একই সঙ্গে পড়াশোনা, সন্তান, সংসার সবকিছু সামলে রোজ বাইরে বেরিয়ে পড়েন অর্থ উপার্জনের জন্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হরেক রকম কাবাবের মোবাইল ফুড কার্ট নিয়ে বসেন প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি। ‘জেরিনের লপলপে কাবাব’ ইতোমধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগত দর্শনার্থী ও ভোজনরসিকদের মন জয় করে নিয়েছে। জেরিন রহমানকে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী
টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের বিপরীত গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হরেক রকম খাবার আর মনোহারির অস্থায়ী দোকানের পসরা বসেছে। ঢাকার বাসিন্দারা একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে প্রাকৃতিক জায়গা খুঁজে থাকেন। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রোজ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অনেক মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। একে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এসব অস্থায়ী দোকান। গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, জেরিনের লপলপে কাবাবটা কোথায়? তিনি পথ দেখিয়ে দিলেন এবং এও জানিয়ে দিলেন জেরিন এখনো আসেননি। বুঝতে পারলাম, জেরিনকে এখানের সবাই এক নামে চেনেন। চেনারই তো কথা, একজন নারী হয়েও তিনি যেই দুঃসাহস দেখিয়েছেন, তা তো আর সবাই দেখাতে পারেন না। কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করার পর দেখলাম, দুই হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে এসে হাঁপিয়ে গেছেন জেরিন। কাছে গিয়ে পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তবে তার আগে আপনি একটু জিরিয়ে নিন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে সম্মতি জানিয়ে জেরিন বেঞ্চে বসে পড়লেন। খানিক বাদে আমার দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসলেন। শুরু হলো আমাদের কথোপকথন।
আগেই জেনেছিলাম, এই সাহসী নারীর বয়স মাত্র ২৩ বছর। জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন ধরে এই কাবাবের ব্যবসা করছেন এবং এই ব্যবসার পরিকল্পনা কীভাবে মাথায় এল? উত্তরে তিনি বললেন, “ব্যবসা করছি পাঁচ মাস ধরে। বাসাতেই তো থাকি। সংসারের কাজ করা, সন্তান লালনপালন করা ছাড়াও নিজের একটা উপার্জনের উৎস থাকা প্রয়োজন মনে করেছি। তখন এই কাবাবের ব্যবসা করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। ফেসবুকে ‘জেরিনের লপলপে কাবাব’ নামে একটা পেজ খুলি। কিন্তু পেজে রেসপন্স পাচ্ছিলাম না ঠিকমতো। তখন ভাবলাম, বাইরে গিয়েই এই ব্যবসা করব। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমে আমি একটা কাঠের ভ্যান নিই। ভ্যানে করেই বিক্রি করতে শুরু করি। তারপর এখন একটা ফুড কার্ট হয়েছে আমার।”
জেরিনের কাছে আরও জানতে চাইলাম, কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত রোজ কাবাব বিক্রি করেন? তিনি জানান, বিকেল ৪টা বা ৫টার দিকে এসে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত বিক্রি করেন।
দোকান দেওয়ার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বেছে নিলেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি আগে যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে আসতাম, দেখতাম এখানে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। এ ছাড়া অনেক মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে। তাই যখন কাবাবের ব্যবসা করার পরিকল্পনা মাথায় এল, বিশেষ করে যখন বাইরে গিয়ে কাবাব বিক্রি করব ভাবলাম, তখনই মনে হলো এই জায়গায় দোকান দিলে ভালো সাড়া পাব’।
‘জেরিনের লপলপে কাবাব’-এর নামের রহস্যের ব্যাপারে তিনি জানান, ‘এ নামটা দিয়েছে আমার ছোট বোন। বোনদের কাছে ব্যবসার আইডিয়া শেয়ার করে একটা ইউনিক নাম চেয়েছিলাম। তখন আমার ছোট বোন এই নামটা দিয়েছে।’
আপনার এখানে কী কী পাওয়া যায় এবং খাবারগুলোর মূল্য কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে পাওয়া যায় রেশমি মালাই কাবাব, হারিয়ালি কাবাব, শিক কাবাব, তান্দুরি, চাপ, গিলা কলিজা, উইংস ফ্রাই, লুচি, পরোটা, আলুর দম ইত্যাদি। লুচির দাম ৫ টাকা, পরোটা ১০ টাকা, হারিয়ালি কাবাব ৮০ টাকা, মালাই কাবাব ১০০ টাকা, তান্দুরি ৮০ টাকা, চাপ ৮০ টাকা, শিক কাবাব ৮০ টাকা, বটি কাবাব ৭০ টাকা, গিলা কলিজা ৫০ টাকা, উইংস ফ্রাই ৫০ টাকা।’ এসব আইটেমের ভেতর কোনটা বেশি জনপ্রিয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানের শিক কাবাবটা মানুষ বেশি পছন্দ করেন। শিক কাবাবটা অনেক বেশি চলে।’
কথা প্রসঙ্গে জেরিনের কাছে জানতে চাইলাম সেই শুরুর গল্পটা। অমায়িক হেসে জেরিন বলতে শুরু করলেন, ‘আসলে ওই যে প্রথমদিকে বললাম, সংসার আর সন্তান সামলিয়েও নারীদের কিছু করা উচিত অর্থ উপার্জনের জন্য। যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সেখানে নারী হয়ে আমাদেরও তো কিছু করা উচিত। সত্যি বলতে আমার অনুপ্রেরণা তিনিই। তাকে দেখেই আমি শিখেছি। আমার মনে হয়েছে, প্রতিটা নারীর সাবলম্বী হওয়া উচিত। যাই হোক, এই পরিকল্পনা করার পর আমার ফুপিকে যখন আমি বলেছি, তখন তিনিও আমাকে সমর্থন জুগিয়েছেন। দুজন মিলে শেয়ারে ব্যবসা করছি। প্রথমে ছবির হাট থেকে শুরু করেছিলাম। পরে এখানে আসি।’
জানতে চাইলাম, কাস্টমারদের মতামত কী আপনার কাবাব খেয়ে? জেরিন খুব সহজভাবেই উত্তর দিলেন, ‘আসলে কাস্টমাররা ভালো-মন্দ উভয় মতামতই দিয়ে থাকেন। যেদিন ভালো হয়, সেদিন ভালো বলেন। যেদিন লবণ কম বা বেশি হয়, সেটাও সুন্দর করে বলেন। ঝাল কমবেশি হলে জানান। আসলে হোমমেড তো, আমি নিজে হাতে করি, কখনো ভালো হয়, কখনো একটু খারাপ হয়। তবু চেষ্টা করি, নিজের মতো করে সেরাটা দেওয়ার।’
কৌতূহলবশতই জিজ্ঞাসা করলাম, রোজ কত টাকার কাবাব বিক্রি করেন, মাস শেষে লাভ কেমন থাকে? তিনি জানান, রোজ গড়ে ৫-৬ হাজার টাকার কাবাব বিক্রি করা হয় এবং মাসে তার একার লাভ থাকে ২০-৩০ হাজার টাকার মতো। যেহেতু তার ফুপিও তার সঙ্গে শেয়ারে আছেন, তাই তাকেও দিতে হয় সমান ভাগ।
স্বভাবতই জেরিনের কাছে প্রশ্ন রাখলাম, নারী হয়েও যে এমন একটা পাবলিক প্লেসে এই ব্যবসা করছেন, এর জন্য কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না? ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেক সমস্যাই হয়। বিভিন্ন ভাইয়া-আপু কটু কথা শোনান। অনেকের সঙ্গে ঝগড়া হয়, বকাঝকা করে। কিন্তু সেগুলো মাথায় নিই না। বোরখা পরে কাজ করি, তারপরও ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। পরিচিত-অপরিচিত অনেকে বলেন, নারী হয়েও ব্যবসা করলে তো পরিবারকে তোয়াক্কা করবে না, স্বামীর বাধ্যগত হয়ে চলবে না।’
জানতে চাইলাম, আপনার স্বপ্নপূরণের পথে কাদের অবদানের কথা আপনি বলতে চান? উত্তরে জেরিন খুব আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলেন, ‘প্রথমত এর পেছনে আমার আম্মুর অনেক বড় অবদান আছে। আম্মু আমাকে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছুতে সহযোগিতা করছেন। দ্বিতীয়ত, আমার শাশুড়ির কিছু অবদান আছে। আমি এখানে আসতে পারি, কাজ করতে পারি, কারণ তিনি আমার আড়াই বছরের ছোট্ট শিশুটাকে রাখেন। আমার বাবুটা কখনো কখনো আমার মায়ের কাছেও থাকে। তাই আমি নিশ্চিন্তে এদিকটা সামলাতে পারি। তৃতীয়ত, আমার ফুপি, যে আমার পার্টনার, তিনি খুব সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া খালামণি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার স্বামী। তার সমর্থন না থাকলে হয়তো কখনোই শ্বশুরবাড়ি থেকে এই কাজ করতে পারতাম না। এরজন্য আমার স্বামীকে অনেক ধন্যবাদ।’
জেরিন রহমান আরও জানান, তিনি বোরহানউদ্দীন কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, পড়াশোনা, সংসার, সন্তান সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে কষ্ট হয় না? তিনি খুব দৃঢ়চিত্তে বললেন, ‘কষ্ট তো হবেই। কষ্ট করলেই তো কেষ্ট মিলবে। প্রতিটা মাকেই তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কিছু করা উচিত। আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ কিংবা স্বামী তো আমার সন্তানের জন্য করবেই। কিন্তু মা হিসেবে তো আমারও কিছু করা উচিত। শুধু আমার নয়, প্রতিটা মায়েরই যদি সন্তান আর সংসার সামলে কিছুটা সময় হাতে থাকে তাকে সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও উপার্জন করা উচিত।’
‘জেরিনের লপলপে কাবাব’ নিয়ে জেরিন রহমানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি এক বুক আশা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘সবার সহযোগিতা আর সমর্থন থাকলে আমি একটা রেস্টুরেন্ট দেব এবং তখনো এই নামটাই থাকবে। এই নামটা কখনো পরিবর্তন করব না। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।’
জাহ্নবী