দেনমোহর হলো মুসলিম বিয়েতে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীর বাধ্যতামূলক প্রাপ্ত অর্থ কিংবা মূল্যবান সামগ্রীকে বোঝায়, যা স্ত্রীকে সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ এবং বিয়ের প্রতিদান হিসেবে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে সম্মান বা মর্যাদা প্রদর্শন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার লক্ষ্যেই মুসলিম বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে দেনমোহরের বিধান স্বীকৃত ও প্রচলিত। সাধারণত বর ও কনের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী দেনমোহর নির্ধারিত হয়। মুসলিম বিয়েতে এটি একটি বাধ্যতামূলক শর্ত। দেনমোহর আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট আবিদা বিনতে আনছার
আরবি শব্দ ‘মাহর’ বাংলায় মোহরানা অথবা দেনমোহর। বিবাহবন্ধনের বিনিময়ে স্ত্রী স্বামীর কাছে শরিয়তসম্মত যে অর্থ-সম্পদ লাভের অধিকারী হয় সেই অর্থ-সম্পদকে দেনমোহর বলা হয়। মুসলিম আইনে বৈধ বিবাহের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা।
দেনমোহর যৌতুক নয়, এটা স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধার নির্দশন। আইনে দেনমোহরের সর্বোচ্চ নির্ধারণ না থাকলেও সর্বনিম্ন নির্ধারিত করা তা হলো ১০ দিরহাম অর্থাৎ ২.৭৫ তোলা রূপা। মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা-২০০৯ আইনের ২৭(১) ধারা মতে, বিবাহ নিবন্ধন ফরম (ঘ) তথা কাবিননামার ক্রমিক নম্বর ১৩, ১৪, ১৫ ও ২০ কলামে নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমাণ, দেনমোহর পরিশোধ করার কথা উল্লেখ আছে। সাধারণত, মেয়েদের পারিবারিক অবস্থা, বংশ মর্যাদা ইত্যাদি লক্ষ্য রেখে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া ছেলেদের আর্থিক ব্যাপারটাও বিবেচনায় রাখা হয়। দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর পরিমাণ কমানো যায় না।
তবে ছেলে ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে কোনো কিছু উপহার দিলে তা কখনোই দেনমোহর হিসেবে বিবেচিত হবে না, যদি স্বামী দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি লেখা থাকতে হবে।
১৯৮৫ সালের মুসলিম পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুসারে, দেনমোহরের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, তা আদায়ের জন্য স্থানীয় পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয়। বিবাহবিচ্ছেদ হলে বিচ্ছেদের তিন বছরের মধ্যে এই মামলা করতে হয়। স্বামী বা স্ত্রী যেই তালাক দিক না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে প্রদান করতে হবে।
দেনমোহরের প্রকারভেদ
দেনমোহর মূলত দুই প্রকারের, যথা- ১) নির্ধারিত দেনমোহর ২) উপযুক্ত দেনমোহর।
বিয়ের সময় কাবিননামায় যে পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করা থাকে, সেটাই নির্ধারিত দেনমোহর। যদি কাবিননামায় দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত না থাকে তখন স্ত্রী নির্দিষ্ট পরিমাণের দেনমোহর আদায়ের জন্য আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। আদালত স্ত্রীর বাবার সামাজিক অবস্থান এবং স্ত্রীর নিজস্ব যোগ্যতা দেখে দেনমোহর নির্ধারণ করবেন। সেটাই উপযুক্ত দেনমোহর।
পরিশোধের সময় অনুসারে নির্ধারিত দেনমোহর ২ ধরনের
১) তাৎক্ষণিক দেনমোহর ২) বিলম্বিত দেনমোহর।
দেনমোহরের কিছু পরিমাণ বিয়ের সময় পরিশোধ (উসুল) করে দেওয়া হয়, সেটা তাৎক্ষণিক দেনমোহর। কাবিননামার ক্রমিক নম্বর ১৫ কলামে লিখিত থাকে। বাকিটা বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ধরা হয়। এটি স্ত্রী যখন ইচ্ছা তখন চাইতে পারেন না বা চাইলেও স্বামী তা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকেন না। যদি কোনো পক্ষের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক ভঙ্গ হয়ে যায় কিংবা স্বামী সালিশি পরিষদ তথা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে আরেকটি বিয়ে করেন তাহলেই স্ত্রী বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
স্ত্রীর মৃত্যু হলেও দেনমোহর মাফ হয় না। স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা মামলা দায়ের করে দেনমোহর আদায় করতে পারবেন, স্ত্রীর মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যে তা করতে হবে। স্বামীর মৃত্যু ঘটলেও বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর আদায় করতে পারবেন।
কলি