীত্বের প্রতীক এবং এই রংটি কোনো রাজনৈতিক দল ব্যবহার না করায় তারা নিজেদের দলীয় পোশাক হিসেবে গোলাপি রংকেই বেছে নিয়েছিলেন। প্রথমেই ৫০০ গোলাপি রঙের শাড়ি বানিয়েছিলেন। তখন থেকেই এই সংগঠনকে বলা শুরু হয় ‘গুলাবি গ্যাং’। গুলাবি গ্যাংয়ের কার্যক্রম এখন ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তাদের প্রধান তৎপরতা উত্তরপ্রদেশে।
গুলাবি গ্যাংকে নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মিত হয়েছে। ব্রিটিশ নির্মাতা কিম লঙ্গিনটো ২০১০ সালে গুলাবি গ্যাংয়ের ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম পিংক সারিজ (Pink Saris) নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছে গুলাব গ্যাং নামে একটি চলচ্চিত্র। সৌমিক সেন পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাধুরী দীক্ষিত ও জুহি চাওলা। গুলাবি গ্যাং তাদের কৃতিত্বের জন্য অনেক পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, গডফ্রে ফিলিপস ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ডস ও দ্য কেলভিনেটর ইলেভেন্থ জিআর-৮ উইমেন অ্যাওয়ার্ড।
এতকিছুর পরেও গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যদের নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার কারণে অনেকে তাদের কার্যক্রম পছন্দ করেননি। অনেকগুলো ফৌজদারি মামলাও হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সাম্পাত পাল দেবীকে আর্থিক অনিয়ম ও ব্যক্তিগত স্বার্থকে সংগঠনের স্বার্থ থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২০১৪ সালে গুলাবি গ্যাংয়ের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও তিনি সেসব অভিযোগকে মিথ্যা এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
জাহ্নবী